ওটিটি যুগে যখন সিনেমা দেখতে এমনকি টিভিও লাগে না
Film Festival

আবার সিনেমাহলের দিকে

বড় পর্দা আর ওটিটি-র সম্পর্কটা অনেকটাই সাপে-নেউলের মতো মনে হচ্ছিল এত দিন। সেটা যে ঠিক নয়, সরাসরি এ কথা বলার সময় আসেনি।

Advertisement

জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৩ নভেম্বর ২০২২ ০৬:২৩
Share:

পরিবর্তন? বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উৎসবে হাওয়া ছবিটি দেখতে নন্দন চত্বরে দীর্ঘ লাইন। ২৯ অক্টোবর। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

সাতসকাল থেকে নন্দনের বাইরে ঠায় লাইন। পদ্মাপারের তারকার জন্য সমবেত উল্লাস। সমাজমাধ্যম জুড়ে উচ্ছ্বাস-আলোচনার দামাল হাওয়া। নাটক থেকে সিনেমায় রূপকথার যাতায়াত।

Advertisement

বাংলা সিনেমাকে ঘিরেই এই সব কিছু। গল্প হলেও যা সত্যি। বাংলা ছবির বাজার এই মুহূর্তে ঠিক কেমন, কোন ছবির কত ব্যবসা, এ সব চুলচেরা হিসাব থাক। কিন্তু বাংলা ছবিকে ঘিরে কমবয়সি ছেলেমেয়েরাও দলে দলে হুল্লোড়ে মাতছে, হল ভরাচ্ছে, ফেসবুক-ইউটিউবে ঝড় তুলছে, এমন মুহূর্ত চোখের সামনে দেখলে উত্তেজিত লাগে বইকি! সদ্যসমাপ্ত বাংলাদেশের চলচ্চিত্র উৎসবে হাওয়া’র প্রদর্শন আর প্রেক্ষাগৃহে বল্লভপুরের রূপকথার মুক্তি একযোগে এই মুহূর্তটির জন্ম দিল। এ কথা বলার অর্থ এ নয় যে, সাম্প্রতিক অতীতে বাংলা ছবি ঘিরে উৎসাহ আর কখনও দেখা যায়নি। বিশেষত এই বছরই অপরাজিত-কে কেন্দ্র করে যে উদ্বেলতা গড়ে উঠেছিল, তার রেশ এখনও অক্ষুণ্ণ। তবে একই সঙ্গে দুই বাংলার দুই ছবিকে ঘিরে, দুই বাংলার দুই পরিচালকের বড় পর্দার প্রথম ছবিকে ঘিরে উদ্দীপনা, এমন লগ্ন আগে বেশি আসেনি। আসেনি বলেই বাংলা ছবির ভবিষ্যতের পাশাপাশি বড় পর্দার ভবিষ্যৎ নিয়েও কিঞ্চিৎ আশার সঞ্চার হয়।

বড় পর্দা আর ওটিটি-র সম্পর্কটা অনেকটাই সাপে-নেউলের মতো মনে হচ্ছিল এত দিন। সেটা যে ঠিক নয়, সরাসরি এ কথা বলার সময় আসেনি। কিন্তু কিছু সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে, এটুকু হয়তো বলা যায়। হাওয়া-র সাফল্য অন্তত এ পারের নিরিখে তার একটা বড় নজির। সকলেরই জানা আছে, ওটিটি এসে বড় পর্দাকে যে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছিল, অতিমারি পর্বে তা বৃহদাকার রূপ নেয়। সাবেক সিনেমা হলগুলোর যে ক’টি টিমটিম করে চলছিল, করোনায় তাদের অনেকেরই ডেথ সার্টিফিকেট লেখা হয়ে যায়। ঘরে বসে যেতে অভ্যস্ত মানুষ, মোবাইলে ‘কনটেন্ট’ দেখতে অভ্যস্ত মানুষ, পকেটে টান পড়া মানুষকে মাল্টিপ্লেক্সেও কতটা ফেরানো যাবে, সংশয় ছিল যথেষ্ট।

Advertisement

এর আগে টেলিভিশনও বড় পর্দাকে জোর ধাক্কা দিয়েছিল। কিন্তু সেই প্রক্রিয়াটা ছিল অনেক দীর্ঘ। তার অনেকগুলো ধাপ। প্রথমত, টেলিভিশন আসা আর আক্ষরিক অর্থে ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ার মধ্যে বেশ কয়েক বছরের ব্যবধান। এ বাংলায় আশির দশকের মাঝামাঝিতেও বড় ম্যাচের দিন পাড়ার কোনও কোনও বাড়ির সামনে চটি-জুতোর পাহাড় জমত। যাঁদের বাড়িতে টিভি নেই, তাঁরা পড়শির বাড়িতে জড়ো হতেন। ছবি তখন বরাদ্দ সপ্তাহান্তে দু’টি। একটি বাংলা, একটি হিন্দি। সুতরাং, নতুন ছবি মুক্তি পাওয়ার সঙ্গে এই ব্যবস্থার সংঘাত খুব একটা ছিল না। বেসরকারি চ্যানেল আসার সঙ্গে একটা বড় পরিবর্তন হল— ছবির বরাদ্দ গেল বেড়ে। এখন থেকে সপ্তাহে রোজই ছবি দেখার সুযোগ আছে। দিনের নানা সময়ে ছবি দেখার সুযোগ আছে। দূরদর্শনেও এ বার ছবির নিত্য সম্প্রচার। সেই সঙ্গে ভিডিয়ো পার্লারের রমরমা। ফলে ছবির জন্য চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করার দিন ফুরোল। কিন্তু তখনও নতুন ছবি দেখতে হলে, অন্তত আইনসম্মত উপায়ে দেখতে হলে হল-এ যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। নতুন ছবির স্যাটেলাইট স্বত্ব বিক্রির জোয়ার এসে এই ব্যবস্থাতেও দাঁড়ি পড়ল। মধ্যবিত্তের জীবনে একটি নতুন সংলাপের আবির্ভাব হল— ‘টিভিতে দিলে দেখব’। সবাই জেনে গেল, ছবি এসেছে বলেই দৌড়ে যাওয়ার দরকার নেই। ক’দিন অপেক্ষা করলেই ঘরে বসে বাড়তি টাকা খরচ না করে টিভিতে দেখা যাবে। এর সঙ্গে আরও অনেক আগে থেকেই যুক্ত হয়ে রয়েছে আরও দুটো জিনিস— সিরিয়াল আর টেলিফিল্ম। দু’টিই ছোট পর্দার দান। পর্দায় গল্প দেখতে হলে সিনেমাই দেখতে হবে, এই বাধ্যবাধকতা তারা ভেঙে দিল। সিনেমা এখন আর মাধ্যম নয়, সে হয়ে উঠল ফর্ম এবং ফরম্যাট।

চলচ্ছবির সঙ্গে দর্শকের সম্পর্কে নানা ওঠাপড়ার এই যে প্রেক্ষাপট, তারই মধ্যে মঞ্চে প্রবেশ ওটিটি-র। হাতের মুঠোয় সিনেমা-সিরিজ়-ছোট ছবি-বড় ছবির সম্ভার। ফলে ভিডিয়ো ক্যাসেট থেকে ডিভিডি-ভিসিডি-ব্লুরে পর্যন্ত যে অভিযাত্রা, সেটাও এ বার তামাদি হয়ে গেল। সেই সঙ্গে টেলিভিশনের মধ্যেও যেটুকু যৌথতা ছিল, বসার ঘরে জড়ো হওয়া ছিল, তারও দিন ফুরোল। শুধু ওটিটি-ই বা কেন, টিভি দেখার জন্যও তো টেলিভিশন সেটের প্রয়োজন হয় না আর। স্মার্টফোন বা ল্যাপটপেই দেখা চলে। এই পরিস্থিতিতে অতিমারির অভিঘাত যখন প্রেক্ষাগৃহে খিল তুলে দিল, ওটিটি-তে মুখ গোঁজার অভ্যাস হল তুঙ্গী। সিনেমার ক্ষেত্রে ‘টিভিতে দেওয়া’-র সঙ্গে এ বার যোগ হল ‘ওটিটি-তে আসা’র পালা।

এই যে ভাঙন-কাহিনি, সেটা অজানা কিছু নয়। কিন্তু এর ভিতরেও যে উঁকি দিতে পারে নতুন কোনও সংযোগের বীজ, এ বার সে দিকে তাকানোর সময় এসেছে। গত কয়েক দিনে কলকাতা শহর যে হাওয়া-য় ভেসে গেল, সেটা কিন্তু বহুলাংশে ওটিটি সংস্কৃতিরই দান। বাংলাদেশের নাটক, বাংলাদেশের গান, বাংলাদেশের ছবি নিয়ে আগ্রহ আগেও ছিল। নাট্যোৎসবে ও পারের নাটক, চলচ্চিত্র উৎসবে ও পারের ছবি, কলেজ ফেস্টে ও পারের ব্যান্ডের গান নিয়ে উদ্দীপনা কম থাকত না। কিন্তু পরিসরটা ছিল তুলনায় সীমিত। তার পর প্রথমে সোশ্যাল মিডিয়া, বিশেষত ইউটিউবের হাত ধরে একটা অন্য জোয়ার এল। মোশারফ করিম, চঞ্চল চৌধুরীরা এ পারে ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠতে লাগলেন। এরই পরের ধাপে ওটিটি-র সুবাদে বাংলাদেশি ‘কনটেন্ট’ যে ভাবে আরও অনেক বৃহত্তর আকারে এবং পরিধিতে ফোনে-ফোনে পৌঁছে গেল এবং নিজ গুণমানের জোরে সমাদর লাভ করল, সেটা অভূতপূর্ব। এই মুহূর্তে চঞ্চল চৌধুরীকে ঘিরে এ পারে যে উন্মাদনা, সেটা অনেকাংশেই ওটিটি-র অবদান। নাসিরুদ্দিন খান, সোহেল মণ্ডল, ইন্তিখাব দিনারেরা যে ভালবাসার আসনে এখানে অধিষ্ঠিত, ওটিটি-র জন্যই তা বহুলাংশে সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশি ছবির উৎসবে তাই ভিড় প্রচুর বেড়েছে। হাওয়া-র ক্ষেত্রে সব হিসাবনিকাশ ছাপিয়ে গিয়েছে। বড় পর্দার ক্ষেত্রে ভরসার কথা এটাই, ওটিটি-সঞ্জাত আগ্রহ এবং আকর্ষণ যে মানুষকে হলমুখীও করতে পারে, এ বারের উৎসব সেটার সাক্ষী হয়ে রইল।

হাওয়া এবং বল্লভপুরের রূপকথা দুটো ছবি সম্পূর্ণ দু’ধরনের। দুটো গল্পেই অলৌকিকতার ছোঁয়া আছে যদিও। কিন্তু দুটো ছবির মেজাজ এবং আঙ্গিক একেবারে আলাদা। হাওয়ার সবচেয়ে বড় সাফল্য, স্পেক্ট্যাকল-এর চলতি ধারণায় একটা পরিবর্তন আনতে পারা। মাঝদরিয়ায় জেলেনৌকার উপাখ্যানে প্রযুক্তির প্রতাপের চেয়ে অনেক বেশি করে মানুষী জীবনের দিকে নজর টেনে রেখেছে সে। এই বার্তাটা খুব স্পষ্ট করে দিতে পেরেছে যে, জীবনের গল্পের চেয়ে বড় ক্যানভাস আর নেই এবং সেই গল্পের পাটায় বসার সুযোগ পেতে হলে ছবিটা বড় পর্দায় দেখা দরকার। তার পাশাপাশি ‘সাদা সাদা কালা কালা’-র মতো হিট গান আর বলিষ্ঠ অভিনেতৃসমাগম ছবিটা নিয়ে উত্তেজনা এতটাই বাড়িয়ে রেখেছিল যে, ওটিটি-র জন্য তর না সয়ে মানুষ হল-এ ছুটে যাওয়াই কর্তব্য মনে করেছেন।

অন্য দিকে, বল্লভপুরের রূপকথা ছিল নিচু তারে বাঁধা। তারকা তো দূরস্থান, পর্দায় পরিচিত মুখই প্রায় নেই। প্রচলিত অর্থে স্পেক্ট্যাকলও নেই। পুরনো কাহিনিকে নতুন করে নেওয়ার তাড়না নেই। তবু মানুষ ছবিটি গ্রহণ করছেন। তার একটা কারণ নিশ্চয় পরিচালক অনির্বাণ ভট্টাচার্যের স্টার-ভ্যালু। কিন্তু হলে পৌঁছনো আর পৌঁছে ভাল লাগার মধ্যেও একটা বড় দরজা পেরোনোর ব্যাপার আছে। ভাল অভিনয়, কমেডির আবেদন সেখানে খুব বড়। বল্লভপুর-এর সাফল্যে এগুলো নিশ্চয় গুরুত্বপূর্ণ। তবে তার থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ বোধ হয় এর নির্মল আমেজ, সেটা আজকের দিনে প্রায় সোনার পাথরবাটি হয়ে উঠেছে। এই নির্মলতা এক সময় বাংলা ছবির অন্যতম উপাদান ছিল। কালের গতিতে আজ সেটা আর্কাইভের বস্তু। কিন্তু শ্বাসরুদ্ধকর দুনিয়াদারি আর অনবরত ‘ডার্ক’-এর সুড়ঙ্গে বাস করতে করতে কোথাও হয়তো মনটা অজানিতেই হাঁপিয়ে উঠেছিল। বল্লভপুর সেখানে রেকাবিতে এক গেলাস ঠান্ডা জল এগিয়ে দিয়েছে। এই আরামটা দরকার ছিল। এবং সেই আরামের আস্বাদ যে লোককে হল-এ টেনে নিয়ে যেতে পারে, সেটাই বল্লভপুর-এ অনেকটা প্রমাণ হয়ে গিয়েছে।

মনে রাখা যাক, হাওয়া এবং বল্লভপুর-এর মধ্যে অনেকগুলো গঠনগত মিলও আছে। দুটোই মাটিতে পা-রাখা গল্প। দুটো ছবিই খুব বেশি করে দলবদ্ধ প্রয়াসের উপরে নির্ভরশীল। দুটো ছবিরই অভিনেতা-অভিনেত্রীদের একটা বড় অংশ মঞ্চ থেকে এসেছেন। দুটো ছবির নির্মাণেই যত্নের ছাপটা স্পষ্ট। এই যত্নটা এসেছে একটা বিশ্বাসের ভিত্তিভূমি থেকে। কাহিনির প্রতি বিশ্বাস, কাহিনি কথনের প্রক্রিয়ায় বিশ্বাস, কলাকুশলীদের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস। আমি থেকে আমরা হয়ে ওঠার বিশ্বাস। দক্ষিণের ছবির সাফল্যও এই পথে হেঁটেই এসেছে। কান্তারা মনে রাখলেই সেটা পরিষ্কার হবে। দেওয়াল লিখনটিতে আর কিন্তু কোনও ধোঁয়াশা রইল না— বাংলা ছবি, বড় পর্দার বাংলা ছবি নিজের পাশে নিজে দাঁড়াক, দর্শক পিছিয়ে থাকবেন না।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement