বাসভাড়া কম, তাই হয়রানির ‘শুল্ক’ দিতে বাধ্য হচ্ছেন মানুুষ
Public Transport

সকাল-বিকেলের যুদ্ধ

গণপরিবহণ ব্যবস্থার এই দুর্দশার মূল কারণ বছরের পর বছর ভাড়া অপরিবর্তিত থাকা বা তা নামমাত্র বাড়া। গত কয়েক বছরে ডিজ়েলের দাম, বাস-ট্যাক্সি কেনার জন্য নেওয়া ঋণের মাসিক কিস্তি এবং পরিষেবা প্রদানের অন্যান্য খরচ ক্রমেই ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে।

Advertisement

পুনর্জিৎ রায়চৌধুরী

শেষ আপডেট: ০৯ জানুয়ারি ২০২৪ ০৮:১৩
Share:

—ফাইল চিত্র।

কথা ছিল আমার এক বন্ধু সস্ত্রীক আমাদের বাড়িতে আড্ডা দিতে আসবে সন্ধে সাড়ে ছ’টা নাগাদ। পৌঁছল আটটা নাগাদ। ঢুকতে ঢুকতেই অপরাধীর মতো মুখ করে বন্ধুটি বলল, “সরি ভাই, কলকাতার পাবলিক ট্রান্সপোর্টের যা অবস্থা! বহু চেষ্টা করেও হলুদ ট্যাক্সি পেলাম না। কেউ সওয়ারি নিতেই চায় না! শেষে যাও বা এক জন রাজি হল, সে বলে মিটারে যাবে না, পুরো ছ’শো টাকা দিতে হবে। আট-নয় কিলোমিটার দূরত্বের জন্য ছ’শো টাকা ট্যাক্সি ভাড়া অযৌক্তিক বলে অ্যাপ ক্যাব খুঁজতে শুরু করলাম তখন। তাও পেলাম না— সবাই খালি ক্যানসেল করে। অগত্যা মানিকতলা ক্রসিং থেকে ঠেলেঠুলে একটা অবিশ্বাস্য রকমের ভিড় বাসে উঠতে হল। তবে সেই বাসের যা লজ্‌ঝড়ে দশা— মাঝরাস্তায় যে দেহ রাখেনি, সেটাই সৌভাগ্য!”

Advertisement

এই অভিজ্ঞতা শহরবাসীর নিত্য দিনের। এর কারণ একটাই— কলকাতার গণপরিবহণ ব্যবস্থা কার্যত ভেঙে পড়েছে। আগের তুলনায় রাস্তায় বাস এবং ট্যাক্সি, দুইয়েরই সংখ্যা কমে গিয়েছে অনেকটা। যেগুলিকে চলতে দেখা যায়, সেগুলিও প্রাগৈতিহাসিক আমলের এবং যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ধুঁকছে। দিনের বেলায় যা-ও বা চেষ্টাচরিত্র করে গণপরিবহণ পাওয়া যায়, সন্ধের পর পরিস্থিতি হয়ে ওঠে একেবারে বিভীষিকাময়— রাস্তা থেকে বাস উধাও, ট্যাক্সি পাওয়া প্রায় লটারি জেতার শামিল। মেট্রো এবং অটো থাকার কারণে হয়তো এই সঙ্কটের খানিকটা সুরাহা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মেট্রো পরিষেবার অবস্থাও রয়ে গিয়েছে ন্যূনতম স্তরে, আর অটো তো চলে কেবল স্বল্প দূরত্বের নির্দিষ্ট কিছু রুটে। তাই যদি বলা হয়, যে শহরের গণপরিবহণ ব্যবস্থা একদা ছিল ভারতের মধ্যে সেরা, তা আজ ভেন্টিলেশন সাপোর্টে রয়েছে— সেটা বাড়িয়ে বলা হবে না এতটুকু। এবং আগামী দিনে এই পরিস্থিতির উন্নতির থেকে অবনতি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি, কারণ ২০২৪-এর ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে শহরের অর্ধেক বাসের বয়স ১৫ বছর অতিক্রান্ত হতে চলেছে। ১৫ বছরের মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়া বাস আর চালানো যাবে না বলে নির্দেশ রয়েছে আদালতের।

গবেষণায় দেখা গিয়েছে, শহরের উন্নয়নের সঙ্গে গণপরিবহণের মান অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িত। তার কারণ, যে ‘আর্বান মোবিলিটি’ বা শহরের মধ্যে যাতায়াতের স্বাচ্ছন্দ্যের উপর নির্ভর করে নগরায়ণ এবং উন্নয়ন, তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক গণপরিবহণ ব্যবস্থা। তাই যে শহর যত উন্নত এবং আধুনিক, সে শহরের গণপরিবহণ ব্যবস্থা তত ভাল। লন্ডন, নিউ ইয়র্ক, প্যারিস, সিঙ্গাপুর— উন্নত বিশ্বের একেবারে প্রথম সারির এই শহরগুলিতে উন্নত মানের গণপরিবহণ ব্যবস্থা আছে, যা এই শহরগুলির লাইফলাইন হিসাবে কাজ করে। তাই মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য কোনও কারণে গণপরিবহণ চলাচল ব্যাহত হলে, এই শহরগুলিতে বিপুল বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। আর আমরা, যারা কলকাতায় থাকি অথবা নিয়মিত আসি কাজেকর্মে, একেবারে ধসে যাওয়া গণপরিবহণ ব্যবস্থার সঙ্গে ঘর করে চলেছি মুখ বুজে বছরের পর বছর।

Advertisement

সম্ভবত আমরা ধরেই নিয়েছি যে, এটা আমাদের ভবিতব্য। তাই শহরের গণপরিবহণ ব্যবস্থার দুর্দশা নিয়ে আলোচনা বা তর্কবিতর্কও হতে দেখি না তেমন। এ শহরে ক’জন মানুষের নিজেদের যানবাহন আছে? গাড়ি, মোটরবাইক-স্কুটি মিলিয়ে খুব বেশি হলে ২৫ শতাংশ? অর্থাৎ, অন্তত ৭৫ শতাংশ মানুষ গণপরিবহণের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। যাঁদের নিজস্ব গাড়ি কিংবা মোটরবাইক আছে, তাঁদেরও কি প্রায়ই গণপরিবহণের শরণাপন্ন হতে হয় না? অনেকেই পার্কিং পাবেন না বলে বা যানজটে গাড়ি চালানোর হ্যাপা এড়াতে গাড়ি থাকা সত্ত্বেও চেষ্টা করেন গণপরিবহণ ব্যবহার করতে। অনেকে নিজেরা গাড়ি চালান না (যেমন প্রবীণ নাগরিকরা) কিন্তু সর্ব ক্ষণের চালক রাখারও সঙ্গতি নেই— এঁদের নির্ভর করতে হয় ঘণ্টা হারে ভাড়া করা চালকদের উপর। এই চালকদের সব সময় পাওয়া যায় না বলে এঁদেরও গণপরিবহণ ব্যবহার করতে হয় প্রায়ই।

গণপরিবহণ ব্যবস্থার এই দুর্দশার মূল কারণ বছরের পর বছর ভাড়া অপরিবর্তিত থাকা বা তা নামমাত্র বাড়া। গত কয়েক বছরে ডিজ়েলের দাম, বাস-ট্যাক্সি কেনার জন্য নেওয়া ঋণের মাসিক কিস্তি এবং পরিষেবা প্রদানের অন্যান্য খরচ ক্রমেই ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। পরিবহণ ক্ষেত্রে যাঁরা যুক্ত, তাঁদের অনেকেই বলবেন, পাল্লা দিয়ে বেড়েছে পুলিশের আদায় করা জরিমানার পরিমাণও। কিন্তু, এ সবের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে গণপরিবহণের ভাড়া বাড়াতে দেয়নি রাজ্য সরকার। সরকারের যুক্তি: গণপরিবহণের ভাড়া বাড়লে, জনসাধারণের উপরে আর্থিক চাপ বাড়বে। জনদরদি সরকার সেটা কখনওই হতে দিতে পারে না। নিন্দুকেরা অবশ্য বলেন, এটা আসল কারণ নয়। আসল কারণ— ভোট বড় বালাই। ভাড়া বাড়ানোর অনুমতি দিলে নির্বাচনে তার খেসারত দিতে হতে পারে সরকারপক্ষকে— এই ভাবনাই কাজ করে ভাড়া বাড়ানোর অনুমতি না দেওয়ার পিছনে। মুশকিল হল, যে কারণেই সরকার গণপরিবহণের ভাড়া বৃদ্ধির অনুমতি না দিক, ভাড়া যথেষ্ট হারে বাড়ছে না বলে গণপরিবহণ চালানো ক্রমশই অলাভজনক হয়ে উঠেছে। তার ফলে মালিকপক্ষের বাস এবং ট্যাক্সি রাস্তায় নামানোর এবং সেগুলির যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ করার উৎসাহে ক্রমেই ভাটা পড়েছে।

রাজ্য সরকারকে একটা জিনিস পরিষ্কার করে বুঝতে হবে। গণপরিবহণের ভাড়া বাড়তে না দিয়ে তারা আদতে মানুষের উপর আর্থিক চাপ বাড়তে দিচ্ছে না, এটা হয়তো ঠিক, কিন্তু এর ফলে বৃদ্ধি পাচ্ছে মানুষের হয়রানি। মনে রাখতে হবে হয়রানির কিন্তু ‘শুল্ক’ আছে, যা মেটাতে হয় তাঁদের, যাঁরা এর শিকার। এই ‘শুল্ক’ হতে পারে আর্থিক (বেশি ভাড়া দিয়ে ট্যাক্সিতে যাতায়াতের খরচ), শারীরিক (ভিড় বাসে দমবন্ধের উপক্রম হওয়া), এবং মানসিক (রাস্তায় বেরোনো নিয়ে উদ্বেগ)। অতএব, গণপরিবহণের নির্ধারিত ভাড়া কম হলেও, আসলে যে ভাড়া মানুষকে মেটাতে হচ্ছে ধ্বস্ত গণপরিবহণ ব্যবহারের জন্য, সেটা নেহাত কম নয়। তাই সরকার যদি গণপরিবহণের ভাড়া কিছুটা বাড়াতে অনুমতি দেয়, তাতে সাধারণ মানুষের সমস্যা বাড়ার বদলে কমবে, সে সম্ভাবনা প্রবল। তার কারণ, এই মুহূর্তে মানুষ গণপরিবহণ ব্যবহারের জন্য যে ‘আসল ভাড়া’ দিচ্ছেন তা এতটাই বিপুল যে, তার তুলনায় বর্ধিত ভাড়া কম হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। ভাড়া বাড়ানোর অনুমতি দিলে তাই এক দিকে যেমন গণপরিবহণের পরিষেবা উন্নত করতে এবং সেগুলিকে রক্ষণাবেক্ষণ করতে মালিকপক্ষ উৎসাহ পাবেন, অন্য দিকে ভাড়া কিছুটা বেশি দিতে হলেও, হয়রানি সংক্রান্ত শুল্ক যে-হেতু কমবে, সাধারণ মানুষের আখেরে উপকারই হবে। বর্ধিত ভাড়া যে সবার জন্য এক হতে হবে, এমন নয়। সরকার যদি মনে করে যে, কিছু নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর (যেমন ছাত্র, প্রবীণ, বা আর্থিক ভাবে অসচ্ছল মানুষ) জন্য ভাড়া কম রাখা প্রয়োজন, ভর্তুকির মাধ্যমে সে ব্যবস্থাও হতে পারে।

এর সঙ্গে গণপরিবহণের চাহিদা-জোগানের দিকেও নজর দেওয়া জরুরি। সন্দেহ হয় যে, কলকাতায় বিভিন্ন রুটে বাস চালানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় চাহিদা-জোগানের কোনও হিসাব না করেই। এর ফলে যেমন কিছু রুটে বাসের জোগানের থেকে চাহিদা বেশি হয়, অনেক রুটে ঘটে ঠিক উল্টোটা। গবেষণা বলছে, বৈজ্ঞানিক উপায়ে বাসের চাহিদার পূর্বাভাস করে, এবং তার ভিত্তিতে বিভিন্ন রুটে বাসের সরবরাহ স্থির করে যদি বাসের চাহিদা-জোগানের ফারাক কমানো যায়, তা হলে নামমাত্র ভাড়া বাড়িয়েও বাসের ‘অপারেশনাল ভায়াবিলিটি’-র অনেকটা উন্নতি ঘটানো সম্ভব।

মোট কথা, গণপরিবহণ সঙ্কট মেটাতে নানা উপায়ের কথাই ভাবা যেতে পারে। প্রয়োজনে গঠন করা যেতে পারে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি, নেওয়া যেতে পারে পরিবহণ-বিশেষজ্ঞ এবং জনসাধারণের মতামত। কিন্তু এ সবের জন্য সরকারের থাকতে হবে অনেকটা সদিচ্ছা, আর অল্প একটু সাহস।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement