Politics

ক্ষমতার স্থিতিই যখন লক্ষ্য

এই স্থিতাবস্থার রাজনীতি আজকের নয়। বিড়লার অনুদানে সমৃদ্ধ গান্ধী যখন ত্যাগের মহিমা জপেন ও দারিদ্রকে গৌরবান্বিত করেন, তা কখনওই প্রকৃত বিকল্প হয়ে ওঠে না।

Advertisement

শ্রীদীপ ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৮:১৪
Share:

—প্রতীকী ছবি।

জাতি-শ্রেণি-ধর্ম-লিঙ্গ-ক্ষেত্র-রাষ্ট্র নির্বিশেষে ক্ষমতাশালী সম্প্রদায় কখনও সেই ক্ষমতার সমবণ্টন চায়নি। তারা ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখতে চায়। আসন অধিকার করে থাকার সেটাই সর্বপ্রধান শর্ত। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক— সব ক্ষেত্রেই কথাটা সমান সত্যি। উত্তরাধিকার সূত্রে ক্ষমতার হস্তান্তর হয় বটে, কিন্তু শাসকদের জাতিগত ও শ্রেণিগত চরিত্র বা চেহারার আমূল পরিবর্তন হয় না। মূলধারার রাজনীতি আসলে ক্ষমতার স্থিতাবস্থাটুকু বজায় রেখে চলে, তা সেই রাজনীতি যে রঙেরই হোক না কেন। সংখ্যালঘু, জনজাতি, দলিত, প্রান্তিক বা নারী সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকে যায়। সেটা কাকতালীয় নয়, কাঠামোগত কারণে।

Advertisement

এই স্থিতাবস্থার রাজনীতি আজকের নয়। বিড়লার অনুদানে সমৃদ্ধ গান্ধী যখন ত্যাগের মহিমা জপেন ও দারিদ্রকে গৌরবান্বিত করেন, তা কখনওই প্রকৃত বিকল্প হয়ে ওঠে না। চরকা ও পরহিতৈষণাবাদী মহাত্মা— বস্তুবাদ ও পুঁজিবাদবিরোধিতার আন্তর্জাতিক প্রতীক— কখনও কল ধ্বংসের ইস্তাহার লেখেননি; বরং স্থিতাবস্থার ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য মজুরদের ধর্মঘট থেকে বিরত থাকার উপদেশ দিয়েছেন। তাঁরা কাজ বন্ধ করলে শিল্পের বিস্তর ক্ষতি হবে, এমনটা বুঝিয়েছেন। তিনি অনশনে বসলে তা ‘সত্যাগ্রহ’; শ্রমিক বা দলিত আন্দোলন করলে তাঁরই ভাষায় তা ‘দুরাগ্রহ’। একই ভাবে, পুঁজিপতির বাণিজ্যিক স্বার্থ লালনের দায়িত্বে থাকা বর্তমান রাষ্ট্রনেতাও নিজেকে ফকির ভাবতে পছন্দ করেন। দীনতার ভান করে বলেন, ঝোলা নিয়ে বেরিয়ে পড়বেন এক দিন।

সহস্র বছরের জাতিভেদ প্রথা ও তার সঙ্গে জড়িত বিস্তর অবিচারকে উপেক্ষা করে, গান্ধী জাতিভেদ ও জাতিভিত্তিক পেশাকে, হিন্দু ধর্মের ‘অভ্যন্তরীণ আত্মা’ বলেন। দাবি করেন, জাতিগত স্থিতি আমাদের সভ্যতাকে পশ্চিমি প্রতিযোগিতার দৌড় থেকে রক্ষা করবে। আদর্শ ভাঙ্গি-র সংজ্ঞা নির্ধারণ করে তিনি ১৯৩৬-এ (প্রসঙ্গত, সে বছরই আম্বেডকর লিখেছিলেন অ্যানাইহিলেশন অব কাস্ট) গান্ধী লিখছেন: “ব্রাহ্মণের দায়িত্ব যেমন আত্মার নির্মল সাধন, ভাঙ্গির কাজ সেই আত্মার শরীর পরিচ্ছন্ন রাখা। সম্পদের অভিলাষ তাঁদের শোভা পায় না।” এক দিনের জন্যেও পরিচ্ছন্ন রাখার দায়ভার থেকে তাঁদের ছুটি নেই। তাতে সমাজের অকল্যাণ। গান্ধীর মতে, উচ্চবর্ণের হৃদয়ের পরিবর্তন হবে, এবং উচ্চবর্ণের পরিত্রাণের খাতিরেই তাদের দাঁড়ানো উচিত নিম্নবর্ণের পাশে। স্থিতাবস্থার পক্ষে এমন সওয়াল সত্যিই বিস্ময়কর।

Advertisement

আশি বছর পরেও কি সওয়ালের চরিত্র বদলাল? ২০১৭ সালে এক জনসভায় প্রধানমন্ত্রী মোদী বললেন, ভাঙ্গিদের কাজ নাকি ভগবানপ্রদত্ত এবং তাঁদের নিরন্তর সেবা অব্যাহত রাখার মধ্যেই আধ্যাত্মিক মুক্তি। বঞ্চিত করা বা করে রাখা বা করে যাওয়াই ক্ষমতার স্বভাবসিদ্ধ। ক্ষমতাশালীর এই আচরণ কেবল মারাত্মক নয়, তা যথেষ্ট সংক্রামক— তাকে অনুসরণ ও অনুকরণ করার মাধ্যমে। দরজা বন্ধ করা, প্রবেশাধিকার না দেওয়ার এই ইচ্ছাকৃত সামাজিক প্রবৃত্তিই অসমতার ধারক ও বাহক।

‘অচ্ছুত’কে হরিজন বলে তাঁদের শিশুসুলভ করে রাখার রাজনীতিও স্থিতাবস্থার পালন মাত্র। তাঁদের আলিঙ্গন করা ও তাঁদের সঙ্গে এক পাতে খাওয়া সহজ। কিন্তু তাঁদের রাজনৈতিক গণ্ডিতে সমতুল্য মনে করে সমান প্রতিনিধিত্ব দেওয়ার প্রশ্নে গান্ধী বারংবার বেঁকে বসেছেন। হরিজনদের পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর ক্ষেত্রে গান্ধীর মত অতি স্পষ্ট: যাঁদের মধ্যে কোনও রাজনৈতিক চেতনার উদ্ভব হয়নি, তাঁদের জন্য এ সবের কোনও মানেই হয় না। অর্থাৎ, রাজনৈতিক চেতনার সূচনা তাঁর উদ্দেশ্য নয়— তাঁদের প্রতিনিধিত্ব ও নেতৃত্ব যাতে হাতছাড়া না হয়, সেটাই মূল লক্ষ্য। ক্ষমতার প্রতি আসক্তির মূলেই রয়েছে নিয়ন্ত্রণ-প্রীতি। জনতা স্বয়ংক্রিয় হয়ে উঠলে তড়িঘড়ি হিংসার অজুহাতে অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করতে দেখি নেতাকে। স্থিতাবস্থা এবং নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া করা চলবে না।

জাতিভেদ, শ্রেণিভেদ, লিঙ্গভেদের প্রশ্নে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস হয় সম্পূর্ণ নীরব, বা যথেষ্ট সরব নয়। এ সকল গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে এই বলে যে, এগুলি জাতীয় ঐক্যের পথে বাধা বা স্বাধীনতার পরে বুঝে নেওয়া যাবে।

স্বাধীন দেশেও পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে চালনা করে চলেছে অর্থ ও সংখ্যার সমর্থন। শাসক দলকে যারা এই দুই ইন্ধন প্রদান করে— পুঁজিবাদী ও প্রভাবশালী জাতি ও শ্রেণি— তাদের চটানো তো যাবেই না, বরং তাদের সুবিধা করে দিতে হবে অনবরত। জমি ও সম্পদ থেকে আদায় করা মুনাফা ও সংখ্যা জোটাবার নির্বাচনী কৌশল— এই দুইয়ের সমন্বয়ে গঠিত হয় স্থিতাবস্থার চুক্তি ও সন্ধি, যার উদ্দেশ্য হল সুযোগ, সুবিধা ও ক্ষমতার একতরফা কেন্দ্রীকরণ। শাসক শ্রেণি ও তাদের সমর্থনকারীদের মধ্যে চলবে পারস্পরিক সুবিধার আদানপ্রদান। বিগত এক দশকে যখন রাষ্ট্র, রাষ্ট্র-নেতা, শাসক-দল ও ধর্মের মধ্যে বিভাজন বিলীন হয়ে গেছে, তখন সেই স্থিতাবস্থা আরও ঘনীভূত হয়েছে। স্থিতাবস্থার সমালোচনা মাত্রেই তা হয়ে গিয়েছে ঘোর রাষ্ট্রবিরোধিতা, এমনকি বিচ্ছিন্নতাবাদ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement