ভরসা? দলীয় সমর্থকদের সঙ্গে মধ্যপ্রদেশের বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিংহ চৌহান। ১২ নভেম্বর, ২০২৩, রাজগড়। পিটিআই।
এই ‘রেউড়ি’ বস্তুটা কী? বছরখানেক আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মুখে বার বার এই শব্দটি শুনে অনেকেই প্রশ্ন করেছিলেন। আসলে তিলের নাড়ু চ্যাপ্টা করে দিলে যা হয়, তাকেই বলে রেউড়ি। হিন্দি বলয়ের বাইরে কেউই এর সঙ্গে বিশেষ পরিচিত নন। উত্তর ভারতে তিল ও গুড়ের তৈরি এই ছোট্ট মাপের মিষ্টি ছেলে-বুড়ো সকলের প্রিয়। পূর্ব ভারতে যেমন মন্দিরে, রথযাত্রায় বাতাসা ছড়ানো হয়, উত্তর ভারতে তেমনই রেউড়ি বিলি হয়ে থাকে।
নরেন্দ্র মোদী সেই নিতান্ত সাধারণ ‘রেউড়ি’-কে আচমকাই রাজনৈতিক অভিধানে তুলে এনেছিলেন। বিভিন্ন রাজ্যে কংগ্রেস ও আঞ্চলিক দলের সরকারের জনমুখী প্রকল্পকে তিনি ‘রেউড়ি-সংস্কৃতি’ বলে আক্রমণ করেছিলেন। তাঁর দাবি ছিল, এই তালজ্ঞানহীন মাত্রাছাড়া জনমোহিনী রাজনীতির ফলে রাজ্যের কোষাগারে বোঝা চাপবে তো বটেই, গোটা দেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা হবে। তার পরে নীতি আয়োগ রাজ্যের মুখ্যসচিবদের সম্মেলন ডেকে একাধিক বার এ কথা বুঝিয়েছে। শ্রীলঙ্কার আর্থিক দেউলিয়া দশা দেখিয়ে বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর সর্বদলীয় বৈঠকে এ নিয়ে সতর্ক করেছেন। আর প্রধানমন্ত্রী নিয়মিত জনসভায় ‘রেউড়ি’ নিয়ে সরব হয়েছেন। বস্তুত তাঁর আগে কোনও রাজনীতিক এ ভাবে খয়রাতির বিরুদ্ধে মুখর হওয়ার সাহস দেখাননি।
এক বছরের মধ্যে নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর নিজের দলই যে ‘রেউড়ি’ বিলি শুরু করবেন, কে জানত!
মাস চারেকের মাথায় লোকসভা নির্বাচন। তার আগে হিন্দি বলয়ের তিন গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য-সহ পাঁচ রাজ্যে ভোট চলছে। সব রাজ্যেই কংগ্রেসের সঙ্গে খয়রাতির প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে বিজেপি। ছত্তীসগঢ়, রাজস্থানে এখন কংগ্রেসের সরকার। এই দুই রাজ্যে কংগ্রেসকে হটিয়ে বিজেপি মরিয়া হয়ে রেউড়ি বিলির প্রতিশ্রুতি দিলে তা-ও মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু মধ্যপ্রদেশে গত বিশ বছরের মধ্যে ১৮ বছর বিজেপি ক্ষমতায়, সেখানেও বিজেপি নিলামের মতো দর হাঁকছে। মহিলাদের ‘লাডলি বহেন’ যোজনায় কংগ্রেস মাসে এক হাজার টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলে বিজেপি তা বাড়িয়ে ১,২৫০ টাকা করেছে। কংগ্রেস দেড় হাজার বললে বিজেপি তিন হাজার দর হেঁকেছে। তার উপরে বিজেপি প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, মেয়েদের ২১ বছর বয়স হওয়া পর্যন্ত প্রত্যেককে মোট দু’লক্ষ টাকা দেওয়া হবে। মিলবে ই-স্কুটার। চাষিরা কেন্দ্রের থেকে বছরে ছ’হাজার টাকা পান। রাজ্য আরও ছ’হাজার দেবে। এ দিকে মধ্যপ্রদেশ সরকারের মাথায় সাড়ে তিন লক্ষ কোটি টাকা দেনা। গত ছয় মাসে শিবরাজ সিংহ চৌহানের সরকার দশ হাজার কোটি টাকা ঋণ করেছে।
ভোটের মুখে মোদী সরকার নিজেই রান্নার গ্যাসের দাম কমিয়েছিল। রাজস্থান, ছত্তীসগঢ়ে ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকার সিলিন্ডার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বিজেপি। রাজস্থানে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজে কথা দিয়েছেন, কংগ্রেস সরকারের যে সব জনমুখী প্রকল্প চলছে, বিজেপি ক্ষমতায় এলে তার কোনওটাই বন্ধ হবে না। আর ছত্তীসগঢ়ে গিয়ে তিনি নিজেই ঘোষণা করেছেন, কেন্দ্রে তাঁর সরকার আগামী পাঁচ বছর দেশের ১৪০ কোটি মানুষের মধ্যে ৮০ কোটি মানুষকে বিনামূল্যে রেশন বিলি করবে। এ যেন উলটপুরাণ। খয়রাতির বিরুদ্ধে সরব নরেন্দ্র মোদী এখন নিজেই খয়রাতি করছেন! তা-ও নিছক ভোটের দায়ে!
এই রাজনৈতিক ডিগবাজি অবশ্য নতুন নয়। নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় এসে জমি অধিগ্রহণ আইন থেকে কৃষি আইনে শিল্পের সুবিধামতো সংস্কারের পথে এগিয়েও পিছু হটেছেন। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে মোদী ভর্তুকির বহর, খয়রাতি নিয়ে মনমোহন সরকারকে নিশানা করতেন। ভর্তুকিকে ‘রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা’ তকমা দিয়ে মোদী আর্থিক শৃঙ্খলা ফেরানোর কথা বলেছিলেন। গদিতে বসে তিনিই ভাল ভর্তুকি, খারাপ ভর্তুকির ফারাক করেছেন। মনমোহন সরকারের শেষ বছরে কেন্দ্রীয় সরকারের ভর্তুকির বহর ছিল ২.২ লক্ষ কোটি টাকা। মোদী জমানায় গত অর্থ বছরে সেই ভর্তুকির বহর ৫.২১ লক্ষ কোটি টাকায় এসে পৌঁছেছে। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের আগেও তাঁর সরকার ভর্তুকির বহর বাড়িয়েছিল। গত অর্থ বছরেও মোদী সরকার বাজেটে খাদ্য, সার ও পেট্রোপণ্যের ভর্তুকিতে প্রাথমিক বরাদ্দের তুলনায় ৬৪ শতাংশ বেশি অর্থ খরচ করেছে।
আসলে কোথায় কল্যাণ অর্থনীতির শেষ, আর কোথায় খয়রাতির শুরু— রাজনীতিতে তার ফারাক করা কঠিন। প্রধানমন্ত্রী হয়ে নরেন্দ্র মোদী একশো দিনের কাজকে কংগ্রেসের ব্যর্থতার প্রতীক বলে কটাক্ষ করেছিলেন। কংগ্রেস দেশ স্বাধীন হওয়ার ৭০ বছর পরে মানুষকে গর্ত খুঁড়তে পাঠিয়েছে বলে কটাক্ষ করেছিলেন। পরে কোভিডের সময় সেই একশো দিনের কাজই গ্রামের গরিব, শহরের পরিযায়ী শ্রমিকের ভরসা হয়ে ওঠে। কোভিডের সময় মোদী সরকার নিখরচায় রেশন বিলি চালু করেছিল। মোদী সরকারের দশ বছরের রাজত্বের মধ্যে গত চার বছর ধরেই এই নিখরচায় রেশন বিলি করতে হচ্ছে। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরে ‘অমৃত কাল’-এ কেন দেশের মানুষকে সরকারি খরচে অন্ন জোগাতে হয়, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা জরুরি।
আসল কথাটি হল, দেশের অর্থনীতি এখন যে অবস্থায় রয়েছে, তাতে যে কোনও সরকারকেই সাধারণ মানুষকে একটা ন্যূনতম আয় জুগিয়ে যেতে হবে। সেটা মহিলাদের ক্ষমতায়নের নামে ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’, ‘লাডলি বহেন’ বা ‘গৃহলক্ষ্মী’ প্রকল্প হতে পারে। কিংবা কৃষকদের সুরাহার নামে ‘পিএম-কিসান’ বা ‘কৃষক বন্ধু’ প্রকল্প হতে পারে। মূল কথা আমজনতার হাতে নিয়মিত ভাবে কিছুটা নগদ টাকা তুলে দেওয়া। তার কারণ, দেশ জুড়ে আর্থিক অসাম্য ক্রমশ বাড়ছে। ধনীরা আরও ধনী, গরিবরা আরও গরিব হচ্ছেন— এ এখন আর কমিউনিস্টদের বাঁধা বুলি নয়, বাস্তব সত্য। দেশের মাত্র পাঁচ শতাংশ মানুষের হাতে ৬০ শতাংশ সম্পদ গচ্ছিত— অক্সফ্যাম-এর বহুচর্চিত রিপোর্ট তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। সরকারি পরিসংখ্যানে বেকারত্বের হার কমেছে। কিন্তু সেই পরিসংখ্যানই বলছে, নিয়মিত বেতনভুক চাকরিজীবীদের সংখ্যা কমছে। কাঁধে ব্যাগ নিয়ে স্কুটার-বাইকে চেপে ‘ডেলিভারি বয়’ বা ‘ক্যাব’-এর চালকের মতো কাজ বাড়ছে। সরকারি পরিসংখ্যানে মূল্যবৃদ্ধির হার কমছে। অথচ খাদ্যপণ্যের দামে লাগাম পরানো যাচ্ছে না। ফলে ধাক্কাটা গরিব মানুষেরই বেশি লাগছে।
এই পরিস্থিতিতে রাজ্য সরকারগুলি নানান খয়রাতির বন্দোবস্ত করছে। খোদ মোদীও তা অস্বীকার করতে পারছেন না। কারণ কংগ্রেস বা আঞ্চলিক দলগুলি বলছে, তাঁর সরকারের আর্থিক নীতির ফলেই আমজনতার দুর্দশা বেড়েছে, তাই সুরাহার বন্দোবস্ত করতে হচ্ছে। নরেন্দ্র মোদী তাকে ‘রেউড়ি’ বিলি বলে কটাক্ষ করলে কংগ্রেস নেতারা কর্পোরেট সংস্থার অনাদায়ি ঋণ নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। মোদী তাঁর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত শিল্পপতিদের রেউড়ি বিলি করছেন বলে অভিযোগ উঠছে। তাঁর গায়ে যাতে ‘স্যুট-বুট কি সরকার’ বা ‘আদানির বন্ধু’-র তকমা না লেগে যায়, তা নিয়ে সদা সচেষ্ট প্রধানমন্ত্রীকে তাই বিনামূল্যে রেশন বিলির পথ ধরতেই হচ্ছে। তা সে নির্বাচন থাকুক বা না-থাকুক।
এ দেশে নির্বাচনে জিততে প্রথম ‘রেউড়ি’ বিলি শুরু দক্ষিণ ভারতে। ১৯৬৭-তে ডিএমকে এক টাকা কেজি দরে চাল বিলির কথা ঘোষণা করেছিল। ডিএমকে ভেঙে বেরিয়ে এম জি রামাচন্দ্রন স্কুলে নিখরচায় মিড-ডে মিল চালু করেছিলেন। পরে এন টি রামা রাও অন্ধ্রপ্রদেশে তারই নকল করে দু’টাকা কেজি দরে চাল বিলি শুরু করেন। বছরে দু’কোটি চাকরি বা চাষিদের আয় দ্বিগুণ করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিতে ব্যর্থ মোদী সরকারকে বিনামূল্যে রেশন, বাড়ি, শৌচাগার সবই তৈরি করে দেওয়ার রাস্তা নিতে হয়েছে। কিন্তু বিজেপিকে টেক্কা দিতে কংগ্রেস, তৃণমূল, আপ সরকার বিদ্যুতের বিল অর্ধেক করে দেওয়া থেকে বেকার ভাতা, অর্ধেক দামে সিলিন্ডারের মতো জনমোহিনী পথ নিয়েছে।
সারা বছরই ভোট নিয়ে ‘রণং দেহি’ অবস্থানে থাকা নরেন্দ্র মোদীর বিজেপির পক্ষে ‘রেউড়ি’ বিলি থেকে বেরোনো খুবই কঠিন।