কোভিড-অতিমারির দ্বিতীয় তরঙ্গ ভারত জুড়ে, কিন্তু দেশের কত নাগরিক যে তাতে আক্রান্ত বা প্রভাবিত, সেই চিত্রটা খুব স্পষ্ট নয়। পরিসংখ্যান বলছে, অতিমারির শুরু থেকে এখন পর্যন্ত সংক্রমিতের সংখ্যা আড়াই কোটির দিকে এগোচ্ছে, তিন লক্ষেরও বেশি মানুষ মারা গিয়েছেন। এই হিসেব নিয়ে অবশ্য অনেক বিশেষজ্ঞই সন্দিহান।
এই হিমশীতল পরিসংখ্যান ছাপিয়ে প্রতি মুহূর্তে প্রকট হয়ে উঠছে এই নিষ্ঠুর বাস্তব— কোভিডের জের এসে পড়েছে প্রায় প্রতিটি পরিবারে। রোগগ্রস্ত, অসুস্থ নিকটজনকে অক্সিজেনের বা যথাযথ স্বাস্থ্য পরিষেবার অভাবে ধুঁকতে দেখে অজস্র পরিবার আতঙ্কের শিকার। ভারতের সমাজের ভিতটাই যেন কেঁপে উঠেছে। একুশ শতকে যে এহেন কোনও পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে, মানিয়ে নিতে শিখতে হবে, সেই মানসিক প্রস্তুতি এ সমাজের একেবারেই ছিল না। অক্সিজেনের অভাবে চলে গিয়েছে বহু অমূল্য প্রাণ— এমন এক দেশে, যে কিনা অক্সিজেন বিদেশে রফতানি করে। স্তম্ভিত করে দেয় এই তথ্য: অতিমারির তুমুল বাড়বাড়ন্তের সময়ে বিদেশে অক্সিজেন রফতানি হয়েছে ১০,০০০ মেট্রিক টন, আগের বছরের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি! এ রকম তথ্য একটা নয়, অনেক মিলবে। এ থেকে বোঝা যায়, এই জনস্বাস্থ্যসঙ্কট যে এমন অভূতপূর্ব চেহারা নেবে, দেশের নীতি-নির্ধারকদের তা বোঝার দূরদর্শিতাই ছিল না।
অতিমারি ভারতের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুরবস্থাটাও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। বেহাল স্বাস্থ্যব্যবস্থার যে দুর্বলতাগুলো প্রকট হয়ে উঠেছে, তার মধ্যে অন্যতম হল হাসপাতালে বেডের চরম অভাব— ভেন্টিলেটরের মতো জীবনদায়ী সরঞ্জামের সুবিধাযুক্ত বেডের কথা না-ই বা বললাম। এই অভাব কিন্তু শুধু অতিমারি বলেই নয়, প্রতি বছরেই দেখা যায়, বিশেষত বর্ষার পরে যখন ডেঙ্গি আর চিকুনগুনিয়ার মতো রোগ প্রায় অঘোষিত মহামারির চেহারা নেয়। প্রতি বছরই সেই ভয়ের মরসুম এগিয়ে এলে গুরুতর অসুস্থ রোগীকে নিয়ে পরিবারের সদস্যদের এক হাসপাতাল থেকে আর এক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ছবিটা তাড়া করে বহু মানুষকে। দুর্ভাগ্যজনক, প্রতি বছর এই একই অশনি সঙ্কেত পাওয়ার পরেও কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার, কেউই হাসপাতালে বেডের আকাল মেটাতে, স্বাস্থ্যব্যবস্থার এই বিরাট ফাঁকটা পূরণ করতে উপযুক্ত পদক্ষেপ করার কথা ভাবেই না।
কোভিড-অতিমারির প্রথম তরঙ্গেই কিন্তু স্বাস্থ্য পরিষেবার সার্বিক অব্যবস্থা, বিশেষত হাসপাতালে বেডের চরম অভাবের পূর্বাভাস পাওয়া গিয়েছিল। সরকার তবু তাতে কান দেয়নি। ক্রমাগত কোভিড-সংক্রমণ বৃদ্ধির জেরে হাসপাতালগুলোর উপর বাড়তে থাকা চাপ সামলাতে না পেরে কেন্দ্র ও বহু রাজ্য সরকার বিকল্প ব্যবস্থা তৈরি করে, এমনকি খালি হোটেলগুলোকে সংক্রমিত মানুষদের আলাদা করে রাখার বা গুরুতর অসুস্থ রোগীর চিকিৎসার কাজে লাগানোর বন্দোবস্ত করে। কিন্তু কোভিড-সংক্রমণের সংখ্যা কমতেই এই ব্যবস্থা সরিয়ে ফেলা হয়। ভারতের থেকে অনেক ভাল স্বাস্থ্যব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও বহু দেশ যেখানে এই সঙ্কট মোকাবিলায় নাকানিচোবানি খেয়েছে, সেখানে আমাদের সরকারের ভাবনায় কেন যে কোভিডের দ্বিতীয় তরঙ্গ গুরুত্ব পেল না, বলা কঠিন।
ভারতের স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর নির্দেশকগুলিই বুঝিয়ে দেয়, এই পরিসরটি সবচেয়ে অবহেলিত ক্ষেত্রগুলির একটি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেব অনুযায়ী, ভারতে ২০০৩ সালে প্রতি দশ হাজার মানুষের জন্য হাসপাতালে বেডের সংখ্যা ছিল ৯টি। ২০১৭ সালে সেটা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৫টিতে! ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো উচ্চ-মধ্য আয়ের দেশে এই সংখ্যাটি যথাক্রমে ২৬ ও ৩৫। অর্থাৎ, এই দেশগুলিতে হাসপাতালে বেড পাওয়ার সম্ভাবনা গড়ে ভারতের তুলনায় সাত গুণ।
ভারতের স্বাস্থ্যব্যবস্থার খামতিগুলোর শিকড় রয়েছে জনস্বাস্থ্য খাতে অপ্রতুল ব্যয়ের গভীরে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্টে জানা যাচ্ছে, ২০১৮ সালে ভারত সরকার জনস্বাস্থ্যে যা ব্যয় করেছে, তা জিডিপি-র মাত্র ০.৯৬ শতাংশ— তাও ২০০০ সালের ০.৮ শতাংশ থেকে খানিকটা বেড়ে। ব্রাজিল আর দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে, এই দেশগুলোর স্বাস্থ্য বাজেট বরাদ্দ ভারতের চার গুণ বেশি। উপরন্তু, অতিমারির মুখে পড়ে বিশ্বের বড় বড় অর্থনীতির দেশগুলো যেখানে স্বাস্থ্য পরিষেবার পরিকাঠামো শক্তপোক্ত করেছে, আমাদের কেন্দ্রীয় সরকার সেখানে ২০২০-২১ বাজেটে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বরাদ্দ কমিয়েছে।
যে দেশে সবচেয়ে বেশি দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষের বাস, সে দেশে স্বাস্থ্য পরিষেবাকে যে পাবলিক গুড বা সর্বজনীন পরিষেবা হিসেবে গণ্য করতে হবে, তা বুঝতে বিরাট জ্ঞানগম্যির দরকার পড়ে না। তার অর্থ এই যে, সরকারকে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে টাকা ঢালতে হবে যাতে কোনও নাগরিকই রোগ-অসুখে অবহেলিত না হন। কিন্তু গত তিন দশকে দেখা যাচ্ছে উল্টো চিত্র— স্বাস্থ্য পরিষেবায় বেসরকারি ক্ষেত্রের বাড়বাড়ন্ত। ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে অফিস-এর মতে, ১৯৮৬-৮৭ সালে শহরাঞ্চলে হাসপাতালে-ভর্তির ৬০ শতাংশ ক্ষেত্রেই রোগীদের চিকিৎসা হয়েছিল সরকারি হাসপাতালগুলিতে। গ্রামাঞ্চলে তা ছিল ৫৫ শতাংশ। ২০১৭-১৮ সালে দেখা যাচ্ছে, সরকারি হাসপাতালগুলিতে ভর্তির শতাংশের হিসেব নেমে এসেছে শহরাঞ্চলে ৩৫ ও গ্রামাঞ্চলে ৪৬ শতাংশে। সবচেয়ে চিন্তার, দেশের রাজ্যগুলিতে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবার ভগ্নদশা, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সুযোগসুবিধা পৌঁছতে যে পরিষেবা ব্যবস্থাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ন্যাশনাল হেলথ প্রোফাইল অনুযায়ী, ২০০৯-১৯’এর মধ্যে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, উপকেন্দ্র ও কমিউনিটি হেলথ-এর সংখ্যা বেড়েছে মাত্র ০.২ শতাংশ। উত্তরপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্রের মতো রাজ্যে এই কেন্দ্রগুলির সংখ্যা কমেছে, পশ্চিমবঙ্গে বেড়েছে অতি সামান্য।
দেশে স্বাস্থ্য পরিষেবায় বেসরকারিকরণের বাড়বাড়ন্তের এই প্রবণতায় দেশের এক বিরাট সংখ্যক মানুষ স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সুযোগসুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন মূলত দু’ভাবে। এক, বেসরকারি ক্ষেত্রগুলি এমন এক পরিষেবা-মূল্যের মডেল খাড়া করছে, যা জনকল্যাণমুখী নয়— সেই মডেলের একমাত্র লক্ষ্য সবচেয়ে বেশি মুনাফা অর্জন; যে কোনও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান যে লক্ষ্য নিয়ে চলে। দুই, বেসরকারি ক্ষেত্রগুলি এমন এক বাজার তৈরি করে, যেখানে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সুযোগসুবিধাগুলির জোগান সব সময়েই কম। এতে তাদের বেশি দর হাঁকাতে সুবিধে, আর বেশি লাভ করার লোভটাও বেড়ে চলে ক্রমাগত। এর ফলে, এক জন গড় ভারতীয় তাঁর স্বাস্থ্য-ব্যয়ের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই খরচ করেন নিজের পকেট থেকে, এক জন গড় ব্রাজিলবাসীর খরচ যেখানে এক-চতুর্থাংশ, বা দক্ষিণ আফ্রিকার নাগরিকের ক্ষেত্রে দশ ভাগের এক ভাগ। তাই স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ব্যয় করতে গিয়ে যে ভারতীয় পরিবারগুলি বিরাট ঋণের মুখে পড়ে, তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। কোভিডে এক পরিবারের অনেক সদস্য আক্রান্ত হওয়ায়, অর্থনৈতিক ডামাডোলের জের রোজগারের উপর এসে পড়ায় এই অসহায়তার ছায়া ক্রমেই দীর্ঘতর হচ্ছে।
এই ছায়াই সরে যাবে, যদি কেন্দ্র ও রাজ্য দুই সরকারই অতিমারি থেকে শিক্ষা নিয়ে, সরকারি-বেসরকারি উপাদানের স্বাস্থ্যকর মিশেলে একটা শক্তপোক্ত জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা তৈরি করে। যে রাজ্যগুলো অতিমারি-মোকাবিলায় বেশি সফল, তারা কিন্তু এ ব্যবস্থা করেছে স্থানীয় গোষ্ঠীর মাধ্যমে বিকেন্দ্রীকৃত ব্যবস্থাপনায়। বিশেষজ্ঞরা এখন কোভিডের তৃতীয় তরঙ্গ সম্পর্কে সতর্ক করছেন, প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে শুরু করে গোটা রাজ্যের স্বাস্থ্যব্যবস্থার যথাশীঘ্র উন্নতিকল্পে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এখনই সক্রিয় হওয়া উচিত।
অর্থনীতি বিভাগ, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়