গ্রামের নলকূপ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পঞ্চায়েতের। ফাইল চিত্র।
সুন্দরবনের বহু গ্রামে পানীয় জলের তীব্র অভাব এলাকার বাসিন্দাদের, বিশেষত মেয়েদের কতখানি বিপর্যস্ত করছে, তা কারও অজানা নয়। দু’তিন কিলোমিটার হেঁটে জল আনতে মেয়েদের সময়, জীবনীশক্তি ক্ষয় হয়, জলের স্বল্পতা এবং অপরিচ্ছন্নতার জন্য অসুখ দেখা যায়। গ্রামের নলকূপ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পঞ্চায়েতের, কিন্তু সেগুলো ঘন-ঘন খারাপ হয়, অকেজো হয়ে পড়ে থাকে। এই সঙ্কট থেকে উত্তরণের পথ পাচ্ছে না অধিকাংশ গ্রাম।
অথচ, কাকদ্বীপের দক্ষিণ হরিপুর অঞ্চলের একটি নলকূপ দীর্ঘ ১৯ বছরেও তার কর্মক্ষমতা হারায়নি। নতুন কলের মতোই ঝাঁ-চকচকে রয়েছে। এটিই একমাত্র উদাহরণ নয়, সাগর, নামখানা, পাথরপ্রতিমা ও কাকদ্বীপ অঞ্চলে নলকূপকে ঘিরে বহু গ্রাম পানীয় জলে স্বাবলম্বী হয়েছে। প্রতিটি গ্রামেই নলকূপ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছেন মেয়েরা। এখন পঞ্চায়েতগুলিও জানতে চাইছে, কী করে এটা সম্ভব হল?
কাকদ্বীপের মুন্ডা পাড়ার লক্ষ্মী রানি হালদার, মৌমিতা দেবসিংহের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, একটি অসরকারি সংস্থার উদ্যোগে ২০০৪ সালে দক্ষিণ হরিপুরে একটি নলকূপ স্থাপন করা হয়। প্রতিটি পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতি সম্মতিতে স্থির হয়, এই নলকূপ সুরক্ষা কমিটি পরিচালনা করবে বারো জন মহিলা নিয়ে গঠিত একটি কমিটি। রক্ষণাবেক্ষণের টাকা আসবে মাসিক চাঁদার ভিত্তিতে, তখন যার অঙ্ক ছিল পরিবারপিছু মাসিক তিন টাকা (এখন তা বেড়ে হয়েছে পাঁচ টাকা)। নলকূপের অপব্যবহার রুখতেও কিছু শর্ত ছিল, যা সকলকে স্বীকার করতে হত। ২০০৪ সালে মেয়েদের একটি দল তৈরিতে যে কাজের সূচনা, ২০২৩ সালে তা ডালপালা মেলেছে— নলকূপ রক্ষণাবেক্ষণকারী দলের সংখ্যা এখন বাহান্ন। সাগর, নামখানা, পাথরপ্রতিমা ও কাকদ্বীপের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঁচশোরও বেশি মহিলার তত্ত্বাবধানে বাহান্নটি নলকূপ কাজ করছে। যেখানে নানা গ্রামে দেখা যায়, পঞ্চায়েতের নলকূপ মেরামতির অভাবে দিনের পর দিন খারাপ হয়ে পড়ে রয়েছে, সেখানে নলকূপ সুরক্ষা কমিটির অধীন প্রতিটি নলকূপই কাজ করছে। পরিস্রুত জলের জন্য অসুখ কমেছে, অপুষ্টি কমেছে বলে দাবি করলেন সুরক্ষা কমিটির সদস্যরা।
পাশাপাশি রয়েছে সীমাবদ্ধতাও। এলাকার বাসিন্দাদের উদ্যোগে এবং চাঁদায় নলকূপ স্থাপন করলে তা ভাল কাজ করছে, এটা দেখা সত্ত্বেও সব অঞ্চলের মানুষ এতে উৎসাহিত হননি। কাকদ্বীপ অঞ্চলে মাত্র পাঁচটা পঞ্চায়েত, পাথরপ্রতিমা অঞ্চলে ছ’টা পঞ্চায়েতের মানুষ এগিয়ে এসেছেন। এই প্রকল্পের সঙ্গে দীর্ঘ দিন যুক্ত সমাজকর্মী জ্ঞানপ্রকাশ পোদ্দার বলেন, “অনেকেই মনে করেন, জলের জন্য নিজের টাকা খরচ করব কেন? নলকূপ বসানোর দায়িত্ব তো নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির।” পঞ্চায়েত ব্যবস্থা থেকে অবশ্য নলকূপ কমিটিগুলি সর্বদাই সহযোগিতা পেয়েছে। ২০১২ সালের একটি ঘটনা খুব আনন্দের সঙ্গে মনে করেন কমিটির সদস্যরা। সে বার একটি সম্মেলনে নলকূপ কমিটির সঞ্চিত টাকায় দক্ষিণ হরিপুরে দ্বিতীয় একটি নলকূপ বসানোর সিদ্ধান্ত হয়েছিল। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিধায়ক মন্টুরাম পাখিরা। তিনি পঞ্চায়েতের অর্থে সেই নলকূপ বসানোর সিদ্ধান্ত তখনই ঘোষণা করে দেন, এবং সে কাজটি হয়েও যায়।
একটি চারাগাছ যেমন স্নেহময়ী হাতের যত্নে মহীরুহ হয়ে সকলকে ছায়া দেয়, তেমনই একটি নলকূপও এই গ্রামগুলিতে সার্বিক উন্নয়নের পথ হয়ে উঠেছে। নলকূপকে কেন্দ্র করে সংগঠিত হওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে শুরু হয়েছে অন্য উদ্যোগও। নলকূপ সুরক্ষা কমিটির সঙ্গে যুক্ত মহিলারা স্বনির্ভর গোষ্ঠী গঠন করেছেন, সদস্য সংখ্যা এখন তিন হাজার। তাঁরা স্বল্প সুদে ঋণ নিয়ে সন্তানের পড়াশোনা চালাচ্ছেন, ঘরবাড়ি মেরামত, চিকিৎসা করাচ্ছেন। মুরগি বা ছাগল প্রতিপালন, মাছ চাষ, আনাজ চাষ করছেন অনেকে। লক্ষ্মী, মৌমিতা, মানসী, সুমিত্রারা জানালেন, আগে ঘরে কেউ অসুস্থ হলে মহাজনদের কাছে ছুটতে হত, চড়া সুদে ঋণ নিয়ে চিকিৎসা করানোর জন্য। এখন আর মহাজনদের কাছে হাত পাততে হয় না। আগে টিপ সই দিয়ে যাঁরা কাজ চালাতেন, এখন তাঁরা অনেকে সই করতে, পড়তে ও লিখতে শিখেছেন। শিশুদের স্বাস্থ্যরক্ষায় এই মেয়েরা নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে টিকা নেওয়ার কথা ঘরে ঘরে জানাচ্ছেন, প্রচার করছেন মেয়েদের ঋতুকালীন স্বাস্থ্যসুরক্ষার কথাও। শিশু ও নারীপাচার রোধে, নাবালিকা বিবাহ রোধেও এগিয়ে আসছেন নানা গ্রামের নলকূপ সুরক্ষা কমিটির মেয়েরা।
কোভিড অতিমারির সময়ে ৬৮টি পরিবারকে এককালীন ৬০০০ টাকা করে অনুদান দেওয়া হয়েছিল দক্ষিণ হরিপুর নলকূপ সুরক্ষা কমিটির পক্ষ থেকে, নিজেদের সঞ্চিত অর্থ থেকেই। সুস্থায়ী উন্নয়ন, আর গ্রামের মানুষের যোগদানের মাধ্যমে উন্নয়ন, এই দু’টি আদর্শের বাস্তব রূপ কেমন হতে পারে, তার কিছুটা আন্দাজ হয় কাকদ্বীপের এই পঞ্চায়েতটিতে।