স্বামী বিবেকানন্দ। —ফাইল চিত্র।
গীতাপাঠ বনাম ফুটবল খেলা নিয়ে প্রবাদসম কথাটা বাদ দিলে নরেন্দ্রনাথ দত্ত-উবাচ আর যে বাক্যাংশটা সারাক্ষণ কোটেশন হিসাবে আমাদের মুখে মুখে ঘোরে তার মূলে হল ‘বিশ্বাস’। ‘নিজের উপর বিশ্বাস’: কাউকে তাতানোর জন্য এর থেকে ভাল টোটকা বাঙালির আর জানা নেই।
আক্ষরিক অর্থে ফুটবল খেলাটা আজকাল ১২ জানুয়ারি ‘বিবেকানন্দ দিবস’-এর কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছে। প্রতি বছরই দেখি, ছোট-বড় সব নেতাই ধুতি-শাড়ি পরিহিত অবস্থাতেই দু’-একটা ‘কিক’ মেরে নিচ্ছেন। তেমনই দেখি, রাজনীতিবিদদের অনেকেই মনে করেন, ‘বিশ্বাস’ শব্দটা বার তিনেক আওড়ে নিলেই আজকের দিনে স্বামীজি-পূজা সাঙ্গ হয়ে যায়। দেখেশুনে একটা সংশয় উপস্থিত হয় ‘নিজের উপর বিশ্বাস’ কথাটার সারমর্ম আজও কর্মবীর বাঙালি ঠিক আত্মস্থ করতে পেরেছে কি? যদি পারত, তা হলে এত নিশ্চিন্তে ও সহজে উচ্চারণ করে কথাটাকে ক্লিন্ন করে ফেলতে পারত কি?
এই বাক্যাংশে বিবেকানন্দ কেন ‘নিজের’ শব্দটার উপর এত জোর দিয়েছেন, সেটা বুঝতে হলে আগে প্রেক্ষিতটা পরিষ্কার করা দরকার। ‘বিশ্বাস’ আমাদের মনে বরাবরই বেশি মাত্রাতেই ছিল, থাকবেও। তবে, আমাদের এই বিশ্বাস সচরাচর নানাবিধ ভগবানে বিশ্বাসের মধ্যেই ঘুরপাক খায়। যে কোনও কাজে হাত দেওয়ার আগে ভগবানের কথাই ভাবি, বলি; কেউ কুলদেবতা, কেউ বা শিব, কালী, দুর্গার নাম জপি, কেউ শ্রীরামকৃষ্ণদেবকে, নিজের গুরুদেবকে স্মরণ করি আর ভাবি, ‘তিনি’ আছেন যখন, তখন ‘হয়ে যাবে’, সাফল্য আসবেই। আর যদি না হয়, তা হলে দোষটাও তাঁর ঘাড়েই চাপাই; বড় জোর, নিজের ভাগ্যকে বা গত জন্মের কর্মফলকে দুষি।
১২৫ বছর আগে দ্বিতীয় বার পাশ্চাত্যে যাবার সময় স্বামীজি বার বার এই বিশ্বাসের কথাই বলছেন। পুনর্বার আমেরিকা যাবেন, কারণ, গুরুর আদেশে ‘নরেন শিক্ষে দিবে’। পশ্চিমে ভ্রমণ নয়, নিরাকার বেদান্তচর্চা ও শিক্ষাদানই ছিল তাঁর একমাত্র অ্যাজেন্ডা। কিন্তু তার মধ্যেও আমাদের এই ‘বিশ্বাস’ বিষয়টি তাঁকে ক্রমাগত বিচলিত করেছে। ১৯০০ সালের ৮ এপ্রিল, সান ফ্রান্সিসকো-র ইউনিয়ন স্কোয়্যার হলে প্রদত্ত রবিবার বিকেলের লেকচারের বিষয় ছিল, ‘ইজ় বেদান্ত দ্য ফিউচার রিলিজিয়ন?’ এই বক্তৃতাতে যত না বেদান্ত-র কথা বলেছিলেন তিনি, তার থেকে অনেক বেশি সময় দিয়েছেন আমাদের এই অন্ধ বিশ্বাসের কুফলগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে। বেদান্ত কী, তা শেখার আগে কী নয় সেটা জানা ভাল; তাই শুরুতেই বলছেন “আই শ্যাল বিগিন বাই টেলিং ইউ হোয়াট বেদান্ত ইজ় নট।” এ ভাবেই আমাদের ভগবানে ‘বিশ্বাস’-এ ক্রমান্বয়ে ঘা দিয়ে গেছেন।
সব কিছু এই ভাবে বিশ্বাসের হাতে আমরা কেন ছেড়ে দিই? তাঁর মতে, কারণ আমরা ভীরু— বিফলতায় ভয় পাই। শুধু তা-ই নয়, আমরা আসলে কর্মবিমুখ— “উই আর সো লেজ়ি, উই ওয়ন্ট আ পার্সোনাল গড, আ সেভিয়র অর আ প্রফেট টু ডু এভরিথিং ফর আস।” তিনি এর বদল চান, এবং চান নিজের হাতে নিজের সব কিছুর দখলদারি। খারাপ ফল হলে ভগবানের দোহাই দেব না, ভাল ফল হলেও ভগবানকে কৃতিত্বের ভাগ দেব না। বোমা ফাটানোর মতো বলেন: “ইট ইজ় আই হু স্ট্রাগল, প্রে অ্যান্ড ওয়রশিপ, ইট ইজ় আই হু ওয়ার্ক আউট মাই প্রবলেমস— অ্যান্ড গড টেকস দ্য ক্রেডিট। দিস ইজ় নট গুড। আই নেভার ডু ইট।” আমি নিজেই যদি সব কাজ করি, এমনকি ভগবানকে পূজাটাও আমার নিজেরই কৃতকর্ম, তা হলে তার ফল যা-ই হোক না কেন, তাতে ভগবানকে টানব কেন? সহজেই বোঝা যায়, এ-হেন মানসিক গঠন থেকেই তৈরি হয়েছে ‘নিজের উপর বিশ্বাস’ বাক্যাংশ। বক্তৃতার মধ্যেই এই প্রসঙ্গে একটা মজার গল্প শোনালেন। বিলেতে এক বার স্বামীজি ডিনার খেতে বসার আগে সেখানকার গৃহকর্ত্রী সবাইকে ভগবানের প্রার্থনা (গ্রেস) করতে বলাতে স্বামীজি গ্রেস তো করলেনই না, উল্টে মহিলাকে ধন্যবাদ জানালেন; কারণ, এই ধন্যবাদটা রান্না করার জন্য তাঁরই প্রাপ্য, জিশুর নয়। ঘোষণা করলেন, “আমি নিজে কঠোর পরিশ্রম করব, ফললাভ করব, তাই সাধুবাদটাও নিজেই নেব।”
আধুনিক অর্থনীতিতে যে কোনও কাজে অথবা প্রোজেক্টে সফলতা নির্ভর করে যিনি কাজটা করছেন তাঁর পরিশ্রম ও অন্তর্নিহিত দক্ষতার উপর। সফলতার মাপকাঠি ০ বা ১০০ না হয়ে তার মাঝামাঝি কিছু; অঙ্কের ভাষায়, সহজ করে বললে, কাজটা ঠিকঠাক শেষ হবে কি হবে না, তার একটা প্রোব্যাবিলিটি বা সম্ভাবনা আছে। আমি বেশি শ্রম বা চেষ্টা (এফর্ট), এবং, অবশ্যই সময় দিলে— সফল হওয়ার সেই সম্ভাবনা বাড়ে। একই ভাবে, আমার দক্ষতা বা স্কিল ভাল হলে সাফল্যের সম্ভাবনাও বাড়ে। তবে আমি যতই দক্ষ এবং পরিশ্রমী হই না কেন, আমার সফল হওয়ার কোনও ‘গ্যারান্টি’ তো নেই; জীবন মাত্রেই অনিশ্চিত। প্রোজেক্ট-ও সফল না হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়। আর ঠিক এইখানেই আমাদের ‘নিজের উপর বিশ্বাস’টা টলে যায়। স্বামীজির ভাষায় আমরা ‘লেজ়ি’ হয়ে যাই, ‘পার্সোনাল গড’-এর খোঁজ করি, যিনি আমার হয়ে যেন এই লুডোর চালটা দেবেন। ভাবি, ভগবানের হাতে ফলটা ছেড়ে দিলে সফলতার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।।
আমরা ভুলে যাই অঙ্কের, সম্ভাবনা-তত্ত্বের, সহজ নিয়মটা। সম্ভাবনা আছে মানেই অনিশ্চয়তাও আছে; এবং তা দু’দিকেই খাটে। তাই, বিচারটা আমাদের হাতেই; লাভ-ক্ষতির হিসাব কষে আমাদের নিজেদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অর্থনীতির মডেলে এ-হেন প্রবণতাকে ‘বিহেভিয়রাল’ আখ্যা দেওয়া যেতেই পারে।
কোনও কাজে সফল হওয়ার সম্ভাবনা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ‘কয়েন-টস’ করার মতো স্থির বা ‘অবজেক্টিভ’ হয় না। অর্থনীতির মডেল তাই প্রায়শই ব্যক্তির নিজস্ব অভিমত বা ‘সাবজেক্টিভ প্রোব্যাবিলিটি’-র কথা বলে। এখানেও পুনরায় বিবেকানন্দের ‘নিজের উপর বিশ্বাস’ প্রযোজ্য। স্বামীজির বক্তৃতাগুলি পড়লে মনে হয়, উনি আত্মবিশ্বাসের কথা বারংবার বলছেন— কারণ নিজের উপর বিশ্বাস থাকলে এই সফলতার সম্ভাবনা বাড়ে, আর না বাড়লেও, নিজের অভিমত, এবং তজ্জনিত ‘সাবজেক্টিভ প্রোব্যাবিলিটি’র বিচারটা ঠিকমতো হয়, সেই বিচার ব্যবহারটাও ঠিক পথে চালিত হওয়ার রাস্তা তৈরি করে।
নিজের জীবনেও তাই শুধু নিজের কাজ করে গিয়েছেন। অন্যদেরও বার বার তা করতে বলেছেন। নিবেদিতা কিংবা জো ম্যাকলাওড, যাঁকেই চিঠি লিখেছেন, তাঁদের সবাইকে এক কথা বলেছেন। এমনকি এই বক্তৃতা দেওয়ার দিনেও মিসেস ওলি বুলকে (যাঁকে উনি ধীরামাতা বলে সম্বোধন করতেন) লেখা একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, “দেখে যাও আমি একটা স্টিম-ইঞ্জিনের মতো কাজ করে চলেছি, তার মধ্যেই রান্না করছি, খাচ্ছি, ঘুমোচ্ছি। এ ভাবেই ভাল আছি।”