Society

ভিন্ন যৌনতার নির্বাচন

ভারতের মতো জনকল্যাণব্রতী রাষ্ট্র যদি তার সমাজের যৌনসংখ্যালঘু মানুষের নানা প্রকরণ ও জীবনধারার ভিন্নতাকে সম্মান না করে, তবে গণতন্ত্র বিঘ্নিত হয়।

Advertisement

ভাস্কর মজুমদার

শেষ আপডেট: ০৪ মে ২০২৪ ০৭:৫৮
Share:

—প্রতীকী ছবি।

সপ্তদশ লোকসভার শেষ অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাঁর সরকারের বিগত দশ বছরের সাফল্যের খতিয়ান তুলে ধরেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেছিলেন যে, তাঁর সরকার ‘ট্রান্সজেন্ডার’-দের জন্য অনেক ‘কাজ’ করেছে। সেই সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে উনি বার বার ‘ট্রান্সজেন্ডার’ শব্দটির উল্লেখ করে হয়তো বুঝিয়ে দিতে চাইছিলেন ভারতের যৌনসংখ্যালঘু মানুষ বলতে উনি বা ওঁর সরকার ঠিক কাদের চিহ্নিত করে থাকেন। এমনকি সম্প্রতি ভারতীয় জনতা পার্টি যে নির্বাচনী ইস্তাহার প্রকাশ করেছে, তাতেও ‘ট্রান্সজেন্ডার’ মানুষদের জন্য আরও কিছু আশ্রয়স্থল গড়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, আর কিছু নয়।

Advertisement

এটা দুঃখজনক। ভারত বলে নয়, সমগ্র পৃথিবীতেই যে-কোনও সমাজের প্রান্তিক যৌনগোষ্ঠীর মানুষেরা আসলে এক সমষ্টি। এই সমষ্টিতে সমকামী, উভকামী এবং রূপান্তরকামী মানুষেরা ছাড়া আরও অনেক ধরনের যৌনতার মানুষ আছেন। যৌনতা আসলে ব্যক্তিনির্ভর, কখনওই একরৈখিক নয়। কিন্তু সভ্যতার উষাকাল থেকে এই নানা রকম যৌনতার মানুষ সমাজে বাস করলেও তাদের উপস্থিতি সংখ্যাগুরু, বিসমকামী জনগোষ্ঠীর চাপে সব সময়ই কোণঠাসা থেকেছে। বিসমকামী যৌনতায় সন্তান-উৎপাদনের গুরুত্ব বেশি। তাকেই একমাত্র যৌনতা হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে চায় একাংশের মানুষ। তাই যারা এই যৌনতার অনুসারী নয়, তাদের ব্রাত্য করে রাখার চেষ্টা চলে। শুধুমাত্র যৌনতা নয়, সেই সব যৌনসংখ্যালঘু মানুষের লিঙ্গচেতনা, সামাজিক পরিচয়, সঠিক নাম-সর্বনামের চাহিদা, পোশাকপরিচ্ছদ ও সঙ্গী-নির্বাচনের স্বাধীনতা বিসমকামী-সমাজ আতশকাচের তলায় বার বার নিরীক্ষণ করে। সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের বাধ্য করা হয় ‘বিসমকামিতাই স্বাভাবিক’— এই ধারণা-আশ্রিত জীবনযাপনে অভ্যস্ত হতে। এ-বিষয়ের ইতিহাসের সাক্ষ্য তাৎপর্যপূর্ণ। ভুলে গেলে চলবে না, আজও বহু দেশে সমকামিতা-রূপান্তরকামিতার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড!

