সে রাতে গ্রামে যখন পুলিশ ঢুকল, বুধেশ্বর তখন বাড়ির দাওয়ায় বসে লণ্ঠনের আলোয় পড়ছিল। লালগড় কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিল একুশ বছরের বুধেশ্বর। পুলিশ খুঁজছিল বুদ্ধদেব মাহাতোকে। কিন্তু বুধেশ্বর মাহাতোকে নিয়ে গেল। থানায় লেখা হল, বুদ্ধদেব ওরফে বুধেশ্বর। আজ বুধেশ্বরের বয়স ৩৪ বছর, রয়েছে শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালের কোভিড ওয়ার্ডে। যদি বাঁচে, ফিরে যাবে প্রেসিডেন্সি জেলে। আবার শুরু হবে আদালতের তারিখের অপেক্ষা। আজও প্রমাণ হয়নি, বুধেশ্বরই কি বুদ্ধদেব?
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তৃতীয় বার জিতে ক্ষমতায় এলেন। কিন্তু লালগড়ে পুলিশি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আন্দোলনে যুক্ত অন্তত ৫০ জন আদিবাসী তরুণ সেই ২০০৯ থেকে ‘বিচারাধীন’। রিজওয়ানুর রহমানের অস্বাভাবিক মৃত্যুতে মা কিশওয়ার জাহানের ‘মুঝে ইনসাফ চাহিয়ে’ মনে আছে? ২০০৭ সালের সেই ঘটনার বিচার এখনও চলছে। অধরা ইনসাফ। রাজনৈতিক দল বদলে গিয়েছে, কিন্তু বামফ্রন্ট আমলের বহু রাজনৈতিক বন্দি এখনও কারারুদ্ধ। সারা দেশেই জেলবন্দিদের প্রায় ৭০ শতাংশ বিচারাধীন। অর্থাৎ, বছরের পরে বছর বিনা বিচারে জেলে পচছেন।
তার অন্যতম কারণ, যথেষ্ট বিচারপতি নেই। সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতির পদ মাত্র ৩৪। তার মধ্যেও সাতটি আসন এখন শূন্য। হাই কোর্টগুলিতে মোট বিচারপতি থাকার কথা ১০৮০ জন, তার ৪২০টি পদ শূন্য। নিম্ন আদালতগুলোতে চার জন বিচারকের এক জন নেই। উন্নয়নের পরিকল্পনায় কোনও দিনই বিচারব্যবস্থা বিশেষ জায়গা পায়নি। ১৯৮৭ সালে আইন কমিশনের সদস্যরা বলেছেন, ব্রিটিশ সরকার পরিকল্পিত ভাবে খুব কম বিচারপতি রেখে বিচারব্যবস্থা পরিচালনা করত। স্বাধীনতার পরে সেই ব্যবস্থাটাই চালিয়ে যাওয়া হয়েছে। নতুন নতুন অপরাধ, নতুন নতুন আইন তৈরি হয়েছে, কিন্তু সে অনুযায়ী আদালত তৈরি, বিচারক নিয়োগ করা হয়নি। আইন কমিশন সুপারিশ করেছিল যে, প্রতি ২০,০০০ মানুষে অন্তত এক জন বিচারপতি থাকা উচিত। দশ বছরের মধ্যে সব পদ পূর্ণ হোক। ২০১৪ সালে আইন কমিশন ফের সুপারিশ করে, তিন বছরের মধ্যে সমস্ত শূন্য পদ পূরণ করা হোক। বিচারকদের অবসরের বয়স বাড়িয়ে, সকালে এবং বিকেলে স্পেশাল কোর্ট চালু করে, উপযুক্ত পরিকাঠামো নির্মাণ করে বিচারব্যবস্থার উন্নয়ন করা হোক। তৎকালীন কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ সে দিন সাংবাদিক সম্মেলন করে বলেছিলেন যে, তাঁরা কমিশনের সুপারিশ কার্যকর করবেন।
কিন্তু বিচারপ্রার্থীরা সেই তিমিরেই, বরং অন্ধকার আরও গাঢ় হয়েছে। একটি অসরকারি সংস্থার ইন্ডিয়া জাস্টিস রিপোর্ট (২০২০) বলছে, ভারতে ৫০,০০০ মানুষ প্রতি এক জন বিচারপতি আছেন। আইন কমিশনের প্রস্তাবিত অনুপাতের অর্ধেকেরও কম। হাই কোর্টে মোট সংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ পদ শূন্য। নিম্ন আদালতে এক-চতুর্থাংশ পদ শূন্য। তার সঙ্গে রয়েছে পরিকাঠামোর অভাব— ১৪ শতাংশ বিচারকের বসার কোনও ঘর নেই। সব পদ পূর্ণ হলে ১৮ শতাংশ বিচারকের বসার জায়গাই থাকবে না, ৩৩৪৩টি ঘর কম পড়বে। হাই কোর্টে মামলা ঝুলে আছে চুয়াল্লিশ লক্ষ। বছরে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা গড়ে দশ শতাংশ করে বাড়ছে। নিম্ন আদালতে বকেয়া মামলার সংখ্যা প্রায় তিন কোটি। গড়ে একটি মামলার বিচারের সময় লাগছে তিন বছর।
সুপ্রিম কোর্টের এক প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি সম্প্রতি এক বক্তৃতায় বলেছেন, এ দেশের সরকার পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির স্বপ্ন দেখছে, অথচ দেশের বিচারব্যবস্থা ভেঙে পড়ার মুখে। তাঁর মতে, বিচারব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার ছাড়া স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে। মামলায় দীর্ঘ বিলম্ব বিনিয়োগকারীরা কিছুতেই মেনে নেবেন না।
সারা দেশের চাইতেও খারাপ পশ্চিমবঙ্গের হাল। রাজ্যের প্রতি এক লক্ষের উপর মানুষের জন্য রয়েছেন এক জন মাত্র বিচারপতি। পাঁচ বছরের উপর ঝুলে রয়েছে, এমন মামলার সংখ্যা অন্য রাজ্যের থেকে অনেক বেশি। হাই কোর্টের বিচারপতির পদ শূন্য থাকার সময়ও দীর্ঘ। বিচারব্যবস্থার জন্য সরকারি ব্যয়ের পরিমাণ, বিচারপতি ও আদালত কর্মিসংখ্যা, পরিকাঠামো, কাজের চাপ, পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকা, জেলব্যবস্থা ও বিনামূল্যে আইনি সহায়তা— সমস্ত দিক বিবেচনা করে ওই রিপোর্ট বলেছে, এ দেশে বড় রাজ্যগুলির মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ অনেক পিছিয়ে।
প্রাক্তন ওই বিচারপতি ক্ষোভের সঙ্গে বলেছিলেন, “কে যায় আদালতে! কী লাভ আদালতে গিয়ে!” যাঁরা কোনও দিন আদালতে যান না, তাঁদের এক জন বুধেশ্বরের মা। ছেলে কখনও ছাড়া পাবে, সে ভরসা করেন না। আর ছেলের করোনা হয়েছে শুনেই বুঝে গিয়েছেন, ছেলে আর নেই। করোনা হলে লোকে বাঁচে নাকি? নিজের চোখে ছেলেকে না দেখলে বিশ্বাস হবে না তাঁর। কী করে ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ ছেলেকে এক বার চোখের দেখা দেখতে পারেন মা, আপাতত তার তোড়জোড় চলছে।