—প্রতীকী ছবি।
লোকসভা এবং রাজ্যসভায় শাসক দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকার জন্যে ধ্বনি ভোটে সহজেই বিল পাশ হয়ে যায়। সে ভাবেই একটি বিল গত ২৭ জুলাই ধ্বনি ভোটে পাশ হয়েছে, কোনও আলোচনা বা বিতর্ক ছাড়াই। তার নাম, “জন বিশ্বাস (অ্যামেন্ডমেন্ট অব প্রভিশনস) বিল, ২০২৩।” এই বিল সম্পর্কে কেন্দ্রীয় বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রকের বিজ্ঞপ্তি (২ অগস্ট, ২০২৩) জানাচ্ছে, “বিলের লক্ষ্য হল সহজে জীবনযাত্রা এবং সহজে ব্যবসা করার পথ সুগম করা। এই বিল প্রস্তাব করছে যে উনিশটি মন্ত্রকের বিয়াল্লিশটি কেন্দ্রীয় আইনের ১৮৩টি বিধানকে সংশোধন করে বৈধ (ডিক্রিমিনালাইজ়) করা হবে।”
আইনটি খতিয়ে দেখলে অবশ্য সন্দেহ জাগতে পারে, ব্যবসাকে সহজ করার উদ্যোগ করতে গিয়ে সরকার ব্যবসাতে প্রতারণাকে সহজ করে দিচ্ছে না তো? এমন ব্যবস্থা রাখা হয়েছে যাতে ওষুধ কোম্পানিগুলির কাজে গুরুত্বপূর্ণ বিচ্যুতি থাকলেও, কিছু জরিমানা দিলেই তারা পার পেয়ে যাবে, আদালতের মুখোমুখিও হতে হবে না। যেমন, সরকারি ‘অ্যানালিসিস’ বা ‘টেস্ট রিপোর্ট’কে ওষুধের বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করা এত দিন আইনের চোখে ছিল গুরুতর অপরাধ। ড্রাগস অ্যান্ড কসমেটিকস অ্যাক্ট, ১৯৪০ অনুযায়ী এমন কাজ একাধিক বার করার জন্য দু’বছর পর্যন্ত জেল এবং দশ হাজার টাকা জরিমানা হতে পারত। প্রথম সংশোধনীতে দেখা যাচ্ছে, জরিমানা হবে ন্যূনতম পাঁচ লক্ষ টাকা, কারাদণ্ডের প্রশ্ন নেই। তবে তার চাইতেও বেশি উদ্বেগ জেগেছে প্রত্যাশিত মানের চাইতে খারাপ (নট অব স্ট্যান্ডার্ড কোয়ালিটি বা এনএসকিউ) ওষুধের নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে।
ভেজাল বা জাল ওষুধ তৈরি করলে, বা লাইসেন্স ছাড়া ওষুধ তৈরি করলে তার বিরুদ্ধে ড্রাগস অ্যান্ড কসমেটিকস অ্যাক্ট, ১৯৪০ অত্যন্ত কঠোর— যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অবধি হতে পারে। তবে জাল বা ভেজাল ওষুধের বাইরেও রয়েছে কিছু ওষুধ, নানা কারণে যেগুলি নিম্নমান বা ‘এনএসকিউ’ বলে ধার্য করা হয়। যেমন, যদি ক্যাপসুলে কার্যকর ওষুধটি প্রার্থিত মাত্রার চাইতে কম থাকে, বা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শরীরের মধ্যে ওষুধের কার্যকর উপকরণটি ক্রিয়াশীল না হয়। এই ধরনের ওষুধ ক্ষতিও করতে পারে। যেমন, অল্প মাত্রায় অ্যান্টিবায়োটিক শরীরে ঢুকলে তা অ্যান্টিবায়োটিকের প্রতি শরীরের প্রতিরোধ তৈরি করতে পারে। এই ধরনের ওষুধ ধরা পড়লে নির্মাতা জরিমানা দিয়েই ছাড়া পেতে পারেন, বলছে দ্বিতীয় সংশোধনী।
স্বাস্থ্য মন্ত্রক অবশ্য একটি বিজ্ঞপ্তিতে (২৯ জুলাই, ২০২৩) বলেছে যে, এনএসকিউ ওষুধ তৈরির অপরাধের পুরনো সাজাগুলি বহাল থাকছে। তবে পাশাপাশি শাস্তির একটি বিকল্প পদ্ধতি চালু করছে, আইনি পরিভাষায় যাকে বলে ‘কম্পাউন্ডিং’। যে সব ওষুধ শরীরের পক্ষে ক্ষতিকারক নয়, বিভ্রান্তিকর লেবেল নেই, নির্মাণের প্রক্রিয়ায় বিচ্যুতি নেই, তেমন কিছু ‘এনএসকিউ’ ওষুধের ক্ষেত্রে জরিমানা দিয়ে ছাড় পাবে ওষুধনির্মাতা।
এমন আশ্বাসেও প্রশ্ন থেকে যায়, ভারতে ওষুধ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে কঠোরতা প্রয়োজন, না কি শিথিলতা? ২০২২-এর অক্টোবরে ভারতে তৈরি কাফ সিরাপ খেয়ে আফ্রিকার গাম্বিয়ায় ৬৯ জন শিশুর কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় মৃত্যু হয়েছিল। ল্যানসেট-এর এই খবর বিশ্বে শোরগোল ফেলেছিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) ভারতকে ওষুধের গুণমানের বিষয়ে সতর্ক করেছিল।
বিশ্বের কুড়ি শতাংশ জেনেরিক ওষুধ ভারত থেকে রফতানি হয়, যার মূল্য বছরে ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। ভারতের ওষুধের গুণমান রক্ষাকারী সংস্থার তরফে যে শিথিলতা এবং ছিদ্র আছে, তা নিয়ে অনেকগুলি গবেষণাপত্র বেরিয়েছে ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল এবং ল্যানসেট-এ। ক্যাথরিন এবানের লেখা বটল অব লায়েজ়: র্যানব্যাক্সি অ্যান্ড দ্য ডার্ক সাইড অব ইন্ডিয়ান ফার্মা বইটিতে দেখানো হয়েছে, আইন এড়িয়ে কারবার চালিয়ে যায় নির্মাতারা। ভারতের জেনেরিক ওষুধের মান নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন ভারতীয় চিকিৎসকেরাও। গত অগস্টে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কাউন্সিল চিকিৎসকদের নির্দেশ দেয়, ব্র্যান্ড নাম না লিখে জেনেরিক ওষুধের নাম লিখতে হবে প্রেসক্রিপশনে। চিকিৎসকেরা দাবি তোলেন, আগে জেনেরিক ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণ দরকার।
ভারতে ওষুধের মান রক্ষার ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা দু’টি— এক, কেন্দ্র এবং রাজ্যের মধ্যে বিভাজিত, বহুস্তরীয় ড্রাগ রেগুলেটরি ব্যবস্থা, এবং দুই, সেন্ট্রাল ড্রাগস স্ট্যান্ডার্ড কন্ট্রোল অর্গানাইজ়েশন-এর স্বচ্ছতা এবং তৎপরতার অভাব। একটি বিপজ্জনক ঝোঁক হল ‘ফিক্সড ড্রাগ কম্বিনেশন,’ অর্থাৎ একটি ওষুধে ভিন্ন ভিন্ন উপাদান যোগ করে দেওয়া। রাজ্যগুলিতে সর্বত্র গুণমান পরীক্ষার উপযুক্ত পরিকাঠামো নেই। ফলে বিপজ্জনক ফিক্সড ড্রাগ কম্বিনেশনের ওষুধও ছাড় পেয়ে যায়। সরকার-পোষিত একটি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০১২-২০১৯ সালের মধ্যে একটি ওষুধ নির্মাণকারক সংস্থা অন্তত তেরো বার সতর্কিত হয়েছে ওষুধের কার্যকর মান লঙ্ঘন করার জন্য। কিন্তু তা সত্ত্বেও সেই সংস্থাটি বহাল তবিয়তে রয়েছে। নাগরিকদের কাছে ওষুধের মানের স্বচ্ছতা সম্পর্কে তথ্য নেই। বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক চাপে স্বাস্থ্যবিজ্ঞান পিছনে চলে যাচ্ছে। ‘জন বিশ্বাস’ তৈরিই কি সরকারের প্রধান কাজ?