ক্ষত: অযোধ্যার বাবরি মসজিদে চড়াও করসেবকরা। ৬ ডিসেম্বর ১৯৯২। —ফাইল চিত্র।
আজই হয়তো শেষ ৬ ডিসেম্বর, যে দিন অবধি ভারতীয় গণতন্ত্রে এই তারিখটার তাৎপর্য ছিল। মন্দির প্রায় তৈরি হয়ে গিয়েছে, সামনের মাসে উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী— ভারত থেকে পাকাপাকি ভাবে মুছে যাবে বাবরি মসজিদের শেষ দাগটুকুও। একটা আপাত-অকিঞ্চিৎকর মসজিদ আর তাকে ঘিরে তৈরি করে তোলা হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির বয়ান কী ভাবে পাল্টে দিয়েছিল ভারতের রাজনীতিকে, সেই তর্ক তার শেষ প্রাসঙ্গিকতা হারাবে— মন্দিরে অস্তিত্ব জানিয়ে দেবে যে, এই ধর্মনিরপেক্ষ দেশে সংখ্যালঘুরা হার মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন। কী ভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্ম ধাপে ধাপে পৌঁছে যেতে পারে এমন প্রশ্নাতীত জয়ে, আর কী ভাবে রাষ্ট্রশক্তি সংখ্যালঘুদের বাধ্য করতে পারে জমি ছেড়ে দিতে, সে প্রশ্ন হয়তো ভবিষ্যতেও উঠবে, কিন্তু, তেমন রাজনৈতিক তাৎপর্য থাকবে কি তার? হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতার এই আধিপত্য প্রতিষ্ঠা, এবং মুসলমানদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পর্যবসিত করা হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির শতাব্দীলালিত লক্ষ্য। কিন্তু, শুধু কি সেই রাজনীতিই পারত এমন নিঃসংশয় জয় অর্জন করতে? হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির বাইরের পরিসরে কী ভাবে মসজিদের মুছে যাওয়া ক্রমে অনিবার্য হয়ে উঠল?
১৯৮৫ সালে রাজীব গান্ধীই বাবরি মসজিদের তালা খুলে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন কি না, তা নিয়ে কিছু দিন আগে অবধি ক্ষীণ হলেও সংশয় ছিল। মণিশঙ্কর আইয়ারের মতো কেউ কেউ দাবি করেছিলেন, রাজীব নন, এর পিছনে মূল ভূমিকা ছিল তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অরুণ নেহরুর। ইদানীং অবশ্য কমল নাথের মতো নেতারা মসজিদের তালা খোলার জন্য রাজীবের হয়ে কৃতিত্ব দাবি করছেন। কিন্তু, রাজীবই হোন বা অরুণ নেহরু, মূল কথাটা পাল্টায় না যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনীতির এ-হেন সিংহদুয়ার খুলে দেওয়ার ‘কৃতিত্ব’টি কিন্তু বিজেপির নয়, কংগ্রেসের। ১৯৮৪-র লোকসভা নির্বাচনে বিধ্বস্ত বিজেপি সেই সুযোগ গ্রহণ করেছিল দু’হাতে।
অবশ্য, মসজিদের দরজায় তালা ঝোলানোর ‘কৃতিত্ব’ও কংগ্রেসেরই ছিল। ১৯৪৯ সালে যখন বাবরি মসজিদের মূল গম্বুজের নীচে আচমকা আবির্ভাব ঘটে রামলালার মূর্তির, রাজ্যে তখন মুখ্যমন্ত্রী গোবিন্দ বল্লভ পন্থ। কী ভাবে মসজিদের কেন্দ্রস্থলে পৌঁছল এক দেবমূর্তি— এবং, মূর্তিপূজায় অবিশ্বাসী মুসলমানদের ধর্মবিশ্বাসে এক বিপুল আঘাত করল— রাজ্য সরকার তার তদন্ত করার, বা দোষীদের চিহ্নিত করার বিশেষ চেষ্টা করেনি। কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে পটেল-ঘনিষ্ঠ পন্থের কাছে তখন হিন্দু সনাতনিদের কাছে বিশ্বাসভাজন হয়ে ওঠার তাগিদ অনেক বেশি জোরদার ছিল, ফলে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর উদ্বেগে তিনি বিশেষ কর্ণপাত করেননি। হিন্দুদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে, এই ‘আশঙ্কা’য় মসজিদ থেকে সরানো হল না রামলালার মূর্তিটিও। তাতে অবশ্য সাম্প্রদায়িক সংঘাত ঠেকানো যায়নি। শেষ অবধি তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হল মসজিদের দরজায়, রামলালার মূর্তিটি থেকে গেল ভিতরেই। ঘটনাটি যখন ঘটছে, তখনও গান্ধীহত্যার দায়ে জনমানসে হিন্দুত্ববাদীদের গ্রহণযোগ্যতা তলানিতে; রাম মন্দিরকে কেন্দ্র করে যে এক ভয়াল রাজনীতি গড়ে তোলা যায়, সে ভাবনা অন্তত চার দশক দূরে।
১৯৮৫ সালে বাবরি মসজিদের তালা খোলার পর ক্রমে তৈরি হল মন্দিরকেন্দ্রিক রাজনীতির হাওয়া, লালকৃষ্ণ আডবাণী রথযাত্রা করলেন; করসেবকরা অযোধ্যায় মসজিদ ভাঙল, বিজেপি নেতারা সে দৃশ্য প্রত্যক্ষ করলেন— কেউ উল্লসিত ভঙ্গিতে, কেউ বা ছলছল চোখে। তার পাঁচ দিনের মাথায় ইলাহাবাদ হাই কোর্ট রায় দিল: মসজিদের জমির মালিকানা যে-হেতু সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডের, এবং সেই জমিতে যে-হেতু একটি কবরস্থান রয়েছে, ফলে উত্তরপ্রদেশে কল্যাণ সিংহের নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার যে ভাবে সেই জমি অধিগ্রহণ করেছে, তা আইনানুগ নয়। এই রায়ের দু’সপ্তাহের মধ্যে নরসিংহ রাওয়ের সরকার অর্ডিন্যান্স জারি করে মসজিদ ও সংলগ্ন এলাকার জমি অধিগ্রহণ করল। এবং, বাবরি মসজিদ তৈরি হওয়ার আগে সেখানে কোনও হিন্দু মন্দির বা কোনও হিন্দু ধর্মীয় কাঠামোর অস্তিত্ব ছিল কি না, সে বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের মতামত চাইতে অনুরোধ করল রাষ্ট্রপতিকে। ১৯৯৪ সালে আদালত সেই অনুরোধকে ‘অপ্রাসঙ্গিক’ বলে সরিয়ে রাখল বটে, কিন্তু যে দাবিটি এত দিন ছিল হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির, তার উপরে রাষ্ট্রীয় সিলমোহর পড়ল।
সুপ্রিম কোর্টের সেই রায়ে অযোধ্যার মসজিদ পরিসরে হিন্দুদের প্রার্থনার অনুমতি দেওয়া হল। তার পিছনে ছিল একটি তথ্যভিত্তিক যুক্তি— মসজিদ ভাঙার আগে যত মুসলমান সেখানে নমাজ পড়তে যেত, তাদের সংখ্যার চেয়ে সেই চত্বরে হিন্দু পুণ্যার্থীদের সংখ্যা অনেক বেশি। তথ্যগত ভাবে যুক্তিটি ঠিক, কিন্তু তার পিছনে একটা অন্য তথ্যও থাকে, আইনজীবী রাজীব ধওয়ন যার উল্লেখ করেছিলেন— ১৯৪৯ সালের পর থেকে মুসলমানরা বাবরি মসজিদে নমাজ পড়েননি, তার কারণ, মসজিদে তালা ঝুলিয়ে সেখানে প্রবেশের পথ বন্ধ করেছিল রাজ্য সরকার।
মসজিদের জমি শেষ অবধি কাদের দখলে থাকবে, ইলাহাবাদ হাই কোর্টে সেই প্রশ্নে মামলা চলল দীর্ঘ দিন। ২০১০ সালে আদালতের রায়ে পাওয়া গেল তেভাগা সূত্র— অযোধ্যার জমিতে নির্মোহী আখড়া, উত্তরপ্রদেশের সুন্নি সেন্ট্রাল ওয়াকফ বোর্ড আর শ্রী ভগবান রাম বিরাজমান, তিন পক্ষের ভাগ হবে সমান-সমান। সূত্রটি স্বভাবতই কোনও পক্ষেরই পছন্দ হল না, মামলা গড়াল সুপ্রিম কোর্টে। কিন্তু, এই রায়েই ইলাহাবাদ হাই কোর্ট ভারতীয় মুসলমানদের একটি বিশেষ দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল— গোটা বিশ্ব যখন জানতে চাইছে যে, অন্য ধর্মের প্রতি মুসলমানদের অবস্থান কী, তখন ভারতীয় মুসলমানরা এই জমি বিবাদটির নিষ্পত্তির মাধ্যমেই বিশ্বকে সেই বার্তা দিক। ক্রিস্টাফ জাফরেলো (মোদী’জ় ইন্ডিয়া: হিন্দু ন্যাশনালিজ়ম অ্যান্ড দ্য রাইজ় অব এথনিক ডেমোক্র্যাসি, কনটেক্সট, ২০২১) আদালতের এই মন্তব্যকে ব্যাখ্যা করেছেন এই ভাবে: আদালত মুসলমানদের গণ্য করল ভারতের ‘এথনিক ডেমোক্র্যাসি’ বা জাতিভিত্তিক গণতন্ত্রের ছোট শরিক হিসাবে, এবং তাদের কাছে দু’টি বড় দাবি পেশ করল— এক, তাদের মেনে নিতে হবে, যে জমিতে বাবরি মসজিদ ছিল, সেখানেই তৈরি হবে হিন্দু মন্দির; এবং দুই, জমির দুই-তৃতীয়াংশ অধিকার হবে হিন্দুদের।
ইলাহাবাদ হাই কোর্টের সেই রায় থেকে উঠে এসেছিল আরও একাধিক সূত্র, যার মধ্যে অন্যতম ছিল এই কথাটি যে, বাবরি মসজিদই রামের জন্মভূমি কি না, সেই প্রশ্নে ভক্তদের বিশ্বাসই যথেষ্ট। একটি পাঁচশো বছরের পুরনো মসজিদ, আর একটি মন্দির যার অস্তিত্বের কোনও অকাট্য প্রমাণ নেই— এই সময় থেকেই সে দু’টির গুরুত্ব হয়ে দাঁড়াল তুল্যমূল্য। বিভিন্ন ঐতিহাসিক নথিতে অযোধ্যার রাম মন্দিরের উল্লেখ যে নেহাতই অনতিঅতীতের কথা, এমনকি স্কন্দপুরাণেও তার অন্তর্ভুক্তি ঘটেছে সম্ভবত সপ্তদশ শতকে, ইতিহাসবিদদের এমন আপত্তি গুরুত্বহীন হল। আর্কিয়োলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার রিপোর্টের অস্পষ্ট ইঙ্গিত থেকেই প্রতিষ্ঠিত হল রাম মন্দিরের অস্তিত্বের প্রমাণ। পরবর্তী কালে, ২০১৯ সালে, প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ-এর বেঞ্চ এই মামলার চূড়ান্ত রায় ঘোষণার সময় চার ইতিহাসবিদের (আর এস শর্মা, এম আতহার আলি, ডি এন ঝা ও সুরজ ভান) ১৯৯১ সালের রিপোর্টকে— যেখানে বলা হয়েছিল যে, অযোধ্যা আদৌ রামের জন্মভূমি নয়, এবং ১৮৫০-এর আগে রামায়ণেও অযোধ্যার বিশেষ গুরুত্ব ছিল না— ‘বড় জোর একটি মতামত’ বলে উড়িয়ে দিলেন।
২০১৯ সালে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে গোটা জমিটিই রাম মন্দিরের জন্য বরাদ্দ হল। কেন্দ্রীয় সরকারকে দায়িত্ব দিল আদালত— অছি পরিষদ গঠন করে তার হাতে মন্দির নির্মাণের ভার দিতে হবে। ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রে কেন সরকার মন্দির নির্মাণের বিষয়ে মাথা গলাবে, সে প্রশ্ন তত দিনে অবান্তর। শীর্ষ আদালত ওয়াকফ বোর্ডের হাতে পাঁচ একর জমি তুলে দেওয়ার নির্দেশ দিল— মন্দির চত্বরে নয়, অন্য কোথাও— সেখানে তৈরি হবে নতুন মসজিদ। কারণ, তাদের ধর্মস্থান ভাঙার ক্ষতিপূরণ প্রয়োজন। আদালত জানাল, ১৯৪৯ সালে মসজিদে রামলালার মূর্তি স্থাপন করাও অন্যায় ছিল, ১৯৯২ সালে মসজিদ ভাঙাও অন্যায়।
অযোধ্যায় মন্দির কি তবে এই দুটো অন্যায়ের উপরেই দাঁড়িয়ে থাকবে না? সেই অন্যায়ের স্বীকৃতিটুকু পেয়েছে মুসলমানরা; অন্যায় মুছে দেওয়ার কোনও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ আজকের ভারতে তাদের কল্পনাতীত। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পর প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে ‘বৈচিত্রের মধ্যে একতা’-র গুণকীর্তন করেছিলেন। সংখ্যাগরিষ্ঠের আধিপত্য মেনে নেওয়ার— মেনে নিতে বাধ্য হওয়ার— মধ্যে যে ‘একতা’, ভারতে তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিলক্ষণ।
‘বড়ি বড়ি ডেমোক্র্যাসি মে অ্যায়সি ছোটি ছোটি বাতেঁ হোতি রহতি হ্যায়’।