—প্রতীকী ছবি।
১৯৩৬ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে লিটরারি ডাইজেস্ট পত্রিকা ২৪ লক্ষ মানুষের মধ্যে সমীক্ষা করে ঘোষণা করে যে, রিপাবলিকান প্রার্থী আলফ্রেড ল্যান্ডন পাবেন ৫৭% ভোট, আর ডেমোক্র্যাট প্রার্থী প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাঙ্কলিন রুজ়ভেল্ট পাবেন ৪৩%। বাস্তব ফলাফলের সঙ্গে এই পূর্বাভাসের ফারাক আকাশ-পাতালের চেয়ে সামান্য বেশি হল। রুজ়ভেল্ট পেলেন ৬২%, আর ল্যান্ডন ৩৮%। পরবর্তী কালে অনেক বিশ্লেষণ করে বার করা হল এই ভুলের কার্যকারণ— এ ক্ষেত্রে নমুনা পছন্দের ক্ষেত্রে ছিল পক্ষপাত, যাকে বলে ‘সিলেকশন বায়াস’। যাঁদের টেলিফোন বা ক্লাব মেম্বারশিপ ছিল, বা যাঁরা পত্রিকার গ্রাহক— অর্থাৎ, যাঁরা সে সময়ের নিরিখে যথেষ্ট ধনী, তাঁদের মধ্যে থেকেই নমুনা বাছাই করা হয়েছিল। এঁদের ভোটের ধরন সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের থেকে আলাদা হতে বাধ্য। আবার সমীক্ষায় ছিল প্রচুর ‘নন-রেসপন্স’, অর্থাৎ অনেকেই কিছু প্রশ্নের উত্তর দেননি। কী ভাবে সমীক্ষা করা উচিত নয়, তা বোঝাতে এই সমীক্ষাটার উদাহরণ দেওয়া হয় আজও।
প্রায় শতাব্দী পেরিয়ে, প্রাক্-নির্বাচনী আর বুথ-ফেরত সমীক্ষা এখন ওতপ্রোত ভাবে আমাদের নির্বাচনী সংস্কৃতির অঙ্গ। গুরুত্বপূর্ণ কোনও ভোটের সময় বোঝা যায় যে, কত সংস্থা ব্যাপ্ত এই কাজে। সমীক্ষাগুলি অবশ্য প্রায়শই ভুল করে। আমেরিকায়, ইংল্যান্ডে, ইজ়রায়েলে, কোথায় নয়! ভারতেও। ২০০৪ সালে অটলবিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বাধীন বিজেপির অপ্রত্যাশিত পরাজয় শুধু নয়, এই শতাব্দীর সব ক’টি লোকসভা ভোট, এবং বিহার থেকে দিল্লি, তামিলনাড়ু থেকে পশ্চিমবঙ্গ— বহু বিধানসভা ভোটের ক্ষেত্রেই ‘ওপিনিয়ন’ এবং ‘এগজ়িট’ পোল ব্যর্থ হয়েছে— জয়ী অনুমানে, নয়তো জয়ের পরিমাণ মাপতে।
তবুও এ বারের লোকসভার এগজ়িট পোলটি স্বতন্ত্র। সাধারণত সমীক্ষাগুলির অনুমান হয় বেশ বিস্তৃত। কিছু সংস্থা যদি ‘ক’ পার্টি বা জোটকে স্বচ্ছন্দে জিতিয়ে রাখে, আরও কিছু সংস্থা অনুমান করবে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। আবার অন্য কিছু সংস্থা এগিয়ে রাখবে ‘খ’-কে। এ বারের লোকসভার ভোটে কিন্তু প্রায় সব সমীক্ষাই ছিল একমুখী, এবং তারা প্রায় একযোগেই মুখ থুবড়ে পড়েছে। এমন ভুলের পিছনে কি কোনও পদ্ধতিগত কারণ আছে?
সমীক্ষক সংস্থাগুলি সাধারণত সমীক্ষার খুঁটিনাটি পদ্ধতি, ‘সামারি স্ট্যাটিসটিক্স’ বা সংক্ষেপিত তথ্য ইত্যাদি প্রকাশ করে না। তাই কোথায় যে তাদের ভুল, তার হদিস করা খুবই কঠিন। কী ভাবে তারা নমুনা বাছে, তা যদৃচ্ছ অর্থাৎ ‘র্যান্ডম’ কি না, তাও অজানা। এত সংস্থা সমীক্ষা করে, তবু আজ পর্যন্ত কেউ ভোটের আগে বা বুথ-ফেরত আমাকে জিজ্ঞাসা করেনি যে, কাকে ভোট দেব বা দিয়েছি। বেশ কিছু পরিচিত জনকে জিজ্ঞেস করে দেখেছি, তাঁদের কেউই কোনও দিন এ ধরনের সমীক্ষার মুখে পড়েননি। ধরে নিচ্ছি, এই কম সম্ভাবনার ঘটনাটা আমার ক্ষেত্রে ঘটেছে ঘটনাচক্রে। সমীক্ষাগুলি সঠিক ভাবেই হয় ধরে নিয়ে ভাবার চেষ্টা করি, মোটের উপর তাদের রিপোর্ট কার্ড এত হাস্যকর কেন? আসলে এই সব সমীক্ষায় মাপার চেষ্টা হয় এক জটিল, অতি-সংবেদনশীল বিষয়— জনগণের রাজনৈতিক পছন্দ, যার পরিমাপ সর্বত্রই কঠিন। বিশেষ করে আমাদের মতো ‘পলিটিক্যাল সোসাইটি’তে বটেই।
পোলস্টাররা কি সমীক্ষার নমুনা রাশিবিজ্ঞানের তত্ত্ব ঠিকঠাক মেনে সংগ্রহ করেন? তাঁরা কি সঠিক অনুপাতে পৌঁছন দেশের প্রত্যন্ত স্থানগুলিতে, সংবেদনশীল অঞ্চলের বুথগুলিতে? আমরা জানি না। ইংল্যান্ড, আমেরিকার মতো দেশে আমরা দেখি যে, কোনও কোনও রাজনৈতিক দলের সমর্থকরা এই সব সমীক্ষায় অংশগ্রহণে বেশ অনাগ্রহী; আবার কোনও দলের সমর্থকরা অতি-উৎসাহী। ফলে সমীক্ষার ফল হয় পক্ষপাতপূর্ণ বা ‘বায়াস্ড’। আমাদের দেশে কোন রাজনৈতিক দলের সমর্থকরা এ সব সমীক্ষায় মতামত দিতে অনাগ্রহী, সেটা কি জানেন সমীক্ষকরা? রাশিবিজ্ঞানের সঠিক কৌশল প্রয়োগে পরিস্রুত করা যায় ডেটা-কে, দূর করা সম্ভব এ ধরনের পক্ষপাত বা ‘বায়াস’কে। আমাদের পোলস্টাররা কি আদৌ করেন সেটা?
আবার কোনও ভোটদাতাকে ‘তিনি কাকে ভোট দিয়েছেন’ জিজ্ঞাসা করলেই তিনি যে অজানা, অচেনা সমীক্ষককে ভরসা করে নিজের রাজনৈতিক পছন্দের মতো সংবেদনশীল বিষয়টি সঠিক ভাবে বলবেন— বিশেষ করে তা যদি ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে হয়— এমন ধারণা বহু ক্ষেত্রেই অবাস্তব আমাদের এই রাজনৈতিক সমাজে। জনগণের বক্তব্যকে নিখাদ সত্য ধরে নিলে, তা উল্টে দিতে পারে সব হিসাবকে। তাই তাঁদের বক্তব্যকে ছেঁকে নিতে হবে উপযুক্ত ছাঁকনিতে। সমীক্ষার পদ্ধতি একটু পাল্টে ‘র্যান্ডমাইজ়ড রেসপন্স ডিজ়াইন’নামে রাশিবিজ্ঞানের এক সহজ তত্ত্বের প্রয়োগে কোন দলের সমর্থক কত শতাংশ— তা মোটের উপর বার করা সম্ভব। সমীক্ষকরা কি বাস্তবে প্রয়োগ করেন সেটা?
কত সংখ্যক নমুনা দরকার? অনুমানে কতটা ভুলের সম্ভাবনা থাকবে, তারও একটা হিসাব প্রয়োজন। ‘স্যাম্পল সাইজ়’ বেশি হলেই যে অনুমান ভাল হবে, তা-ও নয়। লিটরারি ডাইজেস্ট-এর নমুনা সংখ্যা ছিল সুবিশাল, সে সময়ের প্রেক্ষিতে তো বটেই। অনেক সময় মনে হয়, আমাদের পোলস্টাররা যে সব সমীক্ষা করেন, তার চেয়ে অনেক বেশি নির্ভুল অনুমান হয়তো সম্ভব মাত্র হাজার চারেক ‘স্যাম্পল’ দিয়েই। প্রতিটা বিধানসভা কেন্দ্রে একটা জুতসই চায়ের কিংবা পানের দোকান বেছে নিলে সংশ্লিষ্ট দোকানদারের কাছেই মিলবে এলাকার নাড়ির স্পন্দনের হদিস। এবং তার গড় নিলে বোধ হয় এ সব এগজ়িট পোল-এর ভুলভুলাইয়ার চেয়ে অনুমান ভুল হবে না বড় একটা।
১৯৩৬-এর পর লিটরারি ডাইজেস্ট কিন্তু আর নির্বাচনী পূর্বাভাস করার পথে হাঁটেনি। বোধ হয় তারা বুঝতে পেরেছিল যে, এটা তাদের উপযুক্ত কাজ নয়। তবে এটাও ঠিক যে, আমাদের পরের ভোটের সময় মিডিয়া আবার প্লাবিত হবে বিভিন্ন সংস্থার করা পূর্বাভাসে। ঝড় উঠবে রাজনৈতিক, সামাজিক জীবনে। শেয়ার বাজারেও। আর ভাগ্যক্রমে পূর্বাভাস কখনও মিলে গেলে পোলস্টাররা ঢক্কানিনাদে ঘোষণা করবেন তাঁদের ‘জয়’, আজকের বিপর্যয়গ্রস্ত অনুমানের কথা সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়েই।