Houses

ঘর আছে নিরাপত্তা নেই

গৃহ বা ঘর বিষয়ে দার্শনিক চিন্তা কম হয়নি। ঘর আসলে কী? চারটে দেওয়াল, জানলা-দরজা, মেঝে আর ছাদ দিয়ে ঘেরা একটা অস্তিত্বমাত্র?

Advertisement

আবির্ভাব ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৯ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৮:৩১
Share:

অ্যারিস্টটল পরিবারকে রাষ্ট্রের ক্ষুদ্রতম একক বলে মনে করেছিলেন। —ফাইল চিত্র।

মানুষকে ‘সমাজবদ্ধ জীব’ হিসাবে ঘোষণা করার পর, অ্যারিস্টটল, তাঁর পরিবার তত্ত্বের আলোচনায় সামাজিক সম্পর্কগুলি বিশ্লেষণের আগেই বলে নিয়েছিলেন— পরিবারের জন্য প্রথম প্রয়োজন হয় গৃহ, এর পর গৃহিণী এবং লাঙল চালানোর জন্য বলদ।

Advertisement

গৃহ বা ঘর বিষয়ে দার্শনিক চিন্তা কম হয়নি। ঘর আসলে কী? চারটে দেওয়াল, জানলা-দরজা, মেঝে আর ছাদ দিয়ে ঘেরা একটা অস্তিত্বমাত্র? ঘর আসলে একটা ঠিকানা, পুরনো ভিটের টান, ব্যক্তিগত পরিসর অভ্যাসের জায়গা। এই সব কিছুর আগে, ঘর আসলে নিরাপত্তা— ত্রাণাশ্রয়। শীত, রৌদ্রতাপ, বর্ষা অথবা বন্য পশুর আক্রমণ থেকে নিরাপত্তা।

আচ্ছা, এই বার ভাবুন, ঘরের ধারণা থেকে যদি এই নিরাপত্তা ব্যাপারটাই সরে যায়? আপনি ভাবছেন এ তো শুধুই দার্শনিক কল্পনা। আসলে কিন্তু তেমনটা নয়। দেশভাগ বা যুদ্ধ, অথবা ঘূর্ণিঝড় বা ভূমিকম্পের মতো বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিষয়গুলি বাদ দিলেও এমনটা সম্ভব। বাঁকুড়ার পূরবী হাঁসদা, বয়স আটষট্টি; বীরভূমের তমালকৃষ্ণ মণ্ডল, বয়স আটাত্তর; বর্ধমানের জুলেখা বেগম, বয়স ত্রিশ— গত কয়েক মাসে ওঁদের সবার সঙ্গে এমনই ঘটেছে। কখনও টানা ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে, কখনও কোনও প্রাকৃতিক প্ররোচনা ছাড়াই ভেঙে পড়েছে ঘর।

Advertisement

খবরের কাগজের জেলার পাতায় অথবা মূল কাগজের বাঁ-দিকের সরু কলামে খবর হয়। আর? স্থানীয় সংবাদে প্রচারিত হয়— মাটির দেওয়াল চাপা পড়ে বাঁকুড়ায় মৃত্যু হল তিন শিশুর। শনিবার সকালে ঘটনাটি ঘটেছে বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর থানার বোড়ামারা গ্রামে। পুলিশ সূত্রে জানানো হয়েছে অঙ্কুশ সর্দার, বয়স তিন; নিশা সর্দার, বয়স চার এবং রোহন সর্দার, বয়স পাঁচ গ্রামেরই একটি কাঁচা বাড়ির পাশে খেলছিল, আচমকা ওই বাড়ির দেওয়ালের একাংশ ধসে পড়ে। শব্দ শুনে গ্রামবাসীরা ছুটে আসেন। গুরুতর জখম অবস্থায় তাদের উদ্ধার করে বিষ্ণুপুর সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে, কর্তব্যরত চিকিৎসকেরা তিন শিশুকেই মৃত বলে ঘোষণা করেন।

বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বর্ধমান বা বীরভূমের মতো জেলায় প্রত্যন্ত গ্রাম-গঞ্জ বা মফস্‌সলেই নয়, পুরনো শহরগুলোর অলিগলি খুঁজলে দেখা যাবে বসবাসের যোগ্য নয় এমন অনেক বাড়িতে মানুষ থাকেন। যে কোনও মুহূর্তে সেই সব বাড়ি থেকে সরে যেতে পারে নিরাপত্তা। বাসযোগ্য নয় এমন বাড়িতে মানুষ থাকেন কেন? থাকতে বাধ্য হন, তাই থাকেন। পরিবারের জন্য প্রাথমিক প্রয়োজন— ঘর। সামান্য ভিটেমাটিটুকু ছেড়ে পরিবার নিয়ে তাঁরা যাবেন কোথায়? বিপজ্জনক বাড়িতে থাকেন, কেননা হয়তো এই মুহূর্তে সেই পরিবারের যথেষ্ট আয় নেই বাড়িটি মেরামত বা যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ করবার মতো।

অ্যারিস্টটল পরিবারকে রাষ্ট্রের ক্ষুদ্রতম একক বলে মনে করেছিলেন। আর, সেই পরিবারের জন্যই গৃহকে প্রাথমিক এবং আবশ্যিক চাহিদা বলে মনে করেছিলেন। জনকল্যাণকামী রাষ্ট্র হিসাবে ভারতের ‘আবাস যোজনা’ প্রকল্প আছে। এর সমান্তরালে আছে কেন্দ্র-রাজ্য টানাপড়েন— দুর্নীতি, স্বজন-পোষণ বনাম আর্থিক বঞ্চনার চাপানউতোর।

এই সব কিছুর পরেও স্মরণ রাখা বিধেয় যে— মানুষের জীবনে ঘর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঘর, অর্থাৎ নিরাপত্তা। রাষ্ট্র সৃষ্টির কারণ হিসাবে চুক্তিবাদী তত্ত্ব মনে করে, মানুষ সমাজবদ্ধ হয়েছিল সামাজিক চুক্তির দ্বারা। যে সামাজিক চুক্তির কেন্দ্রে ছিল জীবন ও সম্পত্তির অধিকার রক্ষা। অর্থাৎ, রাষ্ট্র— মানুষের জীবন এবং সম্পত্তির অধিকারকে সুরক্ষিত করবে, এর বিনিময়ে সে দাবি করবে আনুগত্য; এই চুক্তিতেই মানুষ রাষ্ট্রীয় জীবনে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়।

সম্পত্তির অধিকার বর্তমানে মৌলিক অধিকারের তালিকা থেকে মুছে গেলেও, জীবনের অধিকার কিন্তু অলঙ্ঘনীয়। কাজেই, বাসযোগ্য নয় এমন বাড়িতে থাকা মানুষ বাড়ি চাপা পড়ে গেলে, আসলে যা চাপা পড়ে, তা হল— জীবনের অধিকার!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement