বিস্মৃতি প্রায়শই আত্মধ্বংসী। আজ মোটামুটি ভুলে মেরে দেওয়া হয়েছে যে এনআরসির শুভসূচনা হয়েছিল স্বাধীন ভারতে ঘটে যাওয়া নৃশংসতম এক গণহত্যা দিয়ে। ১৯৮৩ সালে, অসমের এক ছোট্ট জনপদে। তার নাম নেলি— গুয়াহাটি থেকে ৭০-৭৫ কিলোমিটার দূরে। তারিখটি ফেব্রুয়ারি ১৮, ১৯৮৩। অসমে তার কয়েক বছর আগে থেকেই চলছে ‘বিদেশি’-বিরোধী বিক্ষোভ। তৈরি হয়েছে অল অসম গণসংগ্রাম পরিষদ। আসু এবং এএজিএসপি ভোটার তালিকা থেকে সন্দেহভাজনদের বিতাড়নের দাবি তুলেছে। চলছে রাষ্ট্রপতি শাসন। নির্বাচন বয়কটের ডাক দিয়েছে আসু। নির্বাচন ছিল দুই দফায়, নেলিতে ছিল ১৪ ফেব্রুয়ারি। গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল, বা ছড়ানো হয়েছিল যে, দলে দলে ‘অবৈধ বাংলাদেশি’রা ভোট দিচ্ছে। যদিও ভোটের ফলাফলে তেমন দেখা যায়নি। গোটা নেলি বিধানসভায় ভোটই পড়েছিল মোটে ১৫১৭টি। নেলি সরকারি বিদ্যালয়ে ভোট পড়েছিল ১০৯টি। কিন্তু তাতে তো গুজব আটকায় না।
দ্বিতীয় দফার ভোট শেষ হল ১৭ তারিখ। আর রাত পোহাতেই নেলিতে শুরু হয়ে গেল ঘাতক বাহিনীর ‘বাংলাদেশি খতম’ অভিযান। অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলা হল ১৬টি বাংলাভাষী গ্রামকে। গ্রামবাসীদের তাড়া করে ঠেলে দেওয়া হয় নদীর দিকে। সেখানেও নৌকা নিয়ে মজুত ছিল ঘাতকরা। তার পর কোণঠাসা করে প্রকাশ্য দিবালোকে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৩টে পর্যন্ত চলে তথাকথিত ‘বাংলাদেশি’দের অবাধে হত্যালীলা। সরকারি মতে সে দিন খুন হয়েছিলেন হাজার দুই মানুষ। বেসরকারি মতে, সংখ্যাটি পাঁচ থেকে দশ হাজারও হতে পারে। পুড়িয়ে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল আস্ত ১৬টি গ্রাম।
বিস্মৃতি প্রায়শই প্রবঞ্চক। তৈরি করে এক নিরাপত্তার বোধ, যা আসলে কোথাও নেই। যে কারণে, চল্লিশ বছরও হয়নি, এই নির্মম কসাইখানাবৃত্তান্ত বেমালুম ভুলে যাওয়া গিয়েছে। এই লেখার এই পর্যন্ত পড়ে, আজ ভারতীয় ভূখণ্ডের অধিকাংশ মানুষই “এ রকম হয়েছিল? হতে পারে নাকি?” বলে হাঁ করে তাকিয়ে থাকবেন। কিন্তু ঘোরতর বাস্তব হল, এই ভয়াবহ অবাধ গণহত্যা হয়েছিল। রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব পর্যন্ত ঘটনায় উদ্বিগ্ন হয়ে বিবৃতি দিয়েছিলেন।
কারা ছিল এর পিছনে? ইন্ডিয়া টুডে-র ১৯৮৩ সালের একটি রিপোর্টে বলা হয় যে, আসুর সদস্যদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল এই গণহত্যায়। একই সঙ্গে সানডে, ইন্ডিয়া টুডে, অন লুকার্স-এ আরএসএস সংযোগের কথাও বলা হয়। শোনা যায়, ‘বাংলাদেশি হটাও’ নিয়ে আসুর একটি অংশের সঙ্গে আরএসএস-এর সম্পর্ক গোড়া থেকেই ছিল। আসুর ভলান্টিয়ার ফোর্সের নেতা ছিলেন জয়নাথ শর্মা। এই ঘটনায় তাঁর দিকে আঙুল ওঠে। আসুর নেতৃত্বের একাংশই আরএসএস সংযোগের অভিযোগে তাঁকে অপসারণের প্রস্তাব পাশ করে।
তবে কোনওটিই নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই। কারণটিও অকল্পনীয়। গণহত্যাতেই ব্যাপারটা শেষ নয়, পরের ধাপ আরও চমকপ্রদ। সকলেই এই ঘটনায় বিচলিত হলেও, এর বিচার-টিচার হয়নি মোটেই। পুলিশ এই নিয়ে মোট ৬৮৮টি কেস করেছিল। তার মধ্যে ৩৭৮টি সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে বন্ধ হয়ে যায়। বাকি ৩১০টি সরকারি নির্দেশে বন্ধ করে দেওয়া হয়। প্রশাসনের নাকের ডগায় দিনের আলোয় যে ভাবে হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছিল, একই ভাবে সর্বসমক্ষে তাকে ধামাচাপা দেওয়ার সুবন্দোবস্তও হয়। এ এমন এক গণহত্যা, যা আসলে ঘটেইনি। লাতিন আমেরিকায় এ জিনিস ঘটলে নির্ঘাত মার্কেজ় এই নিয়ে উপন্যাস লিখতেন। নিদেনপক্ষে দিল্লির কাছাকাছি এ রকম কিছু ঘটলে তা নিয়ে নো ওয়ান কিলড অমুক নামের সুপারহিট সিনেমা হত। কিন্তু এ তো খুচরো কয়েক হাজার বাঙালি নিধন। তিওয়ারি কমিশন নামে একটি সরকারি কমিশন তৈরি হয়েছিল বটে, কিন্তু তার রিপোর্ট কখনও প্রকাশ্যে আসেনি। শোনা যায় রিপোর্টের তিনটি মাত্র প্রতিলিপি আছে। এবং ১৯৮৪ থেকে আজ পর্যন্ত অসমের প্রতিটি সরকারই এই রিপোর্টকে চোখের মণির মতো রক্ষা করেছেন।
বিস্মৃতি প্রায়শই নির্মিত। যে কারণে আমরা নেলি ভুলে যাই, বা যাওয়ানো হয়, যদিও এর এক বছর পরে ঘটে যাওয়া দিল্লির শিখহত্যা আমরা মনে রাখি। নেলির ইতিহাস আসলে ধামাচাপা দেওয়ার ইতিহাস, যার কারণটি সম্পূর্ণই রাজনৈতিক। উগ্র অসমিয়া জাতীয়তাবাদী এবং হিন্দুত্ববাদীদের সন্তুষ্ট করতে এর পরেই কেন্দ্র, রাজ্য এবং আসুর মধ্যে এক বোঝাপড়া হয়ে যায়, যার পোশাকি নাম অসম চুক্তি। তাতে যে ঐকমত্য হয়, তার কয়েকটি নমুনা:
১) জঘন্য অপরাধ না হলে আন্দোলনকারীদের উপর থেকে সমস্ত ফৌজদারি অভিযোগ তুলে নেওয়া হবে। আন্দাজ করা যায়, নেলি হত্যাকাণ্ড সম্ভবত সরকারি হিসেবে জঘন্যতম অপরাধ নয়।
২) অসমিয়া সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য রক্ষার জন্য সাংবিধানিক, প্রশাসনিক এবং সংসদীয় সুরক্ষাকবচ (সেফগার্ড) তৈরি করা হবে। অর্থাৎ, বহুজাতিক অসমে অসমিয়া একাধিপত্যে সরকারি সিলমোহর।
৩) ১৯৭১ সালের পর যাঁরা অসমে ঢুকেছেন, সেই বিদেশিদের (পড়ুন বাংলাদেশি) তাড়ানো অব্যাহত থাকবে।
তিন নম্বর পয়েন্টটি প্রণিধানযোগ্য। কারণ এই হল সেই বিন্দু, যেখান থেকে ভারতবর্ষে এনআরসির ‘শুভসূচনা’ হয়। খুঁজে-খুঁজে ‘বাংলাদেশি’ ধরা এবং তাঁদের টিপে-টিপে মারা, এই প্রক্রিয়াটিকে ন্যায়সঙ্গত করে দেওয়া হয় এই চুক্তিতে। হত্যাকারীরা চেয়েছিল হাতে মারতে, আর এই চুক্তির পর ভারত রাষ্ট্র সেই দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে হাতের বদলে ভাতে মারবে ঠিক করে। এই ভাবেই আরএসএস-এর হাঁ মুখে সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাভাষীদের বলি দেওয়া হয়। মূল ধারার অন্য দলগুলি কোনওক্রমে স্থিতাবস্থার শান্তিকল্যাণ বজায় থাকবে আশা করেছিল। সে কারণেই ভুলে যাওয়া হয়, ভুলিয়ে দেওয়া হয় গণহত্যা। তার পর অবশ্য চাকা গড়ায়। বিজেপির জোট সরকার ক্ষমতায় আসে। সোজাসাপ্টা পদ্ধতিতে উনিশ লক্ষ লোক, যার প্রায় পুরোটাই বাঙালি, তাঁদের ভিটেমাটি-নাগরিকত্ব হারানোর সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। তার পরেও শোনা যাচ্ছে, এতেও এক পক্ষ সন্তুষ্ট নয়। আরও বাঙালিকে তাড়ানো দরকার। এই ভাবে চলতে থাকলে সেটাও নিশ্চয়ই হয়ে যাবে এক দিন।
গণহত্যার পাপকে ধামাচাপা দিলে এমনই হওয়ার কথা। স্বাধীন ভারতবর্ষের ইতিহাসে বৃহৎ হত্যাকাণ্ড হয়েছে তিনটি। এক, ইন্দিরা গাঁধী মৃত্যুর পর দিল্লির শিখহত্যা। তার এক রকম বিচার হয়েছে। দুই, গোধরা কাণ্ডের পর গুজরাতের গণহত্যা। তার বিচার বা মতান্তরে প্রহসনটুকু অন্তত হয়েছে। সেটুকুও দরকার, কারণ তাতে ভবিষ্যতের সম্ভাব্য হত্যাকারীদের অন্তত একটি বার্তা দেওয়া যায় যে, এ ধরনের জিনিস ঘটালে অবাধে পার পেয়ে যাওয়া যাবে না, হইচইটুকু অন্তত হবে। আর তিন, নেলি গণহত্যা। এই একটিমাত্র গণহত্যা, যার পিছনে কোনও প্ররোচনা ছিল না। এবং এইটিই একটিমাত্র গণহত্যা, যার বিচার তো হয়ইনি, বরং হত্যাকারীদের সযত্নে পুরস্কৃত করা হয়েছে। এই সেই সূচনাবিন্দু, যেখানে বোতল থেকে মুক্ত করে দেওয়া হয় বিতাড়নের দৈত্যকে।
সেই দৈত্য আজ এনআরসি, সিএএ-তে পরিণত হয়ে গোটা উত্তর-পূর্ব এবং পূর্বের বাঙালিদের গ্রাস করে ফেলতে উদ্যত। এখন আর ঘাতকের ভোঁতা অস্ত্র প্রয়োজন হয় না, রাষ্ট্রই সেই উদ্যোগ নিজের হাতে তুলে নিয়েছে। বিজেপি সরকার আসার আগের সরকারগুলির লক্ষ্য ছিল স্থিতাবস্থা বজায় রাখা, কিন্তু তাড়ানো নিয়ে নতুন কেন্দ্রীয় জমানায় আর কোনও তর্ক নেই। শুধু প্রশ্ন হল, কাদের তাড়ানো হবে। সারা ভারতে কোনও জাতির মানুষকে নথিপত্র হাতে নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে বসে ভাবতে হয় না, সে দেশের নাগরিক কি না। অসমের বাঙালিকে হয়। হয়তো কিছু দিন পরে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিকেও ভাবতে হবে, কী ভাবে প্রমাণ করবে যে, সে নাগরিক। বাঙালির জন্য এখন তো নাগরিকত্ব আর স্বাভাবিক বিষয় নয়, কেন্দ্রের দয়ার দান। সরকারি লালফিতের বাঁধনে, কতিপয় অফিসারের অঙ্গুলিহেলনে মানুষের প্রাণভোমরার ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে।
এই কারণেই বিস্মৃতি একটি অপরাধও বটে। এনআরসি, সিএএ-র দানবিক প্রক্রিয়া যে একটি গণহত্যা দিয়েই শুরু, এ দৈত্য যে চক্রবৃদ্ধি হারে আরও বেশি আহুতি চেয়েই চলবে, এ কথা এই সময়ে ভুলে যাওয়ার অর্থই হল আরও বড় বিপর্যয়ের দিকে নিজেদের ঠেলে দেওয়া। ন্যাড়া বেলতলায় দ্বিতীয় বার যায় না, এই কথা সবাই জানে, কিন্তু সে তো শুধু প্রথম বারের কথা ভুলে না গেলে।