একশো বছর আগে অবিবেচনায় তৈরি হয়েছিল বিপদ
Germany

‘ঝুঁকিহীন’ সিদ্ধান্তের কুফল

দ্বিতীয় গল্পটি তিন সদস্যের একটি পরিবারের। নিজেদের বিলাসবহুল বাড়ি বিক্রি করে সেই বাবদ প্রাপ্ত অর্থ সঙ্গে নিয়ে পরিবারটি পৌঁছেছে বন্দরে— জাহাজে চেপে দেশান্তরি হওয়ার বাসনা।

Advertisement

পুনর্জিৎ রায়চৌধুরী

শেষ আপডেট: ২৩ জুন ২০২৩ ০৫:২৪
Share:

মূল্যহীন: নোটের বান্ডিল দিয়ে খেলাঘর বানাচ্ছে শিশুরা। ১৯২৩, জার্মানি। গেটি ইমেজেস।

এক দিন বিকেল চারটের সময় একটি কফি শপে ঢুকে মেনু দেখে এক কাপ কফির অর্ডার দিলেন এক সাহেব। সেটা শেষ করে, বিকেল পাঁচটায়, আরও এক কাপ কফির অর্ডার দেন তিনি। দ্বিতীয় কাপ কফি শেষ করে বিল মেটাতে ক্যাশ কাউন্টারে পৌঁছে সাহেবের চোখ ছানাবড়া। দু’কাপ কফির দু’রকম দাম! প্রথম কাপ কফির দাম মেনুতে যে দাম উল্লিখিত ছিল তা-ই, কিন্তু দ্বিতীয় কাপ কফির দাম প্রথম কাপ কফির দামের তুলনায় দ্বিগুণ! ক্যাশিয়ার জানালেন, “বিকেল চারটে থেকে পাঁচটার মধ্যে কফির দাম ডাবল হয়ে গিয়েছে, স্যর!”

Advertisement

দ্বিতীয় গল্পটি তিন সদস্যের একটি পরিবারের। নিজেদের বিলাসবহুল বাড়ি বিক্রি করে সেই বাবদ প্রাপ্ত অর্থ সঙ্গে নিয়ে পরিবারটি পৌঁছেছে বন্দরে— জাহাজে চেপে দেশান্তরি হওয়ার বাসনা। কিন্তু জাহাজের টিকিট কাটতে গিয়ে পরিবারের প্রধান স্তম্ভিত— বাড়ি বিক্রি বাবদ প্রাপ্ত যে অর্থ তাঁর পকেটে রয়েছে, তা তাঁদের তিন জনের সেকেন্ড ক্লাসের টিকিট কাটার পক্ষেও যথেষ্ট নয়! গত কয়েক দিনে জাহাজের টিকিটের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে এতটাই।

আষাঢ়ে গল্প নয়— বস্তুত, গল্পই নয়, দু’টিই সত্যি ঘটনা। দু’টি ঘটনাই ঘটেছিল আজ থেকে ঠিক একশো বছর আগে, জার্মানিতে— সে দেশটি তখন ইতিহাসের অন্যতম ভয়ঙ্কর হাইপার-ইনফ্লেশন বা অতি-মূল্যবৃদ্ধির কবলে পড়েছিল। কতখানি ভয়াবহ ছিল সেই সময়টা? দৈনিক সংবাদপত্রের দামের পরিবর্তন লক্ষ করলেই সেটা বোঝা যায়। ১৯২১-এর জানুয়ারিতে যে সংবাদপত্রের দাম ছিল ০.৩০ মার্ক, ১৯২২-এর মে-তে তার দাম বেড়ে ১ মার্ক হয়, অক্টোবরে সেই দাম হয় ৮ মার্ক, ১৯২৩-এর জানুয়ারিতে ১০০ মার্ক, সেপ্টেম্বরে ১০০০ মার্ক, অক্টোবরে ২০০০ মার্ক, নভেম্বরের শুরুতে ১.৫ কোটি মার্ক এবং নভেম্বরের শেষে ৭ কোটি মার্ক!