ভারতের মতো জনকল্যাণব্রতী রাষ্ট্র যদি তার সমাজের যৌনসংখ্যালঘু মানুষের নানা প্রকরণ ও জীবনধারার ভিন্নতাকে সম্মান না করে, তবে গণতন্ত্র বিঘ্নিত হয়। ট্রান্সজেন্ডার বা রূপান্তরকামী মানুষদের পাশাপাশি ভারতে যে সমকামী-উভকামী জনগোষ্ঠী আছে তার প্রতি কেন্দ্রের বিজেপি সরকার উদাসীন থেকেছে। শুধু তা-ই নয়, ২০১৮-তে সুপ্রিম কোর্ট ভারতের সংবিধান থেকে ৩৭৭ ধারা (ব্রিটিশ আমলের যে-আইনে দেশের সমকামী-উভকামী-রূপান্তরকামী জনগোষ্ঠী অপরাধী হিসেবে গণ্য হত) উৎখাত করেছিল, এবং কেন্দ্রীয় সরকারকে নির্দেশ দিয়েছিল দেশের যৌনসংখ্যালঘু মানুষদের বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে। তার পরও সরকার কোনও পদক্ষেপ করেনি। পাঁচ বছর পর ২০২৩ সালে সুপ্রিম কোর্টে সমকামী-উভকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের বিবাহ, পছন্দের সঙ্গীর সঙ্গে যৌথযাপন বা সন্তান-পালন বিষয়ে যে মামলা হয়, তাতে কেন্দ্রীয় সরকার বিবাদী পক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানটি কেবল সমাজের বিসমকামী জনতার জন্যই, বলেছিল সরকার। সমকামী মানুষদের জন্য বিবাহ এবং বিবাহজনিত সুযোগ-সুবিধে চালু হলে নাকি সমাজের পরিকাঠামোই ভেঙে পড়বে।

Advertisement

২০১৪ সালে সুপ্রিম কোর্ট নালসা রায় মারফত জানিয়েছিল যে, ভারতের যে-কোনও মানুষ চিকিৎসা বিজ্ঞানের কোনও রকম হস্তক্ষেপ ছাড়া নিজেকে রূপান্তরকামী ঘোষণা করতে পারবে। সুপ্রিম কোর্ট সরকারকে আদেশ করেছিল, রূপান্তরকামী মানুষদের জন্য সরকারি চাকরিতে আনুভূমিক সংরক্ষণ (হরাইজ়ন্টাল রিজ়ার্ভেশন) চালু করতে। দুটোর কোনওটাই হয়নি। রূপান্তরকামী মানুষেরা তাদের লিঙ্গপরিচয়ের জন্য দেশের নানা প্রান্তে আজও হেনস্থা-হিংসার শিকার হচ্ছে। সরকারি চাকরিতেই এখনও অবধি তাদের সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই। হিজড়ে পেশার ব্যক্তিদের পাশাপাশি বহু রূপান্তরকামী মানুষই ভারতে মারাত্মক নিপীড়িত। কর্মক্ষেত্রে ও সমাজমাধ্যমে রূপান্তরকামী মানুষদের প্রতি ঘটে চলা মানসিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে কোনও বিধি নেই। লিঙ্গ-নিরপেক্ষ টয়লেট অপ্রতুল। শুধুমাত্র লিঙ্গপরিচয়ের জন্য কত রূপান্তরকামী মানুষ ঘরভাড়া পর্যন্ত পায় না এ দেশে! কী অর্থে কেন্দ্রীয় সরকার এই জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়িয়েছে? সবচেয়ে বিপজ্জনক প্রবণতা সমগ্র যৌনসংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে একে অপরের থেকে পৃথক করার প্রয়াস। রূপান্তরকামী মানুষদের তথাকথিত সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে সরকারি ভাবে দাবি করা হচ্ছে, অথচ একই সরকার সমকামী-উভকামী গোষ্ঠীর মানুষদের যত রকম ভাবে সমাজে দম বন্ধ করার ব্যবস্থা করা যায়, তার চেষ্টা করে চলেছে। সরকার ভারতের জনগণের লিঙ্গ-যৌনতার ভিন্নতাকে গ্রাহ্যই করছে না।

লোকসভা ভোট চলছে। ভারতীয় জনতা পার্টি তাদের নির্বাচনী-ইস্তাহারে দেশের সমকামী-উভকামী-রূপান্তরকামী গোষ্ঠীর উন্নতিকল্পে তেমন কোনও প্রতিশ্রুতি না দিলেও বিভিন্ন বিরোধী দল (যেমন কংগ্রেস ও সিপিএম) এই জনগোষ্ঠীর বিবাহ, সন্তানপালন, সঙ্গী-নির্বাচন ও তাদের প্রতি ঘটে চলা হেনস্থা-হিংসা বিরোধী আইন প্রণয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সরকারে যে-ই আসুক না কেন, সবাইকেই মনে রাখতে হবে যে, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষেরা যে-কোনও রাষ্ট্রের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। ভারতে ধর্মের, জাতির, বর্ণের ভিন্নতা নিয়ে যদি সকলে সমানতার ধারণায় বাস করতে পারে, ভিন্নতর লিঙ্গ-যৌনতার মানুষকেই বা ব্রাত্য করে দূরে রাখা হবে কেন?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement