ভারতের কৃষিক্ষেত্রের আধুনিকীকরণ দরকার বহির্বিশ্বের সঙ্গে তাল রাখতে গেলে। ফাইল ছবি।
কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন কেন্দ্রীয় সরকারের এই দফায় শেষ পূর্ণাঙ্গ বাজেট পেশ করলেন। আগে পূর্ণাঙ্গ বাজেট পেশ করতে প্রায় ঘণ্টাতিনেক সময় লাগত। এখন তা কমতে কমতে এ বছর ৮৭ মিনিটে এসে ঠেকেছে। তাই বাজেট পেশ করার সময় বাজেট ভাল হচ্ছে না খারাপ, তা বোঝা আগের চেয়ে কঠিন হয়েছে। অনেক কিছু অব্যক্ত থাকছে, যা ক্রমশ প্রকাশ্য হয়ে উঠছে। শেয়ার বাজার পর্যন্ত হাজার পয়েন্ট উঠে আবার ৫০০ পয়েন্ট পড়ে তার পর কোনও ক্রমে গত দিনের তুলনায় ২০০ পয়েন্ট উপরে দিন শেষ করেছে। তাই শুরুতে সবাই বুঝে উঠতে পারছিলেন না যে, বাজেট কেমন হল। এখন হয়তো তা কিছুটা স্পষ্ট।
অর্থশাস্ত্রের ছাত্র হিসেবে কিছু নতুন সৃষ্টিশীল ভাবনা ও পদক্ষেপ আমরা অর্থমন্ত্রীর কাছ থেকে আশা করি। বাণিজ্যমন্ত্রী আর অর্থমন্ত্রীর কাজের ধরন একটু আলাদা। বাণিজ্যমন্ত্রীর মধ্যে সৃষ্টিশীলতা বা সৃজনীশক্তি অতটা না থাকলেও চলে। কিন্তু অর্থমন্ত্রীর ক্ষেত্রে তা আবশ্যিক। নতুন নতুন ‘পলিসি ডিজ়াইন’ করা অর্থমন্ত্রীর কাজের অপরিহার্য অঙ্গ। নির্মলা আগে বাণিজ্যমন্ত্রী ছিলেন, বর্তমানে অর্থমন্ত্রী। তাঁর মধ্যে সৃষ্টিশীলতার কিছুটা অভাব বিগত কয়েক বছর আমরা দেখেছি। কিন্তু বিগত চার বছরের সঙ্গে তুলনা করলে এই বাজেট কিছুটা আলাদা। কিছু অন্য রকম ভাবনার পরিচয় হয়তো পাওয়া গেল।
আগের বছর সরকার পরিকাঠামো উন্নয়নে ক্যাপিটাল এক্সপেন্ডিচার বা মূলধনি খাতে বিনিয়োগ প্রায় ৩৫% বৃদ্ধি করেছিল। এ বারও সেই বৃদ্ধির পরিমাণ ৩৩%। পরিকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ বৃদ্ধি কর্মসংস্থান বাড়ায়, যার থেকে অর্থনীতিতে চাহিদা বাড়ে; আবার পরিকাঠামোর জোগান বৃদ্ধির ফলে বাজার নামক প্রতিষ্ঠানটি অনেক ভাল কাজ করে, দেশের সর্ব শ্রেণির মানুষ বাজারের সুবিধা বেশি করে পেতে পারেন। এই জাতীয় বিনিয়োগের সুবিধা পেতে একটু সময় লাগে, এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। বর্তমান সরকার যে এ বারও দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য থেকে সরে আসেনি, এটা দেখে ভাল লাগল। সংশয় ছিল, যে-হেতু ২০২৪-এ লোকসভা নির্বাচন, সে জন্য হয়তো সরকার কিছু স্বল্পমেয়াদি জনমোহিনী প্রকল্প চালু করার দিকে ঝুঁকতে পারে। সে রকম যে কিছু হয়নি, তা অন্তত আমাদের কাছে স্বস্তিদায়ক। দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য থেকে সরে আসাটা কোনও কাজের কথা নয়।
বর্তমান বাজেটের আর একটি বিষয় নিয়ে একটু আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে— মহাত্মা গান্ধী গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা আইনের অধীনে বরাদ্দ আগের বাজেটের তুলনায় ১৩,০০০ কোটি টাকা কমানো হয়েছে। এর ফলে একটি অংশ ‘গেল গেল’ রব তুলেছে। কিন্তু গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা যোজনার যা উদ্দেশ্য, তা মূলধনি খাতে ব্যয়ের মাধ্যমে আরও ভাল ভাবে করা যায়। গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা যোজনার মাধ্যমে মানুষের হাতে কিছু অর্থ আসে বটে, কিন্তু সে রকম কোনও দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক ও অন্য পরিকাঠামো তৈরি হয় না, যা প্রজন্মের পর প্রজন্মের কাজে আসতে পারে। মূলধনি খাতে ব্যয় বৃদ্ধির মাধ্যমে মানুষের হাতে টাকা আসা এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিকাঠামো উন্নয়ন, দুটোই ভাল ভাবে হতে পারে। তাই যখন সরকারকে রাজকোষ ঘাটতিও নিয়ন্ত্রণ করতে হয়, তখন এমন ভাবে অর্থ বরাদ্দ করতে হয় যাতে সর্বোচ্চ সুবিধা বার করে আনা যায়। এ ছাড়া গ্রামীণ জল সরবরাহ, গ্রামীণ আবাস যোজনায় অনেকটা বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। এর থেকে গ্রামীণ কর্মসংস্থান বাড়ার প্রচুর সম্ভাবনা। তাই গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা যোজনায় বরাদ্দ কমানোর মধ্যে আমি অন্তত খুব দোষের কিছু দেখছি না, পরিকাঠামো উন্নয়নে যখন বেশ কিছুটা বরাদ্দ বাড়ানোই হয়েছে। দানসত্র মানসিকতা ও সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে যত তাড়াতাড়ি আমরা দীর্ঘমেয়াদি সুফলকে পাখির চোখ করব, ততই দেশের মঙ্গল।
নতুন প্রযুক্তিগত শিল্প বা স্টার্ট-আপ নিয়ে বর্তমান সরকার শুরু থেকেই উৎসাহ দেখিয়ে এসেছে। ‘স্টার্ট-আপ ইন্ডিয়া’ প্রকল্পকে এই সরকারের একটি সাফল্য হিসেবে দেখা যায়। তাই স্টার্ট-আপগুলিকে যে এই বাজেটেও উৎসাহ দেওয়া হবে, তা প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু কৃষিক্ষেত্রে নতুন প্রযুক্তিগত শিল্পকে নিয়ে আসার মধ্যে অভিনব ভাবনা আছে, যা আমরা বিগত কিছু বাজেটে পাইনি। কৃষিক্ষেত্র নিয়ে যে নতুন ভাবনাচিন্তার দরকার আছে, সে কথা অর্থনীতিবিদরা অনেক দিন ধরে বলে আসছেন। ভারতের কৃষিক্ষেত্রের আধুনিকীকরণ দরকার বহির্বিশ্বের সঙ্গে তাল রাখতে গেলে। নতুন কৃষিবিল প্রত্যাহার করতে বাধ্য হওয়ার পর এই ক্ষেত্রে অগ্রগতি কী ভাবে হবে, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে সংশয় ছিল। নতুন প্রযুক্তিগত শিল্প বা স্টার্ট-আপ এলে হয়তো এই সমস্যার কিছু সমাধান হতে পারে। কৃষিক্ষেত্রে বাজার যাতে ঠিক মতো কাজ করে, আর ফড়ে-রাজ হ্রাস পায়, সে দিকে নজর দেওয়া জরুরি।
এ রকম একটা ভুল ধারণা অনেকের মধ্যে আছে, বা ছড়িয়ে দেওয়া হয় যে, প্রযুক্তি হল সম্পন্ন ধনবান কৃষকদের ব্যাপার, এবং এতে সাধারণ প্রান্তিক কৃষকদের কোনও লাভ হবে না, তাঁরা শোষিত হবেন। সত্যি কথাটা আসলে উল্টো। আর আজকাল প্রযুক্তি ও ডিজিটাল পেমেন্ট দেশের প্রত্যন্ত গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে, অধিকাংশের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টও আছে, তাই এই নিয়ে সংশয়ের কোনও অবকাশ নেই। প্রযুক্তি স্থানীয় ফড়ে বা দালালদের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার একটা উপায়, এবং এতে হয়তো সবচেয়ে উপকৃত হবেন গরিব চাষিরাই।
ভারতের অর্থব্যবস্থার আয়তন এখন প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ কোটি আমেরিকান ডলারের কাছাকাছি— মাথাপিছু গড় আয় প্রায় ২৫০০ ডলার। আমাদের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার ৭ শতাংশের কাছাকাছি। অর্থনৈতিক প্রগতির এই স্তরে আমাদের আরও দ্রুতগতিতে এগোনো উচিত। কিন্তু সমস্যা হল ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ ও তার ফলে সারা বিশ্বের অর্থনৈতিক মন্দা আমাদের দ্রুত গতিতে এগোনোর পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এই অবস্থায় রফতানিকেন্দ্রিক কিছু উদ্ভাবনী পদক্ষেপ আশা করেছিলাম। কিছু রফতানিকেন্দ্রিক বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (স্পেশাল ইকনমিক জ়োন বা এসইজ়েড) তৈরি করার কথা ভাবা যেতে পারত, কিছু রফতানি কর ছাড় দেওয়া যেতে পারত। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল নিয়ে অনেকের অনেক রকম নৈতিক আপত্তি থাকে। কিন্তু বিশেষ পরিস্থিতির জন্য বিশেষ ব্যবস্থা। সবার সব আপত্তিতে আমল দেওয়া শুরু করলে আর এগোনো যাবে না। এর সঙ্গে বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য যা-যা প্রণোদনা দেওয়া যায়, দেওয়া উচিত। সে রকম বিরাট কিছু পাওয়া গেল না। প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বেই, এ বছরের অর্থনৈতিক সমীক্ষায় এমন আশা করেই আমরা ক্ষান্ত।
নতুন আয়কর ব্যবস্থার আওতায় থাকলে কর ছাড় পাওয়া যাবে, এই সংবাদ উদ্দীপনা তৈরি করেছে। বিগত তিনটি বাজেটে মধ্যবিত্তদের জন্য কোনও আয়কর ছাড় দেওয়া হয়নি। পুরনো আয়কর ব্যবস্থায় যাঁরা থাকবেন, তাঁদের জন্য কোনও ছাড় নেই। সাধারণত যাঁরা সঞ্চয় করেন না, বা যাঁদের গৃহঋণ নেই, তাঁরাই নতুন ব্যবস্থায় থাকবেন। যাঁদের সঞ্চয় বা গৃহঋণ আছে, পুরনো ব্যবস্থাতেই তাঁদের সুবিধা। পুরনো ব্যবস্থায় কোনও কর ছাড় না দেওয়ার অর্থ কি মানুষকে সঞ্চয়ে বা গৃহঋণ গ্রহণে নিরুৎসাহ করা? সাধারণত দেশে সঞ্চয় বৃদ্ধি থেকে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায়, মানুষ বেশি গৃহঋণ নিলে নির্মাণ শিল্প উৎসাহিত হয়। একটি দেশের প্রগতির জন্য নির্মাণ শিল্পকে উৎসাহিত করা জরুরি। তাই পুরনো আয়কর ব্যবস্থাতেও কিছু কর ছাড় দিলে ভাল হত। উন্নয়নের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলেও শুধু নতুন নিয়মে মানুষকে ঠেলার যুক্তি পরিষ্কার নয়।
মোটের উপর এই বাজেটের অভিমুখ দীর্ঘমেয়াদি। ভর্তুকি কমিয়ে আনা, পরিকাঠামো উন্নয়ন, প্রযুক্তিনির্ভর গ্রামীণ উন্নয়ন— এগুলি ভাল পদক্ষেপ। ধুঁকতে থাকা সরকারি সংস্থা বিক্রি বা বিলগ্নিকরণ অব্যাহত থাকছে। চিনও অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিভিন্ন স্তরে প্রচুর বিলগ্নিকরণ করেছিল। এটাই স্বাভাবিক। অপচয় ও ঘাটতি কমানো, সরকারের আয় বাড়ানো ও সঠিক জায়গায় বিনিয়োগের জন্য এটি আবশ্যক। বাজেট শুধু আগামী এক বছরের আয় বা ব্যয়ের হিসাব নয়। দেশের ভবিষ্যৎ অর্থনীতির কী ভাবে চলা উচিত, বাজেট তার দিগ্দর্শন। এই বাজেট দীর্ঘমেয়াদি অভিমুখে চলার দিকেই নির্দেশ করছে।