Advertisement

স্প্যানিশ সংবাদপত্র লা ভেউ দে ক্যাতালুনিয়া-র সাংবাদিক ইউগেনি জ়্যামার জার্মানিতে কর্মরত ছিলেন সেই সময়। ১৯২৩-এর ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত তাঁর একটি প্রতিবেদনে ধরা আছে অতি-মূল্যবৃদ্ধির ভয়াবহতার কথা, “ট্রামের টিকিট থেকে শুরু করে গরুর মাংস, থিয়েটারের টিকিট থেকে শুরু করে স্কুলের বইপত্র, সংবাদপত্র, চিনি, বেকন— সমস্ত কিছুর দামই প্রতি সপ্তাহে বাড়ছে। ফলে মানুষ জানে না যে, তাদের হাতে যা অর্থ আছে, তা দিয়ে কত দিন চলবে। চূড়ান্ত আতঙ্কের মধ্যে দিনযাপন করছে সবাই; খাওয়া-দাওয়া এবং বেচা-কেনা ছাড়া অন্য কিছু নিয়েই ভাবছে না...।”

জার্মানিতে এই ভয়ঙ্কর অতি-মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছিল কেন? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে আরও ন’বছর পিছিয়ে যেতে হবে। ১৯১৪-র অগস্ট মাস, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সবে শুরু হয়েছে। জার্মানি সিদ্ধান্ত নিল যে, যুদ্ধের জন্য সরকারের যে বিপুল খরচ হবে, তা মেটানো হবে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি করার চেষ্টা করে নয়, বেশি করে নোট ছাপিয়ে! এর ফলে জার্মান অর্থব্যবস্থায় নগদের জোগান বাড়ল নাটকীয় ভাবে— যেখানে ১৯১৩ সালে নগদের জোগান ছিল ১৩০০ কোটি মার্ক, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে তা পৌঁছল ৬০০০ কোটি মার্কে। অর্থনীতির একেবারে গোড়ার তত্ত্ব বলে যে, অর্থব্যবস্থায় যদি অর্থের জোগান বাড়ে, অথচ পণ্য ও পরিষেবার উৎপাদন বৃদ্ধি না পায় (অথবা অর্থের জোগানের তুলনায় কম হারে বাড়ে), তার ফল হল মূল্যবৃদ্ধি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ঠিক তা-ই হল জার্মানিতে।

১৯১৮-য় যুদ্ধ শেষ হল। মিত্রশক্তির কাছে পরাজিত হল কেন্দ্রীয় শক্তি, যার অংশ ছিল জার্মানি। এর ফলে, ভার্সাই চুক্তি অনুযায়ী বিপুল অঙ্কের যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ ধার্য করা হল জার্মানির উপরে। ঠিক হল, এই ক্ষতিপূরণ দিতে হবে সোনা কিংবা বৈদেশিক মুদ্রায়। জার্মানির কোষাগারে যা সোনা এবং বৈদেশিক মুদ্রা ছিল, ক্ষতিপূরণের সম্পূর্ণ পরিমাণ মেটানোর জন্য তা যথেষ্ট ছিল না। ফলে বাধ্য হয়েই জার্মানি বৈদেশিক মুদ্রা ক্রয় করতে শুরু করল মার্ক ব্যবহার করে।

কোনও দেশে মূল্যবৃদ্ধি ঘটার অর্থ, সেই দেশের মুদ্রার ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া— আগে একটা একশো টাকার নোটে যে পরিমাণ পণ্য কেনা যেত, মূল্যবৃদ্ধি ঘটলে একশো টাকায় তার চেয়ে কম পরিমাণ পণ্য মিলবে। অন্য দেশে যে-হেতু একই হারে মূল্যবৃদ্ধি ঘটে না, ফলে সে দেশগুলির মুদ্রার ক্রয়ক্ষমতাও কমে না— ফলে, সেই বৈদেশিক মুদ্রার সাপেক্ষে মূল্যবৃদ্ধির শিকার দেশটির মুদ্রার দাম কমে যায়। জার্মানির ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটল, বিদেশি মুদ্রার সাপেক্ষে মার্ক-এর দাম পড়ে গেল অনেকটা। অতএব ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য বৈদেশিক মুদ্রা কিনতে গিয়ে কোষাগার থেকে বিপুল অর্থ বেরিয়ে গেল। তার উপরে বিপদ, ক্ষতিপূরণের কিস্তি মেটানোয় খানিক দেরি হওয়ায়, ১৯২৩-এ ফরাসি ও বেলজিয়ান সৈন্যবাহিনী জার্মানির রুহ অঞ্চলের দখল নিল। রুহ ছিল জার্মানির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শিল্পাঞ্চল— কাঠ, কয়লা ইত্যাদির জন্য প্রসিদ্ধ। এই অঞ্চলটি সম্পূর্ণ থমকে যাওয়ায় জার্মানির রাজস্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস শুকিয়ে গেল।

এই অবস্থায় সরকারি খরচ চলবে কী করে? অতএব, ন্যাড়া আবার বেলতলায় গেল— সরকার ঠিক করল যে, আবার নোট ছাপবে। আবারও নগদের জোগান বৃদ্ধি পেল অর্থনীতিতে। মূল্যবৃদ্ধির পরিস্থিতি বদলে গেল অতি-মূল্যবৃদ্ধির পরিস্থিতিতে। দেশ জুড়ে অরাজকতা, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের জন্য হাহাকার। এই আবহে জার্মানদের খানিকটা স্বস্তি দিতে অস্থায়ী ব্যবস্থা হিসাবে জার্মান সরকার আরও এক বার নোট ছেপে অর্থের জোগান বৃদ্ধি করার সিদ্ধান্ত নিল। বলা হল যে, এর ফলে মানুষের হাতে অর্থ পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে, যা ব্যবহার করে মানুষ দৈনন্দিন কেনাকাটা করতে পারবেন, সমস্যার কিছুটা সুরাহা হবে। ১৯২৩-এর মাঝামাঝি, দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলি ৩০টিরও বেশি কাগজের কারখানা এবং প্রায় ১৮০০টি ছাপাখানা ব্যবহার করে নোট ছাপা শুরু হল। অচিরেই জার্মানি জুড়ে দেখা দিল নোটের বন্যা। এর ফলে অতি-মূল্যবৃদ্ধি সমস্যার কোনও সুরাহা তো হলই না, বরং তা আরও বীভৎস রূপ ধারণ করল।

১৯২৩-এর শেষ দিক থেকে বিভিন্ন কারণে এই পরিস্থিতির উন্নতি হতে শুরু করল। প্রথমত, রাজস্ব ঘাটতি কমাতে জার্মান সরকার সরকারি কর্মচারীদের এক-তৃতীয়াংশকে ছাঁটাই করার সিদ্ধান্ত নিল। দ্বিতীয়ত, জার্মানির উপর ধার্য ক্ষতিপূরণ কিছু দিনের জন্য স্থগিত রাখা হল, এবং তার পর সেই ক্ষতিপূরণের অঙ্ক কিছুটা কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। তৃতীয়ত, পুরনো কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক রাইখসব্যাঙ্ক-এর জায়গায় জার্মানি গঠন করল নতুন কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক রেন্টেনব্যাঙ্ক। রেন্টেনব্যাঙ্ক জানাল যে, আর নোট ছেপে সরকারি খরচ চালানোর প্রশ্ন নেই। মার্ক মূল্যহীন হয়ে পড়ায় নতুন জার্মান মুদ্রাও চালু করল রেন্টেনব্যাঙ্ক, যার নাম দেওয়া হল রেন্টেনমার্ক।

হিটলারের উত্থানের পিছনে এই অতি-মূল্যবৃদ্ধির ভূমিকা ছিল। অনেক অর্থনীতিবিদের মতে, অতি-মূল্যবৃদ্ধির দরুন ভেঙে পড়া গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা সমাজে চরমপন্থী রাজনৈতিক ভাবনাচিন্তার পরিসর তৈরি করে দিয়ে নাৎসিদের পথ প্রশস্ত করেছিল।

একশো বছর আগের জার্মানির অতি-মূল্যবৃদ্ধি পর্ব থেকে একাধিক শিক্ষা নিতে পারি আমরা। তার মধ্যে একটি হল এই যে, মূল্যবৃদ্ধির দৈত্য যদি এক বার প্রদীপের বাইরে বেরিয়ে পড়ে, সে যে কতটা বীভৎস আকার ধারণ করতে পারে, তা কেউ বলতে পারে না। মূল্যবৃদ্ধির বর্তমান আবহে এই শিক্ষাটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তবে সবচেয়ে বড় শিক্ষা— ভবিষ্যতের কথা চিন্তা না করেসরকার যদি কোনও সহজ এবং রাজনৈতিক ভাবে কম ঝুঁকিপূর্ণ আর্থিক নীতি গ্রহণ করে (আমাদের মতো দেশে যা হামেশাই হয়ে থাকে), তা হলে অর্থনীতিতে নামতে পারে ভয়াবহ ধস। সেই ধসে চোখের নিমেষে অতলে তলিয়ে যেতে পারে একটি গোটা দেশ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement