স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা পরিষেবার এই অন্তর্জলি যাত্রার বৈঠা হিসাবে ক্রমশ দৃশ্যমান হচ্ছে স্বাস্থ্যবিমা। প্রতীকী ছবি।
একশো বছর হয়ে গেল প্রায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘অভাগীর স্বর্গ’ লিখেছিলেন। দেখছি, যত পাল্টেছে, সব তত একই আছে। কাঁথা কাপড়ে মোড়া হিম হয়ে যাওয়া মা লক্ষ্মীরানি দেওয়ানের নিথর দেহ ঘাড়ে ফেলে জলপাইগুড়ি শহরের পথ পেরিয়ে ছেলে রামপ্রসাদ হেঁটে চলেছেন শ্মশানের দিকে। নির্মম, উলঙ্গ এই বাস্তবের মুখোমুখি হয়ে আমরা শিউরে উঠেছি। রামপ্রসাদের মুখের সঙ্গে মিলেমিশে যাচ্ছে কাঙালী ঢুলের ছবি। উন্নয়নতৃপ্ত সমাজের মুখের উপরে রামপ্রসাদ ছুড়ে মারছেন অভাগীর স্বর্গলাভের পুনর্নিমাণ। বাবুদের মতো চিকিৎসা পেয়ে ভাল হয়ে ওঠার স্বপ্ন নিয়েই রামপ্রসাদরা বড় হাসপাতালে মা-কে নিয়ে আসেন। বাবুদের মতো বড় হাসপাতালে ঠাঁই পাওয়া বা না পাওয়া হয়ে ওঠে সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যের মাপকাঠি।
এই হঠাৎ নাড়া দেওয়া ছবিটি নাগরিক ভাবনার চলমান অলিন্দ থেকে হয়তো এই এক সপ্তাহেই সরে গিয়েছে। দু’এক দিনের সংবাদ শিরোনাম, বিভাগীয় তদন্তের প্রবঞ্চনা এবং রাজনীতির ঢিল ছোড়াছুড়ির অবসানে রামপ্রসাদ ও লক্ষ্মীরানির কাহিনি এখনই অতীত। প্রশ্ন হচ্ছে, এই ঘটনা থেকে কি প্রচলিত ব্যবস্থা এবং তার পরিচালকেরা পথ খুঁজবেন যে, কী ভাবে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য, স্নেহ এবং মমত্বসমৃদ্ধ, সংবেদনশীল একটা স্বাস্থ্যব্যবস্থা তৈরি করা যায়? অবশ্যই তার প্রাথমিক শর্ত হচ্ছে, চলতে থাকা ব্যবস্থার দুর্বলতা, দুর্বুদ্ধি, দুরভিসন্ধির জায়গাগুলো স্বচ্ছতার সঙ্গে চিহ্নিত করা, এবং সেগুলোকে ভরাট করার ইচ্ছা বজায় রাখা। সেই ইচ্ছা এবং নিজের দুর্বলতা চিহ্নিত করে তাকে সংশোধন করার সততা আদৌ ব্যবস্থাপকদের আছে কি?
প্রচলিত স্বাস্থ্য পরিষেবার হাজার দুর্বলতার কেন্দ্রে আছে তার আত্মিক দর্শনগত অবস্থান, যে অবস্থান হল ব্যক্তি স্বার্থের প্রতিপালন। সাধারণ মানুষের প্রয়োজন মেটানোর সদিচ্ছার নয়— তাদের আপাত-সন্তুষ্টির পানপাত্রে, প্রসাদপুষ্ট আনন্দে আধডোবা অবস্থায় নিমজ্জিত রাখার দিকেই ব্যবস্থাপকদের পক্ষপাত। তাঁরা স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে রেশনের বন্দোবস্ত করার থেকে আলাদা কিছু বলে ভেবে উঠতে পারার ক্ষমতা এবং ইচ্ছা পোষণ করেন বলে মনে হয় না। বিলিবণ্টনের মোহ তৈরির বাইরে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা পরিষেবার যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে, যেখানে তা সামগ্রিক মানব উন্নয়নের অঙ্গনে ভিত তৈরি করে— আমাদের রাজনীতিকদের মধ্যে তা তলিয়ে দেখার মতো ধৈর্য থাকার কথা নেই। শুধুমাত্র দেখনদারির মধ্যে দিয়ে ভোট পাওয়ার লক্ষ্যেই পরিচালিত হয় আমাদের স্বাস্থ্য এবং চিকিৎসাব্যবস্থা। ব্যথাতুর মানুষ গ্রহীতা হিসাবে যে ব্যবস্থার ভরকেন্দ্রে থাকেন, তার মধ্যে যদি স্নেহ না থাকে, তা হলে সে ব্যবস্থা হয়ে দাঁড়ায় কাঠপুতলির মতো। ব্যবস্থার পরিচালকদের উপর-চালাকির রোগ সংক্রমিত হয় সামগ্রিক ভাবে ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা কর্মীদের মধ্যেও। নিষ্ঠুর প্রয়োজনীয়তা এবং অসহায় অবস্থায় পড়ে এই একান্তই পাথুরে ব্যবস্থাকে এড়িয়ে না যেতে পারার বাস্তবতা সাধারণ মানুষকে এর প্রাঙ্গণে এনে ফেলে। কিন্তু আত্মীয় বলে কাছে টানতে পারে না। চায়ও না। আমাদের সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার বড় রোগ এটাই।
হতশ্রী এবং হতোদ্যম পরিচালকদের দুয়োরানি এই সরকারি ব্যবস্থার পাশাপাশি ক্রমশ প্রসারমাণ বেসরকারি ব্যবস্থাকে প্রতি দিন আরও বেশি মানুষের সামনে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চার পাশে গতি পাচ্ছে। কর্পোরেট ব্যবস্থার কোলে মাথা রেখে, তাদের তাল এবং সুর ধার করে সরকারি পরিষেবাকে আরও চকচকে করার দিবাস্বপ্ন দেখছে ও দেখাচ্ছে সরকার। অথচ বেসরকারি কর্পোরেট ব্যবস্থার মূল সুরটাই আলাদা। সেখানে দশের এবং দেশের কল্যাণকামিতা নয়, ব্যবসা পরিচালিত হয় আর্থিক লক্ষ্যে। চিকিৎসা পরিষেবার মধ্যে এই বিনোদনসর্বস্ব আত্মহানিকর কর্পোরেট সংস্কৃতির প্রভাব যত বাড়বে, ততই তার মানব উন্নয়ন এবং কল্যাণকামী রূপ দুর্বল হবে। রামপ্রসাদেরা উজ্জ্বল ‘সভ্যতার আলো’ দেখে এক অলীক স্বপ্নের পিছনে ছুটবেন শ্যামাপোকার মতো। এবং তা করবেন একান্তই নিরুপায় হয়ে। ভবিতব্য ধাক্কা খাওয়া এবং মাথা ঠোকা আলোকোজ্জ্বল ল্যাম্পপোস্টের নীচে।
স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা পরিষেবার এই অন্তর্জলি যাত্রার বৈঠা হিসাবে ক্রমশ দৃশ্যমান হচ্ছে স্বাস্থ্যবিমা। মধ্যবিত্তকে সুখী করার কাজে, তাদের আরও আধুনিক হওয়ার বাসনাকে চরিতার্থ করার মাধ্যম হিসাবে, এটা মন্দ নয়। কিন্তু এটাও পরিষ্কার হওয়া দরকার যে, বিমানির্ভর স্বাস্থ্যব্যবস্থা সরকারকে নাগরিকদের প্রতি প্রাথমিক দায়বদ্ধতা এড়িয়ে যেতে আরও সাহায্য করছে। এ পথে যত হাঁটব, ততই বাড়বে ব্যবস্থার যান্ত্রিকতা, কমবে সংবেদনশীলতা। এরই পাশাপাশি চিকিৎসা পরিষেবার অঙ্গন থেকে উবে যাবে স্নেহ, মমত্ব, দায় প্রভৃতি শব্দ।
এই চিকিৎসা সভ্যতার ইমারতে রামপ্রসাদদের মাথা ঠোকা চলতেই থাকবে। পরিষেবার আত্মার অন্তঃপুরে থাকবে না তাঁদের প্রবেশাধিকার। ‘জ্ঞান পুঁজি’র অশ্বমেধ যজ্ঞে সবার আগে শিকার হন স্বল্পজ্ঞান, সরলমতি নাগরিকেরা। ধাক্কা খেতে খেতে এই ‘উন্নয়নমুখী’ সভ্যতার প্রতি শ্রদ্ধা হারান তাঁরা। এটা তাঁদের দুর্বলতা নয়, সভ্যতার বিকৃতির প্রতি তাঁদের ধিক্কার। এটাও সত্যি যে, এ রকম ধাক্কা খেতে খেতে প্রকৃতি ও সমাজ ক্রমশ তার ভুলগুলো ঠিক করে নেয়। কিন্তু, তা করতে গেলে লাগে কালের রথের চাকার দাগ বোঝার দক্ষতা এবং অন্তর্দৃষ্টি। আর সেই ভিতরের চোখ খুলে দেওয়ার কাজে পাল্কিবাহকের কাজ করেন পরিষেবার দালানে আছাড় খেয়ে আত্মীয় থেকে অনাত্মীয় হয়ে যাওয়া মানুষজন। মায়ের শববহনের সময় সে দিন রামপ্রসাদ বইছিলেন প্রবহমান স্বাস্থ্যসভ্যতার উন্নয়নের বিকৃতির শব। জেগে উঠে তা ঠিক করার সময় আছে এখনও।
লিভার ফাউন্ডেশন