—প্রতীকী চিত্র।
এই কয়েক দিন আগে, ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ গানের কথা বদলানো প্রসঙ্গে নাট্যব্যক্তিত্ব রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত এই পত্রিকাকেই বলেছিলেন, “রবীন্দ্রনাথের কিছু যায় আসে না। যারা এই কাজ করেছে, তাদের তো যায় আসেই না। আমার মনে হয়, কারও কিছুই যায় আসে না।”
মোক্ষম কথা। কিছুতেই কারও যায় আসে না।
চারটি রসুনের দাম ৮০ কেন ৯০ টাকা হলেও কেউ কিছু বলবে না, স্রেফ আলু ভাতে (নুন, তেল ছাড়া) খেতে গিয়ে প্রাণ বেরোলেও বলবে না।
আমাদের সব সয়ে গিয়েছে।
ধরুন রান্নার গ্যাসের দাম যখন বাড়তে শুরু করল, আমরা সকলেই রেগে গেলাম, এক আত্মীয় বলেছিলেন, এর পর গ্যাসের পাইপটা নিজের মুখে ঢুকিয়ে দিতে হবে। তার পর গ্যাসের দাম হাজার টাকা ছাড়াল, আমরা দিতেই লাগলাম মুখ বুজে। দাম কমিয়ে হাজারের নীচে নামানো হলে তো পোয়াবারো। উজ্জ্বলা গ্যাস প্রকল্পে প্রথম সিলিন্ডারটি বাদ দিলে পরেরগুলো যে দাম দিয়ে কিনতে হয়, ভর্তুকি ছাড়াও সেই দাম দিতে যে যে-কোনও উজ্জ্বলার প্রাণ বেরিয়ে যাবে এবং তিনি কাঠকুটোয় ফিরে যাবেন, এটা স্বাভাবিক এবং সরকারি খতিয়ানেও প্রমাণিত, কিন্তু অবাক হয়ে দেখতে হল, অনাস্থা বিতর্কে সে কথার বিন্দুমাত্র উল্লেখ কোনও বিরোধী সাংসদ করলেন না।
আমরা রাগতে ভুলে গিয়েছি। কিছুতেই কিছু আমাদের যায় আসে না। খেতে না পেয়ে, কর্মহীন হয়ে কত লোক সপরিবারে নিজেদের শেষ করে দিচ্ছে, আমাদের কিছু যায় আসে না, পাশের বাড়িতে, পাশের ফ্ল্যাটে তা ঘটলেও আমাদের কিছু যায় আসে না। যত ক্ষণ না আমাদের গলা দিয়ে গ্যাসের পাইপটা ঢুকিয়ে দেবে কেউ না কেউ।
অতিকথন নয়। আমরা কোন দামে কোন খাবারটা কিনব, সেটা চিরকালই অন্য লোকে ঠিক করে দিয়েছে। আমরা কী পরব, কী খাব, কী ভাবে ঘুরব, কী পড়ব, কী পড়তে পারব না, আমরা আদৌ খাব কি না, আমাদের থাকার জায়গা থাকবে কি না, আমরা দেশের নাগরিক কি না, সেটাও অন্য লোকই ঠিক করে দিচ্ছে। আমরা কার সঙ্গে কথা বলব, কী কথা বলব, সেটাও অন্যে নজরদারি করবে। আমরা হ্যাঁ, হ্যাঁ করতে করতে পিঠ বাঁকিয়ে ধুলো চাটতে চাটতে ঘুরে বেড়াচ্ছি।
মেয়েদের পিটিয়ে পুরুষেরা রাগ দেখিয়েছে, সন্তান উৎপাদন করে শখ মিটিয়েছে বরাবর। এখন তাকে চমৎকার মান্যতা দেওয়া হচ্ছে অ্যানিম্যাল-এর মতো ছবি তৈরি করে, যার পরিচালক সগর্বে ঘোষণা করছেন, চড়থাপ্পড় না মারলে আর সম্পর্ক কিসের, আবেগ কিসের? মাল্টিপ্লেক্সমুখী জনতা দ্রুত সেই ছবিকে ৩০০ কোটি টাকার রেকর্ডে পৌঁছে দিচ্ছে, হল ভরিয়ে, করতালিতে হল ফাটিয়ে দিয়ে। এ কি ভয়ঙ্কর নয়?
গাজ়া নামক বধ্যভূমিতে মৃত সন্তানকে কোলে করে বসে রয়েছেন বাবা, তাঁর সামনে শোয়ানো রয়েছে আরও দু’টি শিশু, তবু যুদ্ধ চলছেই, রাষ্ট্রনেতা বলুন কি জনতা, কারও কিছুটি আসে যায় না। যত ক্ষণ না ঘাড়ে এসে কেউ কোপ মারছে। এখন তো মনে হয়, ঘাড়ে কোপ মারলেও মুখ দিয়ে ‘হীরকের রাজা ভগবান’-ই বেরোবে।
সব সয়ে গেছে। আমরা ধরেই নিয়েছি অবস্থা বদলাবে না, বরং আরও ভয়ঙ্কর হবে। ফলে যতক্ষণ প্রাণ আছে, যতটা পারি, যে যে-ভাবে পারি, বেঁচে থাকি। তার পর যে পারবে বাঁচবে, নয়তো মরে যাবে।
টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পরে নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী গবেষণাপত্রে লিখেছিল, কী ভাবে জুনিয়র বুশ বার বার ওই ধ্বংসের ছবিকে দেখিয়ে, ভিতরে আরও ভয় ঢুকিয়ে, তার মধ্যেই স্বাভাবিক হতে বলছেন। মেয়েটি বলছিল, এই নব্যস্বাভাবিকতায় লোকে ভয় নিয়ে বাঁচবে, লোকে প্রতিশোধস্পৃহা নিয়ে বাঁচবে, এটাই প্রেসিডেন্ট চান।
সমাজমাধ্যমের নেশায় আমাদের পছন্দ-অপছন্দ বুঝে, আমাদের লোভ, আশা, ইচ্ছেগুলোকে সুড়সুড়ি দিয়ে ক্রমশ অ্যালগরিদমের জালে বন্দি করে ফেলা হয়, আমরা সজ্ঞানে স্বেচ্ছায় সেখানে প্রবেশ করি আত্মরতির ভয়ঙ্কর সব প্রলোভনকে জড়িয়ে ধরে, এবং ভাবি সেটাই পৃথিবী, তার বাইরে অন্য দৃশ্য নেই, অন্য মত নেই, কিছুই নেই। শুধু আমরা আর আমাদের পছন্দের তৈরি করে দেওয়া জগৎ।
বাস্তবেও তাই। আমরা জেনেই গিয়েছি, জিনিসপত্রের দাম বাড়বে, বাড়বেই, তেল, নুন, চাল, ছেলেমেয়ের স্কুলের ফিজ়, হাসপাতালের খরচ, সব বাড়বে। আর আমরা তা দিতে বাধ্য থাকব, যত দিন পারব, কারণ অন্য পথগুলো, মানুষের বেঁচে থাকার সহজ পথগুলো বন্ধ করে দেওয়া হবে। আমরা হয় যুদ্ধ, নয়তো নতুন নিয়ম, নয়তো দাম বাড়ার ভয়ে গুটিয়ে থাকব। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক, আপনার পাড়ায় পুরসভার জল বন্ধ, পর্যাপ্ত জল পুরসভা দেবে না অতএব আপনি জল কিনে খেতে বাধ্য হবেন। বয়স্ক মানুষের বায়োমেট্রিক মেলে না জেনেও, তাঁদের হাঁটাচলাই মুশকিল জেনেও কখনও আধার, কখনও গ্যাসের জন্য বায়োমেট্রিকের আইন চালু করা হবে, তাঁদের বাড়িতে লোক পাঠিয়ে তাঁদের সাহায্য করার ন্যূনতম ব্যবস্থাও করা হবে না। কারণ শাসক জানেন, এই সুযোগে যত লোক বাদ পড়ে তত মঙ্গল। তাঁরা বৈধ গ্রাহক হলেও। নোটবন্দির সময়ে ব্যাঙ্কের সামনে ফুটপাতে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে আসতে দেখা বয়স্ক মানুষ, করোনার সময়ে ডিম-ভাতের লাইনে দাঁড়ানো মধ্যবিত্ত, সবার ছবি আমাদের মনে করিয়ে দেবে, আবার যদি সেই দিন ফিরে আসে! তার চেয়ে যা বলবে করে দিই! নয়তো রান্নার গ্যাসটা পাব না, বাড়িতে মার্ক্সবাদের বই পেলে পর্যন্ত রাষ্ট্রদ্রোহের আইনে জেলে ঢুকিয়ে দেবে, নয়তো আমাদের চোদ্দো পুরুষের নথি না পেলে ঢুকিয়ে দেবে ডিটেনশন সেন্টারে। মনে পড়ে অসমে তাঁরাই নতুন আটক-কেন্দ্র গড়ে তুলছিলেন ইট-বালি সুরকি বয়ে, যাঁদের উপর বিদেশি হওয়ার খাঁড়া ঝুলছে। কাজ করতে করতে তাঁরা হাসতেন, কোন ঘরটায় কে থাকবেন তা ভেবে।
এই পুরো ব্যাপারটাই স্বাভাবিক। আমাদের সয়ে গিয়েছে। পায়ের চামড়া খসিয়ে গরিব কৃষক দিল্লি পর্যন্ত পৌঁছে গেলেন, কিন্তু সেই আন্দোলনকে আরও জোরদার করে তোলা গেল না, শাসকের মুখে আছড়ে পড়ল না কোনও ঢেউ। যাঁরা পথে বসে থাকার, তাঁরা বসেই থাকলেন শুধু যোগ্য প্রার্থীদের নিয়োগের দাবিতে, আন্দোলন ১০০০ দিনে পড়ল, তাতে কী? আমরা যার যেখানে ভোট দিয়ে চলে এলাম। কারণ সত্যিই কারও কিছু যায় আসে না। এই তো তা-ও খেতে পাচ্ছি দুটো কণা, এর পর যদি না পাই? প্রতিবাদ করলে তো ঘর পুড়িয়ে দেবে!
মন্দির কি পেটের ভাত দেবে? মুখের উপর এই প্রশ্ন তোলার কেউ নেই। বরং মাথায় ইট নিয়ে দৌড়চ্ছি, পেটে ভাত থাক বা না থাক। এই তো জীবন, এই তো স্বাভাবিক জীবন— ভয়, ধর্মের উগ্রতা, চুরি-বাটপাড়ি, অসততা, অশালীন পুরুষকার, বেনিয়ম, খিদে, কর্মহীনতা, এটাই সত্য, কারণ আমরা তা সত্য বলে মেনে নিয়েছি।
হালফিলের একটি আইটেম-গান বলে: ‘সক্কলে জানে রে, কেউ কিছুই বলে না, কেন গোবিন্দ দাঁত মাজে না।’
কারণ আমাদের কাছে সব সমস্যাই ‘আইটেম’।
তাই আমরা বলি না, রাগি না। শুধু শাসকদের ভোট দিয়ে চলি।