India

উদার কূটনীতি এবং ব্যতিক্রম

ভারত কেন পাকিস্তানের বিপদের সময় মুখ ঘুরিয়ে নেয়? বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের স্পষ্ট বক্তব্য, এ বিষয়ে দেশের মানুষ কী চায়, তা দেখতে হবে।

Advertisement

প্রণয় শর্মা

শেষ আপডেট: ১৬ মার্চ ২০২৩ ০৫:৫৪
Share:

তুরস্কে ভারতের এই ভূমিকা কোনও ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়। ফাইল চিত্র।

সম্প্রতি একটা ভিডিয়ো অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, ভারতের জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর (ন্যাশনাল ডিজ়াস্টার রেসপন্স ফোর্স) সদস্যরা তুরস্কে ভূমিকম্প-পরবর্তী উদ্ধার-কার্য শেষ করে তুরস্ক ছেড়ে বেরিয়ে আসছেন। সেই সময়ে স্থানীয় প্রশাসনের কর্তারা এবং সাধারণ মানুষ তাঁদের ঘিরে দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়ে তুরস্কের এই চরম বিপদের দিনে সাহায্যের হাত বাড়ানোর জন্য কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাচ্ছেন। যে কোনও ভারতবাসীর পক্ষেই এই দৃশ্যটি রীতিমতো শ্লাঘার, এবং আনন্দেরও বটে।

Advertisement

তুরস্কে ভারতের এই ভূমিকা কোনও ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়। বরং আর্থিক ও সামরিক প্রভাব বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ভারত গত দু’দশক ধরেই দক্ষিণ এশিয়ার একাধিক দেশ তো বটেই, এই অঞ্চলের বাইরেও নানা দেশের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে চলেছে। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ সম্ভবত ২০০৪ সালে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ভূমিকম্প ও সুনামির পরে ভারত আরও কয়েকটি দেশের সঙ্গে হাত মিলিয়ে উদ্ধার-কার্যে নামে। নৌবাহিনীর জাহাজ পাঠিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বহু দ্বীপ ও উপকূলবর্তী এলাকা থেকে হাজার হাজার মানুষকে উদ্ধার ও পুনর্বাসনে সাহায্য করে।

আবার কোভিড-১৯ অতিমারির সময়ে যখন পশ্চিমি দুনিয়ার ধনী দেশগুলি নিজের দেশের মানুষের জন্য ভ্যাকসিন ও অত্যাবশ্যক ওষুধ মজুত করতে ব্যস্ত ছিল, তখন ভারত কিন্তু দক্ষিণ এশিয়া ও অন্যান্য অঞ্চলের গরিব রাষ্ট্রকে ভ্যাকসিন ও জরুরি ওষুধ সরবরাহ করে গিয়েছে। খুব সম্প্রতি, ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় মিশরে খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থায় সঙ্কট দেখা দিলে ভারত জরুরি ভিত্তিতে ১,৮০,০০০ টন গম পাঠিয়ে পরিস্থিতি কিছুটা সামাল দেয়। আবার অতিমারির সময়ে যখন মলদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কায় পর্যটন শিল্প চরম ক্ষতিগ্রস্ত হল, তখন ভারত ওই দুই দেশকে আর্থিক সাহায্য করেছিল। শ্রীলঙ্কার চরম আর্থিক সঙ্কটেও পাশে ছিল ভারত। আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডারের (আইএমএফ) কাছ থেকে শ্রীলঙ্কা যখন ঋণ পাওয়ার চেষ্টা করছিল, তখন কোনও দেশই তার গ্যারান্টর হতে এগিয়ে আসেনি। এমনকি, শ্রীলঙ্কায় চিনের বিপুল বিনিয়োগ থাকা সত্ত্বেও চিন গ্যারান্টর হতে ইতস্তত করছিল। ভারত কিন্তু শ্রীলঙ্কার পাশে দাঁড়িয়ে গ্যারান্টার হয়েছিল। অনেক ক্ষেত্রেই পশ্চিমি দুনিয়ার ধনী দেশগুলির চেয়ে ভারত আরও দ্রুত এগিয়ে এসেছে। যদিও সমালোচকরা দাবি করেন, প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির আপদে-বিপদে পাশে দাঁড়ানোর এই প্রবণতার মধ্যে আসলে ভারতের নিজেকে বৃহৎ আঞ্চলিক শক্তি হিসাবে জাহির করার চেষ্টা প্রতিফলিত হচ্ছে।

Advertisement

এই এগিয়ে গিয়ে পাশে দাঁড়ানোর নীতিতে উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম পাকিস্তান। ২০২২-এর জুন থেকে অগস্ট পাকিস্তানে যে প্রবল বর্ষণ এবং বিধ্বংসী বন্যা হল, তা অভূতপূর্ব। তার জেরে উদ্ভূত খাদ্য সঙ্কট, স্বাস্থ্য সঙ্কটে এখনও অগণিত পুরুষ, নারী, শিশু অবর্ণণীয় অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। তার উপর রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আর্থিক সঙ্কটও বেসামাল করেছে। ধারাবাহিক, বহুমাত্রিক সঙ্কটে বিপর্যস্ত এই দেশের প্রতি ভারতের উদাসীন, নিস্পৃহ মনোভাব পর্যবেক্ষকদের বিস্মিত করে বইকি! যেটা আরও চিন্তার তা হল, প্রতিবেশী পাকিস্তানের সাধারণ মানুষকে দুর্দশাগ্রস্ত হতে দেখে ভারতীয় সমাজের একাংশ সহানুভূতি তো দেখাচ্ছেই না, বরং প্রকাশ্যেই নানা অসংবেদনশীল মন্তব্য করে চলেছে।

ভারত কেন পাকিস্তানের বিপদের সময় মুখ ঘুরিয়ে নেয়? বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের স্পষ্ট বক্তব্য, এ বিষয়ে দেশের মানুষ কী চায়, তা দেখতে হবে। তাঁর ইঙ্গিত থেকে পরিষ্কার, বিপদের সময় পাকিস্তানের পাশে দাঁড়ানোর পক্ষে দেশের মানুষের বড় অংশের সায় রয়েছে কি না, সে বিষয়টিকে গুরুত্ব দেবে সরকার। পাকিস্তানের ধারাবাহিক ভারত-বিরোধিতার বিষয়টি রয়েছেই, ১৯৪৭ থেকে তা চলছে। কাশ্মীরে তো বটেই, ভারতের অন্যত্রও বহু মানুষ পাকিস্তানের মদতে পুষ্ট সন্ত্রাসী কার্যকলাপের শিকার হয়েছে। দু’টি দেশের মধ্যে চার বার যুদ্ধ হয়েছে, এবং নয়াদিল্লিকে অস্বস্তিতে ফেলতে ইসলামাবাদ প্রতিটি আন্তর্জাতিক মঞ্চ ব্যবহার করেছে। অন্য দিকে, ভারতের তরফে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার যাবতীয় প্রচেষ্টা— যার মধ্যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দু’টি উদ্যোগকেও ধরতে হবে— বিফল হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, প্রতি বারই পাকিস্তানের দিক থেকে ভারতের দিকে সন্ত্রাসী হামলা ধেয়ে এসেছে।

তা সত্ত্বেও কিছু কথা মনে রাখতে হবে। ভারত নিজেকে ধীরে ধীরে ‘গ্লোবাল সাউথ’, অর্থাৎ তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলির জোটের অবিসংবাদিত নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী বৈরিতার জন্য সে-দেশের অসংখ্য সাধারণ মানুষকে ‘শাস্তি দেওয়ার’ সিদ্ধান্ত তৃতীয় বিশ্বের নেতা ভারতের নেতাসুলভ ভাবমূর্তির সঙ্গে যায় না। আবার দেশের জনমানসে তৈরি হওয়া পাক-বিরোধী মনোভাবের উপর ভিত্তি করে দেশের সরকার বিদেশ নীতি তৈরি করবে, এমন দাবিও বিস্ময়কর। জনসাধারণের মনোভাব দীর্ঘমেয়াদি নীতির দিকনির্দেশক কখনওই হতে পারে না। দলীয় রাজনীতি নয়, দেশের সরকারকে তার উপরে উঠে দীর্ঘমেয়াদি সমাধান খুঁজতে হবে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement