এক রূপের বিরুদ্ধে টিকা অন্য রূপের বেলায় কাজে লাগে না, আর টিকার কার্যকালের মেয়াদও দীর্ঘস্থায়ী হয় না। প্রতীকী ছবি।
বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যজ্ঞানীদের মুখে ছাই দিয়ে চিন দেশে নাকি ‘আবার সে এসেছে ফিরিয়া’। তাই ভস্ম থেকে মুখ বাড়িয়ে দেশবাসীর প্রতি আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রকের হুঁশিয়ারি চিঠি: যে তরিকায় আমরা করোনাভাইরাসের জয়যাত্রা রুখে দিয়েছিলাম তা পুনরায় চালু করতে হবে। ভাইরাসের পদাঙ্ক অনুসরণ, চিকিৎসা, টিকা এবং ‘কোভিডোপযোগী বিধিনিষেধ’— এই তরিকাগুলিই নাকি আমাদের সাফল্যের চাবিকাঠি। অধিকন্তু, ভাইরাসের নবতম প্রজন্মকে শনাক্ত করতে জিন পরীক্ষার উপরেও এ বার জোর দেওয়া হবে।
১৯৭৫ সাল থেকে বছর দুয়েক যাবৎ আমরা এক অনুশাসন পর্ব দেখেছিলাম; তাতে মর্মাহত হয়েছি, বিস্মিত হইনি। দ্বিতীয় অনুশাসন পর্বও বছর দুয়েক ধরেই, ২০২০ থেকে; আমাদের ধন গেল, মান গেল, প্রাণও। তবুও স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের মোড়কে এক মায়াবিনী বিস্ময় যেন আমাদের আচ্ছন্ন করে রাখল। দৃঢ়চেতা শাসক নাগরিক চৈতন্যকে নিরুদ্বেগ থাকতে দেবে না। তাই পুনরায় অনুশাসনের বার্তা। যে সব তরিকার পুনরভিযান নিয়ে কথা উঠছে তার প্রায় কোনওটাই যে যুক্তিসম্মত না, বরং জনসমাজ আর জনমানসের পক্ষে ক্ষতিকর, ইত্যবসরে তা নিয়ে নানা মহল উপযুক্ত প্রমাণ দাখিল করেছে। ও-সব আমাদের দেশের মোড়ল পণ্ডিতরা অকাতরে অগ্রাহ্য করেছে। তার বদলে কল্পবাদী আচারপ্রিয়তাকেই বিজ্ঞানের আসনে বসিয়ে তারা এখন পুরনো ভাইরাসের নতুন রূপ দেখে সহসা সচকিত।
অথচ, সরকারি সংস্থাই (আইসিএমআর) আমাদের জানিয়েছিল, ২০২১-এর জুন মাসেই দেশের প্রায় ৬৮ শতাংশ মানুষের শরীরে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে সহজ নিরোধক শক্তির (ইমিউনিটি) উন্মেষ ঘটে গিয়েছে— টিকার কারণে মোটেই না, বরং সংক্রমণের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়। একই সময়ে মান্য পত্রিকায় হিসাব দেখানো হয়েছিল যে, লোকলশকর আর যন্ত্রপাতি নিয়ে ভাইরাসকে ধাওয়া করে, অমেয় পরিশ্রম আর বিপুল অর্থের শ্রাদ্ধ করে মাত্র চার শতাংশ সংক্রমণ আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছিল। উপরন্তু, বাজে খরচের ওই খেরোর খাতা খুলে দেখা যাচ্ছে, লোকস্বাস্থ্যের উন্নতিকল্পে বেপরোয়া রণোৎসাহীরা ছিল পাগলপ্রায়। তাতে নাগরিকমনে ভাইরাসের কলঙ্কচিহ্ন বয়ে বেড়ানোর শঙ্কা বেড়েছে, বিভ্রান্তি গগনচুম্বী, জনসমাজে মর্মান্তিক দুর্দশা। পৃথুলতাকে বাদ দিলে, করোনা সংক্রমণে মৃত্যুর পিছনে এই শঙ্কা, বিভ্রান্তি ও দুর্যোগই ছিল প্রধানতম ঝুঁকি। এ কথা প্রকাশিত হয়েছিল আমেরিকার ‘সিডিসি’ অনুমোদিত জার্নালে।
সেই সঙ্গে ব্যাপক নিরীক্ষণ চালিয়ে জানা গেল, আমাদের দেশে করোনাভাইরাসে মৃত্যুহার ০.০৫ শতাংশ মাত্র। অন্য একটি দেশীয় গবেষণা-পত্রিকা বলল, মৃত্যুহার ০.১৭ শতাংশ। লোকস্বাস্থ্য নিয়ে নিবিড় অনুশীলকরা জানেন, বারংবার রূপ আর চরিত্র বদল করা (মিউটেশন) করোনাভাইরাসের স্বাভাবিক গুণ। তাদের বিরুদ্ধে টিকা নির্মাণ সম্ভব, কিন্তু তা যথেষ্ট কার্যকর হয় না, এক রূপের বিরুদ্ধে টিকা অন্য রূপের বেলায় কাজে লাগে না, আর টিকার কার্যকালের মেয়াদও দীর্ঘস্থায়ী হয় না। এমনকি, উন্নত প্রযুক্তির দোহাই দিয়ে ম্যাজিক দ্রুততায় হন্তদন্ত হয়ে নতুন টিকা বানিয়ে ফেললেও তা ক্ষীণজীবী, নিরাপত্তায় নাচার; তাই ব্যর্থ হতে বাধ্য। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বয়ানবিলাসী মুখপাত্রদের কাছেও এ সব তত্ত্ব আর তথ্য অজানা নেই; কিন্তু কে না জানে, পরিপুষ্ট পদাধিকার ও প্রাপ্তির ব্যঞ্জনায় চেতন শ্বাসরুদ্ধ থাকে।
লোকমনে স্বাভাবিক চেতনা জাগিয়ে তুলতে প্রথিতযশা লোকস্বাস্থ্যবিদরা চেষ্টার কসুর করেননি। কিন্তু করোনাভাইরাসের বিধ্বংসী ক্ষমতা এই দেশে সত্যিই কতটুকু, তার বিরুদ্ধে সহজ নিরোধক শক্তির প্রবল আবির্ভাব এবং অযুত নাগরিকের অযথা মৃত্যুর পিছনে বিচারমূঢ়তা কতটা দায়ী, এই সব প্রাসঙ্গিক আলোচনা শাসকবর্গ উপেক্ষা করেছে। ও-দিকে প্রতিষ্ঠানের চার ধারে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তাবলয় রচনার কাজে ভদ্রবিত্ত, বিজ্ঞানকাতর, জিন শিকারে নিবেদিতপ্রাণ বুদ্ধিজীবীদেরপরিত্রাহী কলরব। লোকমনে আতঙ্ক রচনার এমন নষ্ট প্রয়াসে আন্তর্জাতিক শ্রেষ্ঠী-গোষ্ঠী উৎফুল্ল, কেননা কিছু কালের মধ্যে লোকস্বাস্থ্যের ইতিহাসসিদ্ধ, অধীত জ্ঞান প্রত্ন-অবস্থান লাভ করল। রবীন্দ্রনাথ পড়ে তারা জানত, ‘সেই সত্য যা রচিবে তুমি’! এখন তাই সওদাগরি জীববিদ্যাই জায়েজ, ধুরন্ধর শ্রেষ্ঠীপতিই লোকস্বাস্থ্যের গতিবিধির হদিস জানাবেন। ব্যতিব্যস্ত নাগরিকবর্গ তাই এখন বেজায় উৎকণ্ঠায়, রসদ জুটিয়ে বিজ্ঞজন বুঝি পুনরায় লম্ফমান হবেন।
দক্ষিণ আফ্রিকায় ‘ওমিক্রন’-এর আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে অতিমারিচর্চার মোড় ঘুরেছিল, স্বস্তির পথে। এমনকি, আজকের দুনিয়ায় টিকাচূড়ামণি, গেটস সাহেবও স্বীকার করে নিলেন, ‘দুঃখজনক’ হলেও এ কথা সত্যি যে, ইমিউনিটি তৈরির কাজে টিকার চেয়ে ওমিক্রন সংক্রমণই বেশি মূল্যবান। ইউটিউব-এর কল্যাণে সে কথা আমরা শোনার আগেই অবশ্য ইজ়রায়েলের বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন, সংক্রমণ থেকে পাওয়া সেই প্রাকৃতিক শক্তি টিকা-নির্মিত শক্তির চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতাশালী। তার উপর, সেই ইমিউনিটি ভাইরাসের নবতম প্রজন্মের উপর কার্যকর; তুলনায় টিকা সর্বদা এক প্রজন্ম পিছিয়ে থাকে। ভাইরাস-বিজ্ঞানের এই গতিশীলতাই আমাদের দেশের লোকজনকে বাঁচিয়েছে; নইলে জনঘনত্ব বিচার করলে ভাইরাস দংশনে এই দেশ প্রায় মৃত্যুপুরী হয়ে যেত। যে ভাইরাস মারাত্মক সে ক্ষণজীবী হবে; দীর্ঘজীবী হতে গেলে তার পক্ষে মিউটেশন অনিবার্য।
কিন্তু ডারউইনের সূত্র আতঙ্কবাদীরা মনে রাখে না, তাই জঙ্গিপনা চলতে থাকে— তাদের নির্দেশে দক্ষিণ আফ্রিকা হয়ে যায় নিষিদ্ধপল্লি যেন। তাতে ওমিক্রন-এর বিস্তার কমে না, কিন্তু ওই দেশের অর্থনীতি জখম হয়। আতঙ্ক জিইয়ে রাখতে পারলে শাসকের পোয়াবারো। যুক্তিহীন আইন প্রণয়ন, বিরোধীদের ঠেকিয়ে রাখা, অন্যায় ব্যবসাকে তোল্লাই দেওয়া, ভাইরাসের নতুন প্রজন্মের উপর জিনসিদ্ধ নজরদারির মতো ব্যর্থ অথচ বহুল ব্যয়সাপেক্ষ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়া, জনস্বার্থের বনিয়াদি দায়িত্বগুলি থেকে চোখ সরিয়ে অবান্তর কর্মযোগ সহজ হয়ে যায়। ভাইরাসের উপর জিনসিদ্ধ নজরদারি চালিয়ে নতুন মিউটেশন আবিষ্কার করা সম্ভব; কিন্তু এ-ও অমোঘ সত্যি যে, আবিষ্কারের আগেই পরজীবীটি ছড়িয়ে পড়েছে লোকসমাজে, নিভৃতে, অজানতে। তাই নতুন জ্ঞানে উদ্বুদ্ধ হয়ে লোকসমাজে আতঙ্ক ছড়ানো এক আধুনিক মূর্খামি। জিনচর্চা দরকারি, কিন্তু তার ভিত্তিতে সমাজ সংস্কার এক ভয়ঙ্কর ভ্রান্তি।
কাণ্ডজ্ঞানে ঋদ্ধ জনসমাজ জানে, আমাদের দেহপ্রকৃতিতে বিচিত্র খেলা চলে অনিবার, বাহ্যপ্রকৃতিতেও। দুই খেলারই লক্ষ্য, ভারসাম্য রচনা— প্রাণের যাবতীয় উপাদান আর প্রাকৃতিক সম্ভারের মধ্যে ভারসাম্য। ছদ্ম আধুনিকতার নেশায় আর পেশায় মত্ত আমরা ওই দুইয়ের সমন্বয় করার বুদ্ধি ভুলেছি। দরকার ছিল ব্যাধি নিবারণের; তার বদলে জ্ঞানের গর্ব কাঁধে নিয়ে আমরা ব্যাধি আবিষ্কারে মন দিয়েছি। দরকার ছিল স্বাস্থ্যব্যবস্থার বনিয়াদি উপকরণগুলো গুছিয়ে রাখা, তার বদলে আমাদের মন চলে গিয়েছে নকলনবিশিতে। নইলে কোভিড-অতিমারির দ্বিতীয় দফায় আমাদের স্বাস্থ্য পরিষেবার উলঙ্গ দশা দেখতে হত না। লোকসমাজের কল্যাণকল্পে আমরা এমন-এমন নিয়ম আর বিধি রচনা করি যা শেষ বিচারে সর্বনেশে বলে প্রতিপন্ন হয়।
তাই মিউটেশন শুনলেই উৎকণ্ঠা! যোগ্যতর হয়ে বাঁচতে গেলে, প্রকৃতির বিচারে মিউটেশন যে অতি প্রয়োজনীয়, স্বাভাবিক ঘটনা, এই সহজ জ্ঞান যারা ভুলিয়ে দিতে চায় তাদের একটি লক্ষ্য আছে, নিশ্চয়ই। সমাজতাত্ত্বিকদের সঙ্গে সাধারণ নাগরিকও তা বুঝে নেবেন, ক্রমে। তবে ‘নতুন বিশ্ব’ রচনার এই সন্ধিক্ষণে এক উৎকৃষ্ট ঘটনা— পর্তুগিজ লেখক রুই জ়িঙ্ক লিখে ফেলেছেন ম্যানুয়েল দু বোঁ ফাসিস্তা— ‘ভাল ফ্যাসিস্ট হওয়ার সহজ উপায়’। শাসকের ধ্যান-জ্ঞান বুঝি এখন ও-দিকেই, তাই তার কাছে আর তেমন কোনও দাবি রাখি না। তবে তার পাশে দাঁড়ানো, বিজ্ঞানের বীণা হাতে নারদকুলের দিকে তাকালে মনে হয়, ‘মগজ বিকিয়ে দিয়ে পরিতৃপ্ত পণ্ডিত সমাজ।’