রাজাগজাদের ভোজসভা আর গুঁড়িয়ে দেওয়া বস্তি
G20 Summit 2023

কোন ছবি যে দেখব কখন

বাস্তববাদী বলে যাঁরা পরিচিত, তাঁরা নিশ্চয়ই অত্যন্ত অধৈর্য হয়ে উঠেছেন— হচ্ছেটা কী, অ্যাঁ? খাস রাজধানীতে, আন্তর্জাতিক শীর্ষ সম্মেলনের ত্রিসীমানায় বস্তি থাকবে কেন? ভূভারতে কোথাও সেটা হয়?

Advertisement

অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৬:৩৪
Share:

(বাঁ দিকে) মহার্ঘ থালা বাটি গেলাস এবং জি২০ সম্মেলনের প্রতিবেশ পরিষ্কার করতে বস্তি গুঁড়িয়ে দেওয়া হল দিল্লিতে (ডান দিকে)। —ফাইল চিত্র।

গত বুধবার ছবি দু’টি দেখেছিলাম এই সংবাদপত্রের প্রথম পাতায়। দিল্লির ছবি। ইন্ডিয়া, দ্যাট ইজ় ভারতের রাজধানী দিল্লি, অমৃতকালের মহিমায় যা হয়তো অচিরেই হস্তিনাপুরীতে রূপান্তরিত হবে, ইন্দ্রপ্রস্থ হলেই বা ঠেকাচ্ছে কে? উপরের ছবিতে মহার্ঘ থালা বাটি গেলাস। সপ্তাহান্তে ভোজসভা বসবে, তার প্রস্তুতি চলছে। যেমন তেমন সভা তো নয়, জি২০ শীর্ষ সম্মেলনের বার্ষিক মহাসভা বলে কথা, মহামান্য সভ্যবৃন্দ এবং আমন্ত্রিত রথী-মহারথীদের মহাভোজের বাসনকোসন ঠিকঠাক না হলে চলে? জি২০ গোষ্ঠীর সদস্য দেশগুলি পালা করে গোষ্ঠীপতির আসন পায়, আগে থেকেই সব ঠিক করা থাকে। সেই অনুসারে গত বছর চেয়ারটি পেয়েছিল ইন্দোনেশিয়া, সামনের বছর পাবে ব্রাজ়িল। এ-বছর ভারতের পালা। এই পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনাকে কেন্দ্রীয় সরকারের নায়কনায়িকারা স্বাভাবিক ভাবেই তাঁদের বিরাট কৃতিত্ব বলে জাহির করতে তৎপর হয়েছেন। উপরের ছবিতে সেই তৎপরতার এক টুকরো দৃশ্য। স্টিল লাইফ।

Advertisement

নীচের ছবিটিও স্তব্ধ জীবনের। স্তব্ধ এবং শান্ত। মৃত্যুর স্তব্ধতা, শ্মশানের শান্তি। জি২০ সম্মেলনের প্রতিবেশ পরিষ্কার করতে ওখানে বস্তি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এত দিন ওখানে জীবন ছিল, অষ্টপ্রহর বেঁচে থাকার লড়াইয়ে পর্যুদস্ত ক্ষতবিক্ষত জীবন, কলহ বিবাদ অশান্তি সংঘাত হাসি ঠাট্টা নাচ গান বিপদ বিপর্যয়ে নিরন্তর আন্দোলিত জীবন, ভেঙে পড়ার পরে ঘুরে দাঁড়ানো, মার খেতে খেতে হঠাৎ রুখে ওঠা, সব স্বপ্ন চুরমার হয়ে যাওয়ার পরে নতুন স্বপ্ন দেখা জীবন। কোনও এক দিন, হয়তো কোনও এক প্রজন্মে, উন্নয়নের ঠেলায় স্বভূমি থেকে উচ্ছিন্ন হয়ে কিংবা অন্নহীন কর্মহীন স্বভূমি ছেড়ে বাঁচার তাগিদে শহরে এসে ঠাঁই নেওয়া মানুষের ছেঁড়াখোঁড়া বসতিতে টিকে থাকা জীবন। যেমনটা ছড়িয়ে আছে দুনিয়া জুড়ে, ছোট বড় মাঝারি শহরের যত্রতত্র। কোথায় কখন কিসের তাড়নায় কোন বসতি সহসা নেই হয়ে যাবে, ক্ষমতার আসনে অধিষ্ঠিত দেবতারাই জানেন। হয়তো জনপথ কিংবা রাজপথ সম্প্রসারিত হবে, হয়তো বা আকাশে মাথা তুলে দাঁড়াবে বিপুল মুনাফাপ্রসবী বহুমূল্য ইমারত, কিংবা হয়তো জি২০ সম্মেলনের মতো কোনও উপলক্ষে অথবা বিনা উপলক্ষেই শহরকে কটুগন্ধী দৃশ্যদূষণ থেকে মুক্ত করে সুন্দরতর করে তোলার প্রয়োজন দেখা দেবে, সুতরাং উন্নত আধুনিক মহানগরের সভ্যতাগর্বিত মহানাগরিকদের শ্রবণ নন্দিত করে অমৃতস্য পুত্রকন্যাদের উদ্দেশে সহসা ধ্বনিত হবে পবিত্র আহ্বান: শৃণ্বন্তু বিশ্বে— আজ জঙ্গল পরিষ্কার করার দিন। জঙ্গলের নাম কোথাও বস্তি, কোথাও ঝুপড়ি, কোথাও অন্য কিছু।

নীচের ছবিতে তেমনই এক পরিষ্কৃত জঙ্গলের স্মৃতি। সন্দেহ নেই, ছবিটি ক্ষণস্থায়ী। ওই স্থানটিকে নিশ্চয়ই ইতিমধ্যে সাফসুতরো করে তোলা হয়েছে, গড়ে উঠেছে নতুন দৃশ্যপট। মা যা ছিলেন থেকে মা যা হইবেন, সেই রূপান্তরের পথে অল্প সময়ের জন্য যে ধ্বংসাবশেষের দৃশ্য রচিত হয়েছিল, আলোকচিত্রীর ক্যামেরা তাকে ধরে রেখেছে। ক্যামেরা ইতিহাসের স্রষ্টা। তার সৃষ্টি ইতিহাস হয়ে যায় বলেই সে ঐতিহাসিক মুহূর্ত নির্মাণ করতে পারে। সেই ঐতিহাসিকতা ধরা রইল ছবিতে দৃশ্যমান বালকের অবয়বে। ওই গুঁড়িয়ে যাওয়া বস্তিতে কি তার ঘর ছিল? জানি না। সম্ভবত নয়। হয়তো সে প্রতিবেশী, ব্যাট-বল হাতে খেলতে যাওয়ার পথে দু’দণ্ড থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে, হয়তো ওই বস্তিতে তার বন্ধুরা থাকত, তার খেলার সঙ্গীরা। হয়তো আবার খেলবে ওরা, হয়তো নয়।

Advertisement

না, সব বস্তি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়নি। সব জঙ্গল কি আর পরিষ্কার করা যায়? দৃশ্যান্তরের অন্য ছবিও গত কয়েক দিনে ইতস্তত দেখেছি আমরা— রাজধানীর রাজপথের এক ধারে রাতারাতি টাঙানো হয়েছে দীর্ঘ এবং সুউচ্চ রঙিন কাপড়ের পর্দা, তার ও-পারে ছড়িয়ে থাকা বস্তিকে আড়াল করতে। সেখানকার বাসিন্দাদের পরম ভাগ্যবান বলতে হবে, তাঁদের জন্য বুলডোজ়ার নামেনি, যবনিকা পতনেই রেহাই মিলেছে। হিসাবটা আসলে সহজ। ঢাকা গেলে ঢেকে দাও, না হলে ভ্যানিশ করে দাও। লক্ষ্য একটাই: মহাসম্মেলনে সমাগত অতিথিদের চোখের সামনে যেন দারিদ্রের অসুন্দর মূর্তিগুলো প্রকট না হয়, তাঁরা যেন গর্বিত গৃহস্বামী ও তাঁর অনুগত পারিষদদলের সঙ্গে সমস্বরে বলতে পারেন: আমার চোখে তো সকলই শোভন। নতুন কিছু নয় এ-সব। এ-বার তবু, রকমারি প্রচারমাধ্যমের কল্যাণেই, এই নিয়ে কিছু প্রশ্ন উঠেছে, সেই প্রশ্ন এমনকি হোয়াইট হাউসের সাংবাদিক বৈঠক অবধি গড়িয়েছে। কিন্তু রাজাগজাদের সমারোহকে সাফল্যমণ্ডিত করে তোলার জন্য অকুস্থলের চার পাশটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার রেওয়াজ কালজয়ী বললে অত্যুক্তি হয় না। হীরকের রাজ্যে ভিখারি খেদানোর দৃশ্য আকাশ থেকে পড়েনি।

বাস্তববাদী বলে যাঁরা পরিচিত, তাঁরা নিশ্চয়ই অত্যন্ত অধৈর্য হয়ে উঠেছেন— হচ্ছেটা কী, অ্যাঁ? খাস রাজধানীতে, আন্তর্জাতিক শীর্ষ সম্মেলনের ত্রিসীমানায় বস্তি থাকবে কেন? ভূভারতে কোথাও সেটা হয়? হতে দেওয়া যায়? সব কিছুর একটা শোভনতা নেই? তা ছাড়া, কেবল কুদর্শন নয়, এই সব ঝোপড়পট্টির সবই তো কোনও না কোনও সময় উড়ে এসে জুড়ে বসা, মূর্তিমান অন্যায়! বস্তুত, সম্মেলন বসল বলে তো তবু জায়গাটা দখলমুক্ত হল, তা নিয়ে এত কথা কিসের? বাস্তববাদীদের আজকাল খুব দাপট। এই কথাটা তাঁরা জনারণ্যে বেশ ভাল রকম চারিয়ে দিতে পেরেছেন যে, দেশকে এগিয়ে যেতে হলে সরকারকে বলিষ্ঠ হতে হবে। তাই বহু লোকেই হয়তো এখন উন্নয়নের পাঞ্চজন্য বাজিয়ে ঘোষণা করবেন: যে সব ঝুপড়ি কাপড় দিয়ে আড়াল করা হয়েছে, সেগুলিও ভেঙে দেওয়া উচিত ছিল।

দেশ এত দিন ধরে এগিয়ে চলেছে, তবু কেন অগণন মানুষকে এমন সূচ্যগ্র ভূমি জবরদখল করে বাস করতে হয় অথবা প্রতিনিয়ত ঝুপড়ি-বস্তিতে বা ফুটপাতে বসতি খুঁজে চলতে হয়, তাঁদের এই ‘বেআইনি’ জীবনযাত্রা আইনি অর্থনীতির কত রকমের প্রয়োজন মেটায়, ফলিত রাজনীতি কত না গূঢ় কৌশলে তাঁদের স্বার্থসিদ্ধির প্রকরণ হিসাবে— এবং জ্বালানি হিসাবে— ব্যবহার করে, সেই সব প্রতিপ্রশ্ন তুলব না। লাভ নেই। জানি নিশ্চয়, বাস্তববাদীরা এ-সব কথায় কান দেবেন না, দিতে পারবেন না, কারণ তা হলে স্থিতাবস্থার শৃঙ্খল ছিঁড়তে হয়, যে শৃঙ্খল ছাড়া তাঁদের আর কিছুই পাওয়ার নেই। শৃঙ্খলে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর।

তার চেয়ে বরং সস্তার ব্যাট-বল হাতে নিষ্পলক চেয়ে থাকা ওই শিশুর পাশে দু’দণ্ড দাঁড়ানো ভাল। দুনিয়ার নানা রাজধানী থেকে উড়ে আসা নায়কনায়িকাদের আসা-যাওয়ার পথের ধারে টাঙানো পর্দা সরিয়ে জীবনের ও-পারে দৃষ্টিপাত করা ভাল। যে বাস্তবকে আমাদের রাষ্ট্রনায়করা প্রতিনিয়ত মুছে দিতে অথবা লুকিয়ে রাখতে তৎপর, তাকে ক্রমাগত চোখের সামনে টেনে আনাই এখন একটা বড় দায়িত্ব। কেবল তাঁদের চোখের সামনে নয়, নিজেদের চোখের সামনেও। কী দেখছি এবং কী দেখছি না, সেটা অবধারিত ভাবেই আমাদের ভাবনায় ছায়া ফেলে। যত দিন যাচ্ছে, আমাদের দেখার পরিধি দ্রুত সঙ্কুচিত হচ্ছে। সমাজে যাঁদের প্রতিপত্তি আছে, বিভিন্ন বিষয়ে ‘ভয়েস’ আছে, সেই বর্গটির দৈনন্দিন জীবন ক্রমশই শ্রমজীবী মানুষের বিরাট বিস্তীর্ণ জগৎ থেকে আরও বেশি করে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। আমাদের এই বিচ্ছিন্নতার সুযোগে ক্ষমতার অধীশ্বরেরা আমাদের দৃষ্টি ও বোধকে অনায়াসে নিজেদের মতো করে গড়েপিটে নিচ্ছেন। আমরা তাঁদের চোখ দিয়ে দেশকে চিনছি, দেশের উন্নয়নকে চিনছি, দিল্লিতে সমবেত রাষ্ট্রতারকাদের প্রদর্শনী দেখে ভারতের গৌরবে গৌরবান্বিত বোধ করছি। বিশ্বাস করছি যে এটাই বাস্তববাদের নির্দেশ। প্রদীপের নীচে অন্ধকার আরও জমাট বাঁধছে, পিলসুজের গা বেয়ে আরও আরও তেল গড়াচ্ছে, আমরা দেখছি না। দেখছি না বলেই প্রশ্ন তুলছি না। প্রশ্ন তুলছি না বলেই স্থিতাবস্থার ফাঁস আরও সেঁটে বসছে। সেই স্থিতাবস্থা ক্ষমতার ধারক ও বাহক। বাস্তববাদ তার মতাদর্শ। হীরক রাজের বিদূষকের যন্ত্র থেকে যেমন মতাদর্শ নির্গত হয়।

তাই বলছিলাম, তর্ক নিষ্ফল। কেবল একটা কথা খেয়াল করা যেতে পারে। বড়মানুষদের ভোজসভার রুপোর বাসন এবং বস্তির লোকদের ভেঙে দেওয়া জীবনের ধ্বংসাবশেষ— দুটোই বাস্তবের ছবি। কে কোনটা বেছে নেব, প্রশ্ন সেটাই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement