মমতার পুজো ব্র্যান্ডিং-এর সমালোচকরা ‘নিষ্কাম জনসেবা’ করেন না
Durga Puja 2022

উৎসবের নীতি ও রাজনীতি

কলকাতার পুজোকে ইউনেস্কো-র স্বীকৃতি দেওয়া এ বছরের একটি বাড়তি উপাদান। সেটা না হলেও অবশ্য পুজো এ বার এমনই জমকালো হত।

Advertisement

দেবাশিস ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০২২ ০৫:৫৮
Share:

উৎসব-রঞ্জন: মহানগরের রাজপথে দুর্গোৎসব সমাপনী কার্নিভাল, ২০২২। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী

পুজো থেকে কার্নিভাল, সব পর্ব শেষ। কোভিডের জন্য গত দু’বছর পুজোয় অনেক রকম বিধিনিষেধ ছিল। তাই এ বারের ‘মুক্ত’ হাওয়ায় পুজো নিয়ে যে বাড়তি উন্মাদনা থাকবে, সেটা আন্দাজ করা গিয়েছিল। অনুমান মিলে গিয়েছে।

Advertisement

কলকাতার পুজোকে ইউনেস্কো-র স্বীকৃতি দেওয়া এ বছরের একটি বাড়তি উপাদান। সেটা না হলেও অবশ্য পুজো এ বার এমনই জমকালো হত। এ দিক থেকে দেখলে বাঙালির এ বারের শারদ-আনন্দকে ‘সফল’ বলা যেতে পারে।

তবে এ বার যেটা ব্যতিক্রমী মনে হয়েছে, তা হল রাজনীতি। সাধারণত উৎসবের দিনগুলিতে রাজনীতি কিছুটা ব্যাকফুটে থাকে। এ বার প্রায় প্রতি দিনই তার জোরালো উপস্থিতি দেখা গিয়েছে। ঠিক বললে, উস্কানিও।

Advertisement

এর পিছনে সাম্প্রতিক পরিস্থিতির খানিক ভূমিকা নিশ্চয়ই আছে। সমান্তরালে আছে ‘আলো’ কেড়ে নেওয়ার লক্ষ্যে বিরোধীদের সচেতন চেষ্টা। সব মিলিয়ে তাই বাঙালির সবচেয়ে বড় এই উৎসবকে দৈনন্দিন রাজনীতির বাইরে রাখা যায়নি। হার-জিতের হিসেব পরের কথা।

সবাই জানেন, উৎসব-প্রবণতা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি বড় ব্র্যান্ডিং। এর মধ্যে নিশ্চয়ই তাঁর কিছু রাজনৈতিক অঙ্ক আছে। অনেকে অনেক বার নানা ভাবে সে কথা বলেছেন, যাতে কটাক্ষের পরিমাণও বড় কম নেই। তা বলে বিরোধীরা যা করতে চাইছেন, সেটাও ‘নিষ্কাম জনসেবা’ বলে ভেবে নেওয়ার কোনও কারণ নেই।

আসলে সহজ সত্য হল, কোনও বড় উৎসবকে নির্দিষ্ট গণ্ডি থেকে বার করে ব্যাপক অর্থে সামাজিক ও সর্বজনীন করে তোলার কাজটি মমতার আগে এ ভাবে কেউ করে দেখাননি। হয়তো ভেবেও দেখেননি। সেটা পুজো, বড়দিন, বা নন্দন থেকে সরিয়ে নেতাজি ইন্ডোরে ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের উদ্বোধন, যা-ই হোক।

আর এটাও স্পষ্ট যে, নিন্দা, সমালোচনা সব সত্ত্বেও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বিভিন্ন উৎসবের জৌলুস, চাকচিক্য এখন যথেষ্ট বেড়েছে। সর্ব স্তরের সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণেও খামতি নেই। এই অবস্থায় বিরোধী রাজনীতি তার পরিসর খুঁজে বেড়াচ্ছে।

দুর্গাপুজো বা বড়দিন তো কোনও হঠাৎ গজিয়ে ওঠা উৎসব নয়। সবই ছিল, আছে, থাকবে অনন্তকাল। কিন্তু এখন সরকারের উদ্যোগে তাতে দৃশ্যতই বহু পরিবর্তন এসেছে। বিভিন্ন উৎসবের মরসুমে শহরকে বিশেষ ভাবে সাজিয়ে তোলা হয়। কলকাতার পুজো, রেড রোডে কার্নিভাল থেকে শুরু করে বড়দিন, ‘নিউ ইয়ার’ উদ্‌যাপন পর্যন্ত কয়েকটি মাস এখানে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের সংখ্যাও বাড়ে। স্থানীয়রা তো আছেনই।

বস্তুত পুজোর কলকাতা বা বড়দিনের পার্ক স্ট্রিট ও সংলগ্ন এলাকা আজ যে ধরনের পর্যটক টানে, কয়েক বছর আগেও তেমনটি চোখে পড়ত না। এঁদের একাংশ দামি হোটেলে থাকেন। বড় বড় রেস্তরাঁ বা অভিজাত ক্লাবে লাঞ্চ-ডিনার সারেন। প্রচুর শপিং করেন। আর একটি বড় অংশ তুলনায় সাধারণ মানের। মাঝারি মাপের হোটেল-রেস্তরাঁ এবং ছোটখাটো দোকানিদের কাছে তাঁরাই ‘লক্ষ্মী’ হয়ে ওঠেন। যার অর্থ, সর্ব স্তরেই কিছু ব্যবসা হয়। সব মিলিয়ে তাই এই সব উদ্‌যাপনের একটি বৃহত্তর বাণিজ্যিক দিক আছে।

সরকারের দাবি, বাংলায় উৎসবের বাজারে এ বার অন্তত চল্লিশ হাজার কোটির লেনদেন হচ্ছে। কতটা হয়, সেটা বিশেষজ্ঞরা ঠিক বলতে পারবেন। তবে এ কথা মানতেই হবে, সামগ্রিক ভাবে অর্থনীতির উপর এই ধরনের উৎসবমুখিতার একটি ইতিবাচক প্রভাব থাকে, যা এক কথায় উড়িয়ে দেওয়ার নয়।

এখন প্রশ্ন, উৎসবের পালে হাওয়া জুগিয়ে মমতা কি ‘ভুল’ করছেন? তিনি এগুলি শুরু করার পর থেকে বার বার এই বিতর্ক সামনে এসেছে। তিনি কেন পুজোর ক্লাবগুলিকে টাকা দেবেন, কেন সরকার কার্নিভালের আয়োজন করবে ইত্যাদি প্রসঙ্গও বহুচর্চিত। রাজনৈতিক বিরোধী এবং সমালোচকেরা এ সব ফি-বছরই বলেন। তাঁদের দিক থেকে কিছু যুক্তিও থাকে। ওঁদের পক্ষে যেটা বলা খুব স্বাভাবিক।

কিন্তু যাঁদের নিয়ে রাজনীতি, সেই সাধারণ মানুষ কি উৎসবের জৌলুসে ক্ষুব্ধ, বিরক্ত, প্রতিবাদী? যদি সেটা হত, তা হলে উৎসবে শরিক হতে লক্ষ, হাজার মানুষ নিশ্চয়ই এ ভাবে পথে নামতেন না। এঁদের সবাই যে তৃণমূলের সমর্থক, তা নয়। সবাই ‘দিদি’-র ভোটারও নন। শুধু দল-মত নির্বিশেষে সকলে একই আনন্দের অংশীদার। ‘প্রকৃত’ বিচার তো সেখানে।

রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “উৎসবের একটা প্রধান লক্ষণ প্রাচুর্য। এইজন্য উৎসবদিনে আমরা প্রতিদিনের কার্পণ্য পরিহার করি। দৈন্যের দিন অনেক আছে। আজ উৎসবের দিন।”

উৎসব সর্বজনীন আনন্দের উপকরণে সাজানো হলে ধর্ম-বর্ণ-রাজনীতি কিছুই সেখানে সরাসরি দাগ কাটতে পারে না। রাজনীতিকে আবডালে রেখে মমতা সেই কৌশলটিই প্রয়োগ করছেন। ফলে তাৎক্ষণিক কিছু উত্তাপ ছড়ানো ছাড়া সমালোচনা, বিরোধিতা সেখানে কার্যত পরাজিত হয়। এটা কেউ মানতে না-ও পারেন। বাস্তব তাতে বদলে যায় না।

ঘটনা হল, রাজনৈতিক স্বার্থে দুর্গাপুজোর মতো বিশাল একটি সামাজিক উৎসবে সরাসরি যুক্ত হওয়ার সুযোগ সব দলই খোঁজে। যার সঙ্গে লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রত্যক্ষ সংযোগ, সেখানে এই চাওয়াটা যে কোনও রাজনৈতিক দলের পক্ষে স্বাভাবিক। যে যার মতো করে তার পথ খোঁজে।

এ ক্ষেত্রে তৃণমূল এবং সিপিএমের অবস্থান মোটামুটি স্পষ্ট। ক্ষমতায় থাকার সময়েও সিপিএমের পরিচিত নেতারা সোজাসুজি পুজোয় ঢুকতেন না। সেটা ‘পাড়ার ছেলে’দের উপর ছাড়া থাকত। দল বিভিন্ন বড় প্যান্ডেলের পাশে বইয়ের স্টল খুলে ‘জনসংযোগ’ করত। এখনও সেটাই তারা করে। যদিও বাম আমলে সেই জনসংযোগ অনেকটাই ছিল পুজোগুলির উপর খবরদারির নামান্তর।

মমতারও পুজো নিয়ে কোনও লুকোছাপা নেই। তিনি সরকারে এসে ঢাকঢোল বাজিয়ে পুজোয় ঢুকলেন। তৃণমূলের অন্য কেষ্টবিষ্টু নেতাদের পুজোগুলি ফুলেফেঁপে উঠল। পাশাপাশি দুর্গাপুজোয় সরকারের পৃষ্ঠপোষকতাও চালু হয়ে গেল। সেই ধারা বহমান।

মনে রাখতে হবে, টাকা ছড়িয়ে পুজোর ‘দখল’ নেওয়ার চেষ্টা বিজেপিও করেছিল। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে ভাল ফল করার পরেই ’২১-এর বিধানসভার দিকে তাকিয়ে বিজেপি কলকাতার পুজোয় সেই দখলদারির হাত বাড়ায়। ২০২০ সালে একাধিক ক্লাবকে পুজোর পুরো খরচ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়। শেষ পর্যন্ত ‘কাজ’ হয়নি।

অতঃপর তারা নিজেরাই পুজো শুরু করে। ২০২০ সালে বিরাট ঘটাপটা, ’২১-এ ভোটে হারার পরে স্তিমিত। এ বার প্রায় নাম-কা-ওয়াস্তে। দিলীপ ঘোষ তো বলেই দিয়েছেন, সবটাই রাজনীতির অঙ্ক!

এ বার পুজোর দিনগুলিতে আর এক রাজনীতির অঙ্ক দেখা গিয়েছে শিক্ষকপদে চাকরিপ্রার্থীদের ধর্নামঞ্চকে ঘিরে। সবাই জানেন, মেধা তালিকায় নাম থাকা চাকরিপ্রার্থীরা আজ এক বছরেরও বেশি মেয়ো রোডে গান্ধীমূর্তির কাছে বসে। বার বার প্রশ্নের মুখে পড়ছে সরকারের ভূমিকা। এ এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। যা অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং চরম অবাঞ্ছিত।

ধর্নাকারীদের হাতে কোনও ঝান্ডা নেই। তবে পুজোর মধ্যে রোজ বিজেপি, বাম ও কংগ্রেস কেউ না কেউ সেখানে যেত। কিন্তু কার্যকারণ বিচার করলে এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না, ওই পরিকল্পনার পিছনে সহমর্মিতা যত না ছিল, রাজনীতি তার চেয়ে কিছু কম ছিল না। বিরোধী দলগুলির কাছে এটা আসলে ছিল পুজো-পৃষ্ঠপোষকতার পাল্টা চাল। পরিস্থিতির ‘সুযোগ’ নিয়ে তারা তাই পুজোর দিনগুলিতেই ধর্নামঞ্চকে ব্যবহার করতে চেয়েছে। রাজনীতিতে এমন কৌশলকে আপত্তিকর বলা চলে না।

কিন্তু মহাত্মা গান্ধীকে ‘অসুর’ সাজিয়ে কলকাতায় হিন্দু মহাসভার পুজো এ বার যে নজির গড়ল, মণ্ডপে রাজনীতির তেমন উগ্র প্রকাশ এর আগে দেখা যায়নি। প্রবণতাটি ভয়ঙ্কর। বিস্ময়ের বিষয়, এ নিয়ে কারও তেমন মাথাব্যথা নেই!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement