আন্তর্জাতিক কূটনীতিকে ভোটের আগে কাজে লাগানোর ছক
International Diplomacy

মনে যে আশা লয়ে

সেপ্টেম্বরের দু’মাসের মধ্যে ফের আরও একটা মহাবৈঠক করার কি সত্যিই প্রয়োজন ছিল? জি২০-তে বছরে একটির বেশি সম্মেলন যে আগেও হয়েছে এমনটা মনে করিয়ে দিচ্ছে বিদেশ মন্ত্রক।

Advertisement

অগ্নি রায়

শেষ আপডেট: ২০ নভেম্বর ২০২৩ ০৭:৩৪
Share:

অতঃপর? বোমাবর্ষণে গৃহহারা শিশুরা আশ্রয় নিয়েছে শিফা হাসপাতালের মাটিতে, গাজ়া, ৫ নভেম্বর। রয়টার্স।

সেপ্টেম্বরের সেই মধুমাসে সবই ছিল প্রদীপ্ত। ভারতমণ্ডপমে জি২০ মঞ্চে গোটা বিশ্বের মুখিয়া হিসাবে উজ্জ্বল ভারত। উন্নত, উন্নয়নশীল, গরিব দক্ষিণ বিশ্ব সমস্ত দেশের সঙ্কটে বিশল্যকরণীর আবিষ্কারক সে। এক দিকে ‘গণতন্ত্রের জননী’, অন্য দিকে ‘বিশ্বের ঔষধালয়’। 'বিশ্বগুরু' জানিয়েছেন, এই কালখণ্ড যুদ্ধের নয়, পশ্চিম গোলার্ধ তাতে পরম প্রসন্ন। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে সাউথ ব্লকের নেওয়া মধ্যমপন্থী নীতি তথা সরু দড়ির উপর দিয়ে ব্যালে, মোটের উপর চোখসই হয়ে গিয়েছে আন্তর্জাতিক বলশয়ের। তদুপরি চিড় খাওয়া বিশ্ব ব্লককে এক করে জি২০-র প্রথম দিনেই হয়ে গিয়েছে যৌথ বিবৃতি। তাতে সই করে রাশিয়া এবং আমেরিকা সংস্কারী নিরামিষে মধ্যাহ্নভোজন করেছেন স্কচ ও ভডকা ভুলে, ডাবের জল সহযোগে! বিলাসবহুল মিডিয়া সেন্টারে বসে আমরা যখন এ-হেন আনন্দভৈরবী শুনছি, প্রধানমন্ত্রী তাঁর সমাপন বক্তৃতায় একটু অভিনব ভাবেই ঘোষণা করলেন, এ দেখাই শেষ দেখা নয় তো! অর্থাৎ, নিয়মমাফিক আসছে বছরে না, এ বছরেই আবার হবে জি২০। নভেম্বরের শেষে ভারতের সভাপতিত্বের মেয়াদ ফুরোনোর আগেই জি২০ ফের বসবে। তবে এ বার ভিডিয়ো মাধ্যমে।

Advertisement

তিনি বিশ্বগুরু হতে পারেন, কিন্তু দিব্যদ্রষ্টা তো নন। আর তিনি কেন, ওই মঞ্চে উপস্থিত তাবড় কোনও নেতাই ভাবতে পারেননি আর দু’মাসের মধ্যে কী ভয়াবহ নৃশংসতার মুখোমুখি হবে পশ্চিম এশিয়া। প্যালেস্টাইনে শিশুমেধ যজ্ঞ হয়ে উঠবে দৈনন্দিন নামচা। হামাসের শঠ, নিষ্ঠুর পদক্ষেপে আগুন লাগবে গোটা অঞ্চলে। যার ফল ক্রমশ প্রসারিত হবে সুদূরে।

এ নাহয় গোটা বিশ্বের সঙ্কট। কিন্তু কানাডার মতো অতি শক্তিশালী, আমেরিকার পরম সুহৃদ, জি২০-র অন্যতম সদস্য— তার সঙ্গে যে একেবারে কলতলার পর্যায়ে পৌঁছে যাবে ভারতের কোন্দল, এই আঁচও তখন পায়নি সাউথ ব্লক? কিন্তু পাওয়ার কথা ছিল, নয়াদিল্লিতে সেই সময়ের অতিথি কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর আচরণ ও দেহভাষায়। এর পর যশোভূমিতে সাড়ম্বরে জি২০-ভুক্ত দেশগুলির সংসদীয় অধ্যক্ষদের মহাসম্মেলন পি২০-র আয়োজনে কানাডা প্রতিনিধি পাঠাল না। সেটাও আগেই বোঝা উচিত ছিল, যদিও সাংবাদিক সম্মেলনে আশা প্রকাশ করে স্পিকার ওম বিড়লা জানিয়েছিলেন, কানাডার স্পিকার অবশ্যই আসবেন। কানাডার উপর ভারতের বাণিজ্য, শিক্ষা-পাঠক্রম, কর্মসংস্থান সংক্রান্ত নির্ভরতা তো বড় কম নয়। খলিস্তানি কাঁটা সামলাতে আরও কত দিন অপেক্ষা করতে হবে, তা অনির্দিষ্ট।

Advertisement

সেপ্টেম্বরের দু’মাসের মধ্যে ফের আরও একটা মহাবৈঠক করার কি সত্যিই প্রয়োজন ছিল? জি২০-তে বছরে একটির বেশি সম্মেলন যে আগেও হয়েছে এমনটা মনে করিয়ে দিচ্ছে বিদেশ মন্ত্রক। ২০২১ সালে ইটালিতে একটি বাড়তি সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল। তবে সেটি ছিল আপৎকালীন। আফগানিস্তান, তালিবান দখল করে নেওয়ার পর, কাবুল পরিস্থিতি নিয়ে। সরকারের এক কর্তার মতে, ভিডিয়ো মাধ্যমে এই সম্মেলনটির মাধ্যমে সব দেশই সুযোগ পাবে সেপ্টেম্বরে বৈঠকে যে প্রস্তাব এবং সুযোগগুলি তৈরি করা হয়েছে সেগুলিকে আর এক বার খতিয়ে দেখার। ভারত উন্নয়নের যে কর্মসূচি সামনে নিয়ে এসেছিল, সেটিকেও পাখির চোখ করা হবে। যেটা বলা হচ্ছে না, মনে এই আশাও ছিল বিজেপির যে, লোকসভার কিছু আগে ভারতকে (বিজেপি সরকারকে) আবার জগৎসভার শ্রেষ্ঠ আসনে দেখানো যাবে। তাতে ভোটের খেতে ফলন মন্দ হয় না।

কিন্তু এখন কী দাঁড়াচ্ছে? ইজ়রায়েল-হামাস যুদ্ধকে ঘিরে আন্তর্জাতিক সংঘাত যে দিকে এগোচ্ছে, সেটাও তো আপৎকালীন। ধারে ভারে ও বিপদে সেটা তালিবানের কাবুল দখলের চেয়ে অনেক অনেক বেশি রক্তাক্ত। তা হলে ভারত কি আসন্ন জি২০ ভিডিয়ো সম্মেলনটির কেন্দ্রীয় থিম করবে? কী ভাবে সম্ভব? স্পষ্ট ইজ়রায়েলপন্থী নীতি নেওয়ার জন্য প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়েছে মোদীর বিদেশনীতি। পশ্চিমের প্রতি চাটুকারিতা তার কারণ হোক অথবা আন্তর্জাতিক মুসলিম বিদ্বেষের পালে হাওয়া দিয়ে ঘরোয়া রাজনীতিতে লক্ষ্মীলাভ— এই মুহূর্তে বিশ্বগুরুর বিদেশনীতিকে কিছুটা কি দিশাহীন লাগছে না? শ্যাম এবং কুল, দুই রাখতে গিয়ে বিহ্বল রাধাদশা তার। এই মুহূর্তে প্রধান আক্রমণকারী ইজ়রায়েলের বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব আনা দূরস্থান, রাষ্ট্রপুঞ্জের যুদ্ধবিরতি তথা শান্তির প্রস্তাবেও ভোট দিচ্ছে না মোদী সরকার। অথচ দু’দু’বার দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ইজ়রায়েলপন্থী বিবৃতি দেওয়ার পরই বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র জানাচ্ছেন, সব কিছুর পরেও সার্বভৌম, স্বাধীন প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র গড়ার পক্ষে ভারত। দ্বিরাষ্ট্রীয় তত্ত্বেই ভারত বিশ্বাসী। এই প্রশ্ন তখন অনিবার্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে, অসহায় শিশু, হাসপাতাল নাগরিকদের উপর অবিরাম বোমা বিস্ফোরণে যদি আমার সায় থাকে (এ ক্ষেত্রে বিরোধিতা না করাটা সম্মতিরই সূচক ধরে নিতেই হচ্ছে দুর্ভাগ্যজনক ভাবে), তা হলে একই সঙ্গে আমি ওই শিশুর পাশে দাঁড়াবার কথা বলছি কী করে? ব্যাপারটা সোনার পাথরবাটি হয়ে গেল না ধর্মাবতার?

আসলে আরব বিশ্বকে সঙ্গে রাখতে ‘ইতি গজ’-র মতো প্রতিটি ইজ়রায়েল প্রণতির সঙ্গে একটি করে প্যালেস্টাইনের ‘আশা আকাঙ্ক্ষা’র কথা গুঁজে দেওয়া হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু নিন্দুকে তো বলবেই যে, ভোট বড় বালাই! ভোটে না জিতলে কিসের বিশ্ব আর কিসের গুরু? এখানে সত্যের বা ধর্মের বিশেষ জায়গা নেই। যে সত্যের ধর্মকে ‘মানুষের ধর্ম’ হিসাবে বর্ণনা করে রবীন্দ্রনাথ বলেন, “যুদ্ধকালে যে মানুষ রথে নেই, যে আছে ভূতলে, রথী তাকে মারবে না।... যে ঘুমচ্ছে, যে বর্মহীন, যে নগ্ন, যে নিরস্ত্র, যে অযুধ্যমান, যে যুদ্ধ দেখছে মাত্র, যে অন্যের সঙ্গে যুদ্ধে প্রবৃত্ত, তাকেও মারবে না। যার অস্ত্র গেছে ভেঙে, যে শোকার্ত, যে পরিক্ষত, যে ভীত, যে পরাবৃত্ত, সত্যের ধর্ম অনুসরণ করে তাকেও মারবে না।”

হিন্দুত্ববাদীদের জেনে রাখা বিধেয় যে, এই ধর্ম আকাশ থেকে আমদানি করেননি রবীন্দ্রনাথ তাঁর ওই প্রবন্ধে, উপনিষদকে ব্যাখ্যা ও তর্জমা করতে করতেই যা বলার বলেছেন। আপাতত সে সব চুলোর দুয়ারে দিয়ে নগ্ন নিরস্ত্র অপাপবিদ্ধ শিশুমেধকে সমর্থন করছে যে নীতি, তা হয়তো আমেরিকাকে খুশি করবে। হোয়াইট হাউসের চোখ রাঙানি সত্ত্বেও রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠতার দুঃসাহসকে ক্ষমাসুন্দর করবে। হামাসের সন্ত্রাস এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্রের আন্তঃসীমান্ত জঙ্গিপনাকে এক বন্ধনীতে নিয়ে এসে গুজরাত উত্তরপ্রদেশের প্রত্যন্ত গ্রামে হিন্দুত্বের মশাল জ্বালবে। কিন্তু পশ্চিম এশিয়ার সঙ্গে দীর্ঘলালিত সখ্য (যার কৃতিত্ব অনেকটাই দেওয়া চলে নরেন্দ্র মোদীকে), আন্তর্জাতিক রণনীতিতে দরকষাকষির জন্য নিরপেক্ষ ভাবমূর্তির বর্ম, বাণিজ্যিক ও শক্তির এই অনটনের দিনে বন্ধু হারানোর ত্রাস— উঠে আসছে এমন অনেক সম্ভাবনাই।

নাহ্, জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন দূরস্থান। আন্তর্জাতিক নাট্যমঞ্চে স্বস্তিতেও আর থাকতে পারছে না সাউথ ব্লক।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement