গত বছর করোনাভাইরাস রাজ্যে ঢুকে পড়ার পরই প্রবল সক্রিয় হয়েছিল রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতর। তখন সরকার কঠিন যুদ্ধের মধ্যে স্বাস্থ্যকর্মীদের সমন্বয়ের জরুরি কাজটা সামলাত। এ বার রাজ্যে সরকার কোথায়, ফেব্রুয়ারি-মার্চে ভোটের ধামাকায় বোঝাই যায়নি। অন্য রাজ্যগুলোতে যখন করোনা-বহুরূপী ঝাঁপিয়ে পড়ছে প্রবল বিক্রমে, প্রশাসন তখনও ভোটমগ্ন, সংবাদমাধ্যমও প্রায় তাই। যখন প্রশাসন সক্রিয় হল, তত দিনে দেরি হয়ে গিয়েছে অনেক। ট্রেনে বিমানে মহারাষ্ট্র, গুজরাত, দিল্লি, কেরল থেকে রাজ্যে নাগাড়ে ঢুকেছেন অসংখ্য মানুষ। যাত্রা শুরুর আগে বা শেষে নজরদারি বা পরীক্ষা প্রায় ছিল না। সময়ে সতর্ক থাকলে, কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ এ ভাবে লন্ডভন্ড করে দিতে পারত না বাংলাকে।
রাজধানী জ্বলছে, রাজা গদির খোয়াবে বিভোর। নানা স্ট্রেনের ভাইরাসের ভয়ঙ্কর দৌরাত্ম্যে মে মাসে এ রাজ্যেও গণচিতা জ্বলতে পারে। রাজ্য প্রশাসন কোভিড হাসপাতাল খুলছে, বহু হাসপাতালে খুলছে কোভিড ওয়ার্ড, সেফ হোমগুলোও চালু হচ্ছে। হাসপাতালে বেড বাড়ালেই সুচিকিৎসার ব্যবস্থা হয় না। দরকার ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী, ওষুধ, অক্সিজেন, নানা চিকিৎসার সরঞ্জাম। সাফাইকর্মী থেকে জীবাণুনাশের ব্যাপক আয়োজন জরুরি।
প্রতি দিন আক্রান্তের সংখ্যা লাফ দিয়ে বাড়লে বেড, স্বাস্থ্যকর্মীর অভাব ঘটবেই। ঘোলা জলে মাছ ধরতে এখনই নেমে পড়েছে দালাল আর ব্যবসায়ীর দল। গত বছরের মতো মানুষকে সচেতন করতে গণমাধ্যমে, পোস্টারে, মাইকে ব্যাপক প্রচার শুরু আশু প্রয়োজন। গত বছর জরুরিকালীন বাদে বাকি সব অস্ত্রোপচার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। নিম্নবিত্তরা কষ্ট পেয়েছেন। এ বার আউটডোর পরিষেবা ছাড়াও, খুব জরুরি নয় এমন অস্ত্রোপচার যতটা সম্ভব চালু রাখলে ভাল। অসহায়, স্বাস্থ্য কিনতে অপারগ মানুষের দুর্দশা কমবে। কমবে সুযোগসন্ধানী অসাধু চিকিৎসক ও নার্সিংহোমের হাতে প্রতারণার ঘটনাও।
গ্রামাঞ্চলে সন্দেহজনক উপসর্গে আক্রান্তদের কোভিড পরীক্ষা, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, সংক্রমিতের সংস্পর্শে আসা মানুষ খুঁজে বার করা, তাঁদের নিভৃতবাসে পাঠানোর পাহাড়প্রমাণ কাজের দায়িত্ব শুধু স্বাস্থ্যকর্মী আর আশাকর্মীরা সামলেছেন গত বার। ভিন্রাজ্য থেকে ফেরা মানুষের সংখ্যা এ বারেও কম নয়। এঁদের দায়দায়িত্বের ভার বইতে গিয়ে গত বারের মতো বাচ্চাদের নিয়মিত টিকাকরণ বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা এ বারও তীব্র।
প্রশাসন কড়া সিদ্ধান্ত নিতে পারলে দু’দিক সামলানো কঠিন, তবে অসম্ভব নয়। গ্রামাঞ্চলের ও শহরের বিপুলসংখ্যক শিক্ষক ধাপে ধাপে সামান্য সাহায্য করতে পারলে নিশ্চয়ই খুশি হবেন। কিছুটা প্রশিক্ষণ দিলে সকল কোভিড বিধি মেনে রোগীর প্ৰিয়জনকে, স্বাস্থ্যকর্মীদের অনেকটাই সাহায্য করতে পারেন ওঁরা। বিভ্রান্ত মানুষের ভয় কমিয়ে সচেতন করে তোলার কাজে তাঁরা থাকলে বহু মূল্যবান প্রাণ বাঁচবে। এ বিষয়ে পথপ্রদর্শক হতে পারে বাংলা।
গর্ভবতীদের হাসপাতালে নিয়মিত পরীক্ষা করাতে, নিখরচায় বড় হাসপাতালে নিয়ে যেতে সাহায্য করেন আশাকর্মীরা। কিছু সাম্মানিক দিয়ে তাঁদের কোভিডের কাজে যুক্ত করলে বুনিয়াদি স্তরের এই গরিব স্বাস্থ্যকর্মীরা উৎসাহ পাবেন। উল্লেখ্য, আশাকর্মীরা কাজ শুরুর পর থেকে গত দশকে রাজ্যে ‘বাড়িতে প্রসব’ পুরোপুরি বন্ধ হয়েছে। উল্লেখযোগ্য ভাবে কমেছে গর্ভবতী ও শিশুর মৃত্যুহার। গত বার মাতৃযানগুলি কোভিড রোগীদের পরিবহণের কাজ করায় বহু আসন্নপ্রসবা বড় হাসপাতালে আসতে কষ্টের সঞ্চয় খুইয়েছেন। প্রশাসন অবিলম্বে ব্যবস্থা করলে, সেবাযানের দুষ্টচক্রের গত বারে দেখা প্রতারণা আটকে দেওয়া যায়।
বড় সরকারি হাসপাতালে ডাক্তারের সংখ্যা অন্য হাসপাতালের তুলনায় বেশি। শুধু কমবয়সি ও জুনিয়র ডাক্তাররাই কোভিডের রোগীর সংস্পর্শে আসবেন বেশি— নিয়মটি ভাঙতে হবে। এ বার তো কমবয়সিরা মারা যাচ্ছেন বেশি। গত বার কিছু সুপারস্পেশ্যালিস্ট বুড়ি ছুঁয়েই হাসপাতাল ছেড়েছেন। অনেকের মুখই দেখা যায়নি দীর্ঘ দিন। শাস্তিও হয়নি। ফাঁকা পড়ে থাকা বহু ছোট, মাঝারি সরকারি হাসপাতালে কোভিড ছাড়া অন্য রোগের চিকিৎসা শুরু করা খুব কঠিন নয়। বহু ডাক্তার এই সব হাসপাতালে আছেন। কোভিডরোগীর সংখ্যা হাতের বাইরে চলে গেলে, বড় হাসপাতালের বেশির ভাগ বেডই কোভিড বেড হয়ে গেলে, ছোট হাসপাতালগুলো এই কাজ করতেই পারে। ফার্মাকোলজি, ফিজ়িয়োলজি বা অ্যানাটমির মতো বিষয়ের কোনও কোনও ডাক্তারকে জরুরিকালীন কাজে চাইলেই প্রতিরোধ আসে। এ অভ্যাস বর্জনীয়। স্বাধীনতার পর সম্ভবত সবচেয়ে ভয়ঙ্কর আগুনের মুখোমুখি বাঙালির স্বাস্থ্য। সমস্যা হাতের বাইরে গেলে মহামারি আইনে সরকার বেসরকারি হাসপাতাল অধিগ্রহণ করতেই পারে।
প্রথম বার প্রায় জেতা খেলায় এ বার জিততেই হবে যোদ্ধাদের। ঝাঁপাতে হবে সবাই মিলে।
আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