—প্রতীকী চিত্র।
বম্বে তখনও মুম্বই হয়নি। এলফিনস্টোন হাই স্কুল-এ অঙ্কের ক্লাস চলছে। শেষ সারির এক ছাত্রকে শিক্ষক বোর্ডে অঙ্ক কষতে ডাকলেন। ছাত্র যত সামনে এগোয়, অন্য ছাত্রদের মধ্যে হুড়োহুড়ি শুরু হয়। বোর্ডের পিছনে রাখা টিফিনবক্সগুলো সরিয়ে ফেলতে হবে জলদি। কারণ যে এগিয়ে আসছে চক হাতে, সে ‘অস্পৃশ্য’। সে এক জন দলিত ছাত্র। ছাত্রটি কিন্তু নির্বিকার। অঙ্ক কষতে তার হাত কাঁপে না। আগে তাকে স্কুলেই ঢুকতে দেওয়া হত না। পরে যাও বা এক স্কুলে জায়গা হল, তাও আলাদা ঘরে বসতে হত বাকি পাঁচ জন দলিত ছাত্রের সঙ্গে। শেষে একই ক্লাসঘরে প্রবেশাধিকার মিললেও বসতে হত মেঝেতে, পাটের বস্তা বিছিয়ে। কাজেই তাকে বোর্ডের দিকে যেতে দেখলে ছোঁয়া লাগার ভয়ে সকলে তো ছোটাছুটি করবেই। সেই ছাত্রের নাম ছিল ভীম, যাঁকে আমরা স্বাধীন ভারতের সংবিধানের প্রধান নির্মাতা বি আর আম্বেডকর পরিচয়ে চিনেছি।
গত ৮ সেপ্টেম্বর রাজস্থানের ভরতপুরে ভীমনগর সরকারি স্কুলে ঘটে গেল এমনই এক ঘটনা। প্রার্থনা শেষ হওয়ার পর সপ্তম শ্রেণির এক জন ছাত্রের— ১২ বছর বয়স— খুব জলতেষ্টা পায়। পড়ুয়াদের জন্য নির্ধারিত ট্যাঙ্কে জল ছিল না। কয়েক জন ছাত্রের সঙ্গে সেও শিক্ষকদের পাত্র থেকে জল খেয়েছিল। খবর কানে গেলে শিক্ষক গঙ্গারাম গুর্জর রুদ্রমূর্তি ধরে সব ছাত্রের জাত জানতে চান। তার পর এই ছাত্রকে মারতে শুরু করেন। কিল, চড়, পদাঘাত কিছুই বাকি থাকে না। ছাত্রের পরিবারের অভিযোগ, সে দলিত জানার পরই শুরু হয় প্রহার। পুলিশ শিক্ষকের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করেছে। তবে যে দেশে শিক্ষিকা সংখ্যালঘু ছাত্রকে চড় মারতে অন্য শিক্ষার্থীদের আদেশ দেন, সেই দেশে এই দলিত ছাত্রের সুবিচার পাওয়ার আশা তেমন উজ্জ্বল নয়।
জাতের নামে বজ্জাতির সামন্ততান্ত্রিক সমাজে ১৮৫০ সালের ‘বর্ণ প্রতিবন্ধী অপসারণ’ আইন থেকে শুরু করে ১৯৮৯ সালের ‘দ্য শেডিউলড কাস্টস অ্যান্ড দ্য শেডিউলড ট্রাইবস (প্রিভেনশন অব অ্যাট্রসিটিজ় অ্যাক্ট)’, কোনওটাই তেমন কাজে আসে না। কারণ, উচ্চবর্ণের অত্যাচারে আজ দলিত মানুষগুলির জীবন দুর্বিষহ। তাঁরা কী পরবেন, কী করবেন, কোথায় বসবেন, কোথায় খাবেন, এমন সব নিতান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপারে নিজ মতকে প্রাধান্য দেওয়ার অপরাধে ব্রাহ্মণ্যবাদী উচ্চবর্ণের হাতে প্রহৃত, এমনকি নিহত হন। মায়াবতী, মীরা কুমার, জগজীবন রাম, কে আর নারায়ণন, রামনাথ কোবিন্দ প্রমুখের নাম ক্ষমতার সিংহাসনে যতই ‘কোটা’ পূরণ করে যাক, আজকের ভীমদের সুস্থ শিক্ষাজীবন দিতে ভারত অনেকাংশেই ব্যর্থ। সবচেয়ে বড় কথা, ভবিষ্যৎ সমাজের কারিগরদের সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতার মূল্য বোঝানোর দায়িত্ব যে শিক্ষকদের, তাঁরাই বৈষম্যের ঝান্ডাকে গগনচুম্বী করে তুলে জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য প্রতিষ্ঠিত জনগণের ‘গণতান্ত্রিক’ ভারতকে অর্থহীন করে দিতে মরিয়া।
গত অগস্টেই রাজস্থানে দশম শ্রেণির দলিত ছাত্র গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে। অভিযোগ, এক শিক্ষকের দ্বারা শারীরিক ও মানসিক ভাবে নির্যাতিত হয়ে সে যখন প্রধান শিক্ষককে জানায়, তিনি বোঝান যে, ছোট জাত হলে এমন কথা শুনতেই হবে। উপরন্তু, ছাত্রটিকে ফেল করানোর ভয়ও দেখান। সে বছরই বালক ইন্দ্র কুমারের হত্যার খবর কাগজে উঠেছিল। সেও শিক্ষকের জলপাত্র থেকে জল খাওয়ার অপরাধে। দলিত নিপীড়নে ‘রাফ অ্যান্ড টাফ’ উত্তরপ্রদেশ অবশ্য রাজস্থানকে যোগ্য টক্কর দেয়। মাহোবা জেলার বুনিয়াদি বিদ্যালয়ে জলপাত্র স্পর্শ করার ‘অন্যায়’ সহ্য করতে না পেরে সপ্তম শ্রেণির দলিত ছাত্রীকে শিক্ষক বেদম মেরেছিলেন ২০২২-এর মে মাসে। ডাবল ইঞ্জিন সরকার পরিচালিত উত্তরপ্রদেশের ছাত্র নিখিল দোহরের কথাও ভোলা যায়নি। আদর্শ ইন্টার কলেজ-এর সেই ছাত্র পরীক্ষায় কিছু ভুল উত্তর লিখেছিল বলে ‘ঠাকুর’ শিক্ষক অশ্বিনী সিংহ তাকে এমন মারেন যে সে হাসপাতালে মারা গিয়ে এই দলিত জীবনের সব পরীক্ষার দায় চুকিয়ে দেয়।
“এম ফিল/ পিএইচ ডি-তে ভর্তির ক্ষেত্রে সমানাধিকার নেই, মৌখিক পরীক্ষাতেও বৈষম্য। শুধুই সমতাকে অগ্রাহ্য করা হচ্ছে। প্রান্তিকদের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। সমানাধিকার থেকে বঞ্চিত করার অর্থ সব কিছু থেকেই বঞ্চিত করা।” এই হল জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়-এর গবেষক, দলিত ছাত্র মুথুকৃষ্ণন জীবনন্তমের শেষ ফেসবুক পোস্ট (২০১৭) যেটি পুলিশের বয়ানে তিনি ‘ব্যক্তিগত কারণ’-এ আত্মহত্যার কিছু আগে করেছিলেন। এই ছাত্র হায়দরাবাদের কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দলিত ছাত্র রোহিত ভেমুলার আত্মহনন বিষয়েও সরব ছিলেন।
ভারতের জনগণের প্রায় ১৭% (২০১১-র জনশুমারি অনুযায়ী) অর্থাৎ কুড়ি কোটিরও বেশি মানুষ দলিত সম্প্রদায়ভুক্ত। অথচ দেশে শিক্ষা মানুষের আইনসঙ্গত অধিকার হওয়া সত্ত্বেও দলিত মানুষের সাক্ষরতার হার দেশের গড় সাক্ষরতার হারের চেয়ে অনেকটাই কম। আর উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে তাঁদের যে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়, তা শুধু আর্থিক বা সামাজিক নয়, সাংস্কৃতিকও। আইআইটি থেকে সর্বাধিক ড্রপ আউট হন দলিত শিক্ষার্থী। আইআইএম, এনআইটি, আইআইটি ইত্যাদিতে ২০১৪-২০২১’এর মধ্যে ঘটা আত্মহত্যার ৬৮% সংরক্ষিত আসনের শিক্ষার্থীরাই করেছেন।
সপ্তম শ্রেণির ছাত্র স্কুল থেকে বাড়ি ফিরল ফোলা মুখ আর রক্তঝরা নাক নিয়ে। শিক্ষক মেরেছেন বেতন দিতে না পারায়। দশ দিনের মধ্যেই মারা গেল। সাল ২০২২, রাজ্য উত্তরপ্রদেশ, জেলা শ্রাবস্তী। মাত্র আড়াইশো টাকা মাইনে দিতে পারেনি সে। ‘ইন্ডিয়া’ বা ‘ভারত’— দলিত ছাত্রের প্রাণের দাম আড়াইশোর উপর ওঠে না।