সে দিনের দেশজোড়া দ্রোহ
Netaji Subhash Chandra Bose

প্রতিবাদী রাজনীতির অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছিল নেতাজির আইএনএ

ব্রিটিশ আধিকারিকরা উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন লাইসেন্সবিহীন আগ্নেয়াস্ত্র পেয়ে, যেগুলি প্রাক্তন আইএনএ সদস্যরা ব্যবহার করতে পারতেন।

Advertisement

সুরঞ্জন দাস

শেষ আপডেট: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০৪:৫৩
Share:

রাজনৈতিক মতপার্থক্য ছিল তাঁদের মধ্যে। তা সত্ত্বেও মহাত্মা গাঁধী নেতাজিকে সম্বোধন করতেন ‘দেশপ্রেমিকদের দেশপ্রেমিক’ বলে। ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে নেতাজির অনমনীয় সংগ্রাম, এক ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক এবং স্বাধীন ভারতের লক্ষ্যে তাঁর ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি (আইএনএ) গঠনের কাহিনি অনেক শোনা। কিন্তু পাশাপাশি এও ফিরে ভাবা প্রয়োজন, কী ভাবে আইএনএ ১৯৪৫-৪৬ সালের ভারতের ভিতর এক প্রতিবাদী রাজনীতির জন্ম দিয়েছিল, যা উপমহাদেশের ক্ষমতা হস্তান্তরকে ত্বরান্বিত করে। অত্যন্ত দুঃখের কথা যে, ভারতীয় রাজনীতির এই অধ্যায়টি নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা হয়নি। আমরা সুভাষচন্দ্র বসুর ১২৫তম জন্মবার্ষিকীর সূচনালগ্নকে ব্যবহার করতে পারি এক ‘আর্কাইভাল ডেটাবেস’ তৈরির জন্য, যাতে এই কম গবেষণা হওয়া দিকটি নিয়ে চর্চা করা যায়।

Advertisement

নিকোলাস মনসারেগ ও পেন্ডেরাল মুন সম্পাদিত ক্ষমতা-হস্তান্তর সম্পর্কিত নথিপত্র, সুগত বসু, গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের গবেষণা ও গিরিশচন্দ্র মাইতির বই থেকে আইএনএ-র সমসময়ে ভারতীয় পরিস্থিতি বিষয়ে যা আমরা জানতে পারি, সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৪৫ সালের অগস্ট মাস। ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণার অপরাধে আজাদ হিন্দ সৈন্যদের বন্দি করে বিচার প্রক্রিয়া শুরুর সিদ্ধান্ত নিল ব্রিটিশ সরকার। সঙ্গে সঙ্গেই দেশ জুড়ে তুমুল বিক্ষোভ শুরু। ঘটনাচক্রে যে তিন আইএনএ অফিসার— শাহ নওয়াজ, গুরবক্স সিংহ ধিলোঁ এবং পি কে সায়গলের দীর্ঘ কারাদণ্ড হয়, তাঁরা ছিলেন যথাক্রমে মুসলিম, শিখ এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ। এক ভয়ঙ্কর ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটে কলকাতায়, ১৯৪৫-এর ২১ থেকে ২৩ নভেম্বর। ২১ নভেম্বর বার হয় এক ছাত্রমিছিল, যাঁদের হাতে ধরা ছিল কংগ্রেস, ফরওয়ার্ড ব্লক, মুসলিম লীগ ও কমিউনিস্ট দলের পতাকা আর সুভাষের ছবি— সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ঐক্যের এক বৃহত্তর প্রতীক। ডালহৌসি স্কোয়্যারে মিছিল প্রবেশ করতে চাইলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে। মারা যান এক হিন্দু এবং এক মুসলিম ছাত্র। পরের দু’দিন কলকাতার জনজীবন স্তব্ধ হয়ে যায়। পুলিশের গুলিতে মারা যান ৩৩ জন, আহত হন ২০০ প্রতিবাদী। বাংলার গভর্নর ক্যাসি লেখেন— “গুলি চালানোর সময়ও তাঁরা জায়গা থেকে নড়েননি বা বড়জোর কয়েক পা পিছিয়ে, ফের আক্রমণের মুখে ফেরত এসেছিলেন।”

পঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ, দিল্লি, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, বম্বে, মাদ্রাজ, মেরঠ, কানপুর ও গ্বালিয়র, হায়দরাবাদ, ত্রিবাঙ্কুর এবং কাশ্মীর আজাদ হিন্দের বিষয়ে ঐকমত্য দেখিয়েছিল। পঞ্জাবের গভর্নর গ্ল্যান্সি বলেন যে, ভারতীয় সৈন্যরা ইউনিফর্ম পরেই আজাদ হিন্দ ফৌজের সমর্থনে মিটিং-মিছিলে যোগ দিচ্ছে। ব্রিটিশ আধিকারিকরা উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন লাইসেন্সবিহীন আগ্নেয়াস্ত্র পেয়ে, যেগুলি প্রাক্তন আইএনএ সদস্যরা ব্যবহার করতে পারতেন। আগরা এবং বারাণসীতে পোস্টার লাগিয়ে হুমকি দেওয়া হয়, কোনও আইএনএ বন্দিকে হত্যা করা হলেই ইউরোপীয়দের হত্যা করে তার প্রতিশোধ নেওয়া হবে। সুভাষের নাম তখন লোকের মুখে মুখে ফিরছে, ‘জয় হিন্দ’ উত্তর-পূর্বের জনজাতিদের মধ্যে, বিশেষত নাগা, মিজো, কুকিদের মধ্যে বিপুল জনপ্রিয়। অসমে আইএনএ-র অনুকরণে এক জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গড়ে ওঠে।

Advertisement

গণদাবির মুখে পড়ে শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকার তিন আইএনএ অফিসারকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। তা সত্ত্বেও, যখন আইএনএ ক্যাপ্টেন আজাদ হিন্দ ফৌজের আব্দুল রশিদের সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়, কলকাতা ফের উত্তাল হয়ে ওঠে। সময়টা ১৯৪৬ সালের ১১ থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি। সরকারি রিপোর্ট অনুযায়ী, পুলিশের গুলিতে ৮৪ জন নাগরিকের মৃত্যু হয়। বেসরকারি মতে অবশ্য সংখ্যাটা ছিল ২০০। ঢাকা, অমৃতসর, দিল্লি, আগরা, লখনউ, পটনা, নাগপুর, পুণে-তে রশিদের শাস্তির বিরুদ্ধে হরতাল চলে। বম্বে, করাচি, লাহৌর, কানপুর আর কটকের শ্রমিক শ্রেণি কাজ বন্ধ করে দেন তাঁদের কাজের পরিবেশের উন্নতি আর ব্রিটিশ রাজের অবসানের দাবিতে। এই বিক্ষোভগুলির মধ্যে এক অভূতপূর্ব শ্রেণিচেতনা এবং জাতীয়তাবাদী আবেগের বহিঃপ্রকাশ দেখা গিয়েছিল।

আইএনএ-র বিচারপর্ব ব্রিটিশ মিলিটারিতে ভারতীয়দের মধ্যে বিক্ষোভের জন্ম দিয়েছিল। ১৯৪৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি বম্বের তলওয়ার ‘ট্রেনিং শিপ’-এর নিম্ন আধিকারিকরা আইএনএ-র দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে অনশন শুরু করেন নিম্নমানের খাদ্য এবং ব্রিটিশ অফিসারদের জাতিবিদ্বেষের প্রতিবাদে। বিদ্রোহীরা ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির অনুকরণে নিজেদের নাম দেন ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল নেভি’। বিক্ষোভ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে বম্বে বন্দরের অন্যান্য জাহাজে এবং করাচি, মাদ্রাজ, কলকাতা, কোচি, বিশাখাপত্তনম এবং আন্দামানের নৌঘাঁটিতে। দাবি ছিল, আইএনএ অফিসারদের মুক্তি এবং ইন্দোনেশিয়া থেকে ভারতীয় বাহিনী প্রত্যাহার। এর ফলে বিদ্রোহীদের সঙ্গে পুলিশ এবং সেনার সংঘর্ষ বাধে। ভারতীয় সেনার বেশ কিছু ইউনিট নৌ-বিদ্রোহীদের সঙ্গে লড়তে অস্বীকার করে। বম্বে, মাদ্রাজ এবং কলকাতার রয়্যাল এয়ারফোর্স, জব্বলপুর এবং অম্বালার সেনা ছাউনি এবং বিহার পুলিশের ভারতীয় সদস্যরা নৌ-বিদ্রোহীদের সমর্থন জানায়। এক সেনা অফিসার বলেন যে, আইএনএ-র ঘটনাটি “ভারতীয় বাহিনীর সম্পূর্ণ কাঠামোটাকেই ধূলিসাৎ করে দেওয়ার উপক্রম করেছিল।” ১৯৪৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর এক গোপন রিপোর্টে ভাইসরয় ওয়াভেল ব্রিটিশ আর্মি ও পুলিশের ভারতীয় সদস্যদের আনুগত্যহীনতার আশঙ্কা করেন, মনে করেন ‘প্রথম সুযোগেই’ ব্রিটিশ আধিকারিকদের এক বিশাল অংশ অবসর নিতে পারেন। নাগরিক সমাজও বিদ্রোহী বাহিনীকে সমর্থন জানিয়েছিল। ১৯৪৬ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি বম্বের শ্রমিক শ্রেণি তাঁদের যন্ত্রপাতি নামিয়ে রাখেন। শহরের বিভিন্ন জায়গায় মিছিল এবং পুলিশ ও মিলিটারির সঙ্গে সংঘর্ষে ২২৮ নাগরিকের মৃত্যু হয়। মাদ্রাজ ও করাচিতে নৌ-বিদ্রোহের সমর্থনে শুরু হয় হরতাল।

আইএনএ-র বিচারপর্ব যে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী রাজনৈতিক প্রতিবাদের সূচনা করে, তার থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে অশান্ত হয়ে ওঠে গ্রামাঞ্চলের এক বিস্তৃত অংশ। বাংলায় তেভাগা আন্দোলন প্রচলিত ভাগচাষ পদ্ধতির দিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়। পঞ্জাব, যুক্তপ্রদেশ, বিহার, উত্তর কানাড়া, মালাবার, তুলনামূলক ভাবে কম সক্রিয় এলাকা, যেমন— অজমের, সিন্ধু, বালুচিস্তান এবং কুর্গে ভাড়াটিয়ারা ভাড়া হ্রাস করার দাবিতে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। নালগোন্দা এবং ওয়ারাঙ্গলে কৃষকরা জবরদস্তি শস্য সংগ্রহের কাজে বাধা দেন। তৎকালীন ত্রিবান্দ্রামের আলেপ্পিতে দেওয়ানের অপশাসনের বিরুদ্ধে এক অভূতপূর্ব কৃষক-শ্রমিক অভ্যুত্থান দেখা যায়।

মহাত্মা গাঁধী ভাইসরয়ের ব্যক্তিগত সচিবকে সতর্ক করে জনগণের মনোভাবকে ব্যাখ্যা করেছিলেন এই ভাবে যে, ‘ভারতীয়দের এই সর্বব্যাপী বিরোধিতার মুখে’ আইএনএ-র সৈন্যদের বিচার হলে, তা ক্ষমতার অপব্যবহার করা হবে। অক্ষশক্তির সমর্থন নিয়ে সুভাষচন্দ্রের ব্রিটিশ-ভারতকে মুক্ত করার প্রয়াসের বিরোধী ছিল যারা, সেই ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির পি সি জোশীও ১৯৪৫ সালের ২২ নভেম্বর উপদেশ দেন: যুদ্ধকালীন ভাবনাগুলোকে মাথা থেকে তাড়াও। যুদ্ধ-পরবর্তী বৈপ্লবিক পরিস্থিতি দ্রুত তৈরি হচ্ছে। নতুন পন্থা চাই। মানুষের সঙ্গে থাকো। সিপিআই-এর মুখপত্র স্বাধীনতা-র একাধিক সম্পাদকীয়তে জনগণকে অনুরোধ করা হয় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে অন্তিম সংগ্রামে যোগ দেওয়ার জন্য।

আইএনএ-র অনুপ্রেরণা এবং আইএনএ বিচারপর্বের বিরোধিতা ১৯৪৫-৪৬ সালে যে বিক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছিল, তা দেখে ব্রিটিশ আধিকারিক পেন্ডেরাল মুন বর্ণনা করেছিলেন ব্রিটিশ রাজ ‘এক আগ্নেয়গিরির মুখে’ বসে আছে। লন্ডনও এই সময় আরও সৈন্য পাঠানোর প্রস্তাবে বেঁকে বসে। অতঃপর, ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্টের বিভাজনের চুক্তি, ব্রিটিশ এবং মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে এক সমঝোতার মধ্য দিয়ে। হয়তো আরও বৈপ্লবিক সম্ভাবনার পথ আটকাতে। ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্স অফিসার হিউ টোয়ে স্বীকার করেছিলেন, আইএনএ ভারতে ব্রিটিশ যুগের সমাপ্তি দ্রুততর করেছিল। সেন্ট্রাল প্রভিন্স এবং বেরার-এর গভর্নর অনুভব করেছিলেন যে, গাঁধীকে সরিয়ে সুভাষ দ্রুত জনগণের শ্রদ্ধার জায়গাটি দখল করে নিচ্ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন সুভাষের ‘দীপ্তি’-র কিছুটা তাঁর ভাই শরতের মধ্যেও গড়ে উঠছিল।

‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়’ স্লোগানটি ভুল বার্তাবহ। কিন্তু ১৯৪৭-এর ১৫ অগস্ট যা ঘটেছিল, তা আন্তোনিয়ো গ্রামশি-র কথা ধার করে বলতে হয়, ‘এক পরোক্ষ বিপ্লব’, যে হেতু রাজনৈতিক ক্ষমতা হস্তান্তরের সঙ্গে আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে কোনও মৌলিক পরিবর্তন আসেনি। আইএনএ বিচারের প্রতিক্রিয়া ও আইএনএ-র কীর্তিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে সারা দেশে যে অভ্যুত্থান ঘটেছিল, তা এমন আবহ সৃষ্টি করে, যাকে গৌতম চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, ‘প্রায় বিপ্লব’।

কিন্তু এই বৈপ্লবিক বিকল্পের সম্ভাবনাগুলি কেন অসম্পূর্ণ রয়ে গেল, প্রশ্নটি থেকেই যায়। প্রশ্ন রয়ে যায়, কেন শেষ মুহূর্ত অবধি দেশভাগ-বিরোধী আবেগ টিকে থাকলেও, স্বাধীনতার বিভিন্ন স্বরের উপস্থিতি, এবং শরৎ বসুর নেতৃত্বে গ্রেটার বেঙ্গল মুভমেন্ট-এর মতো চেষ্টা সত্ত্বেও বাংলা এবং ভারত ভাগ হল। ওই সঙ্কটময় দিনগুলিতে নেতাজি উপস্থিত থাকলে কি অন্য রকম হত? যা ঘটেনি, ইতিহাসবিদদের সেই চর্চায় প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয়। কিন্তু সুগত বসু যেমনটি বলেছেন: নেতাজি সংখ্যালঘুদের প্রতি উদার হতেন, ধর্মীয় সম্প্রদায় ও বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষদের মধ্যে যথাযথ ক্ষমতার বিন্যাস গড়ে তুলতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ভাবে কাজ করতেন।

দুর্ভাগ্য, ভারতে তেমনটি ঘটেনি।

উপাচার্য, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement