—প্রতীকী ছবি।
চার পাশে এখন যা দেখি, তা আসলে ইতিহাসের কৌটোর তলায় লেগে থাকা গুঁড়ো।” শ্রমের বাজারে লিঙ্গসাম্যের অভাব প্রসঙ্গে এ কথা বলেছেন এ বছরের নোবেল পুরস্কারজয়ী অর্থনীতিবিদ ক্লডিয়া গোল্ডিন। দু’শো বছরের তথ্য ঘেঁটে কাজের বাজারে মহিলাদের যোগদান এবং পুরুষ ও মহিলাদের মধ্যে মজুরির ফারাক নিয়ে আক্ষরিক অর্থেই যুগান্তকারী গবেষণায় ক্লডিয়া দেখিয়েছেন, ঊনবিংশ শতকে যখন কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি ক্রমশ শিল্পমুখী চেহারা নিতে থাকে, তখন বিবাহিত মহিলারা সরে আসেন শ্রমের বাজার থেকে। বিংশ শতকে পরিষেবা ক্ষেত্রের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে ‘কর্মরতা’দের সংখ্যা আবার বাড়তে শুরু করে। ২০২১ সালে প্রকাশিত কেরিয়ার অ্যান্ড ফ্যামিলি: উইমেন’স সেঞ্চুরি-লং জার্নি টুওয়ার্ড একুইটি বইতে ক্লডিয়া দেখিয়েছেন, উন্নত বিশ্বে শিক্ষিত মহিলারা এখন কাজের বাজারে উপস্থিত থাকলেও রোজগার বা পদোন্নতির নিরিখে অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছেন তাঁদের এক সময়ের পুরুষ সহপাঠীদের তুলনায়।
এ সব নিয়ে যে আলোচনা হয় না, তা কিন্তু নয়। বস্তুত, প্রায় প্রতি দিনই এই সমস্যাটির নিত্যনতুন নামকরণ করে চলেছেন সংবাদকর্মী আর গবেষকেরা। ‘সেক্স ডিসক্রিমিনেশন’, ‘জেন্ডার বায়াস’, ‘গ্লাস সিলিং’, ‘মমি ট্র্যাক’, ‘লিনিং আউট’— যে নামেই চিহ্নিত করা হোক, প্রায় সকলেই মনে করেন যে, এর কিছু হাতেগরম সমাধানসূত্র রয়েছে। মহিলাদের আরও প্রতিযোগিতামুখী হতে হবে, শ্রমের বাজারে দরাদরির ক্ষেত্রে আরও কঠিন মনোভাব দেখাতে হবে, ম্যানেজারদের বৈষম্যমূলক আচরণের কথা আরও বেশি বেশি করে প্রকাশ্যে আনতে হবে, সরকারকে আরও কঠোর ভাবে নিশ্চিত করতে হবে একই কাজের জন্য যেন একই বেতন পান মহিলা ও পুরুষেরা। প্রশ্ন করতে হবে, মেয়েরা কেন আরও আক্রমণাত্মক ভাবে বুঝে নিচ্ছেন না নিজেদের পাওনাগন্ডা?
ব্যক্তিগত স্তরে যে প্রশ্নগুলি তাঁদের তাড়িয়ে বেড়ায়, সেগুলির চরিত্র অবশ্য খানিকটা অন্য রকম। নিজের মতোই কর্মব্যস্ত কাউকে কি ‘ডেট’ করা ঠিক হবে? নিজস্ব একটা পরিবার চাইলেও কি ঠেকিয়ে রাখা উচিত সন্তানধারণের সিদ্ধান্ত? পঁয়ত্রিশ বছর বয়স, তবু পছন্দমতো সঙ্গী মেলেনি, এখনই কি করে ফেলা উচিত ডিম্বাণু-সংরক্ষণ? হাইস্কুল থেকে অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে তিলে তিলে তৈরি হয়েছে যে কেরিয়ার, তা কি ছেড়ে দেওয়া উচিত সন্তানপালনের কারণে? নইলে তার টিফিনবক্স গুছিয়ে দেবে কে? সাঁতারের ক্লাসে নিয়ে যাবে কে? স্কুল থেকে ফোন করলে কে-ই বা ছুটে যাবে ঊর্ধ্বশ্বাসে?
ক্লডিয়া লিখেছেন, একটি মেয়েকে বলা হয়, তাঁর পুরুষ সহপাঠীর তুলনায় তিনি যে পিছিয়ে পড়েছেন, তার খানিকটা দায় তাঁর নিজের। একবগ্গা ভাবে কেরিয়ারের পিছনে দৌড়তে পারেননি তো তিনি নিজেই, নিজেরই সিদ্ধান্তে। তবে এ কথাও তাঁকে বলা হয় যে, এই পিছিয়ে পড়ার সমস্ত দায় তাঁর একার নয়। কাজের বাজার যে ছেলেদের প্রতি একচোখো, তার বিস্তর প্রমাণ রয়েছে। কর্মক্ষেত্রে নানান হয়রানির সম্ভাবনাও তাঁকে সেই ‘বয়েজ় ক্লাব’-এ ঠিক মতো অন্তর্ভুক্ত হতে দেয় না।
ক্লডিয়া লিখেছেন, কর্পোরেট সিঁড়ির শেষ ধাপে পৌঁছনো দু-এক জন মহিলার দৃষ্টান্ত দেখিয়ে, বা পিতৃত্বকালীন ছুটি নেওয়া জনাকয়েক আদর্শ বাবার নজির দেখিয়ে বিশেষ লাভ হবে না। গোটা সমাজের কাঠামোটাই যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে এই অসাম্যের ভিতের উপরে, সেখানে ব্যক্তির সাফল্য বা অসাফল্যে বেশি নজর দেওয়া অর্থহীন। বরং, ইতিহাস খুঁড়ে অনুভব করতে হবে এই বৈষম্যের শিকড়কে, সমাজ-রাজনীতির গভীরে যা চারিয়ে গিয়েছে শতকের পর শতক ধরে। ১৯৬৩ সালে বেটি ফ্রিডান যেমন লিখেছিলেন, কলেজ-শিক্ষিত মহিলারা বাড়িতে থাকা বাচ্চার মা হিসাবে যে হতাশায় ভোগেন তার কোনও নাম নেই। রাষ্ট্র বা সমাজ, কোথাও স্বীকৃতি মেলে না এই সমস্যার।
ফ্রিডানের এই লেখার বছর দশেকের মধ্যেই, গত শতকের দ্বিতীয়ার্ধে, আমেরিকায় দস্তুরমতো বিপ্লব ঘটে যায়— মেয়েদের বিয়ের বয়স বা উচ্চশিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে তাঁদের উপস্থিতি এক লাফে অনেকটা বেড়ে যায়, উপার্জন করতে শুরু করেন বহু মহিলা। নারীবাদী তাত্ত্বিকদের মতে, এই পরিবর্তন সম্ভব হয়েছিল বাজারে জন্মনিরোধক বড়ির আবির্ভাবের ফলে। এই পরিবর্তনের খানিক ছোঁয়াচ লেগেছিল ভারতের শিক্ষিত অংশের মধ্যেও। তার প্রভাব আমরা দেখি সে সময়ের সাহিত্য, সিনেমা, নাটকে। নরেন্দ্রনাথ মিত্রের বহু গল্প-উপন্যাসে পড়ি মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে-বৌদের চাকরি করতে যাওয়ার বিবরণ। গলির মোড়, বাস-ট্রাম-ট্যাক্সি, রেস্তরাঁ, অফিসঘর, সর্বত্র দেখা যেতে লাগল একা মেয়েদের। তাদের সামলে নিয়ে চলার জন্য কোনও পুরুষ সঙ্গী নেই। টেলিফোন-অফিসে কাজ নেওয়া বিবাহিত মেয়ে সাদা সিঁথিতে, হাতের শাঁখা খুলে শ্বশুরবাড়ি থেকে বেরোয়, কেউ বা বিয়ে ভেঙে কুমারী সেজে একা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে মধ্যবিত্ত পাড়ায়।
ঘরের বাইরে বা ভিতরে পুরুষও অনেক ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে যায়। একার রোজগারে সংসার চালাতে না-পারার ব্যর্থতা, কর্তৃত্ব ফলানোর জেদ, দখলে রাখার বাসনা, প্রেম, ঈর্ষা, সন্দেহ কী জটিল সমীকরণে উঠে আসে সে সব গল্প উপন্যাসে। ঘরের মহিলাটি কাজে বেরিয়ে গেলে অভ্যাসের আরামেও টান পড়ে, হাত লাগাতে হয় গৃহকাজে। শেষ পর্যন্ত অনেক পুরুষই বলে, করতে হবে না চাকরি, আমিই চালাব সংসার। বাজার যত আগুন হয়, কেউ কেউ নেহাত নাচার হয়েই মেনে নেয় স্ত্রীর চাকরির অপরিহার্যতা। মেয়েদের উপার্জনে ভাগ বসায় নিকট-সম্পর্কের পুরুষেরা, কখনও বাবা, কখনও দাদা, কখনও প্রেমিক, কখনও স্বামী বা তার পরিজনেরা। আশাপূর্ণা দেবীর উপন্যাস শশীবাবুর সংসার-এর কাহিনি নিয়ে সুধীর মুখোপাধ্যায়ের ছবিতে আমরা দেখি অবসরপ্রাপ্ত দাপুটে শ্বশুর ছবি বিশ্বাসের আপত্তি অগ্রাহ্য করে তাঁরই নাকের ডগা দিয়ে মাথায় আঁচল দিয়ে চাকরি করতে যাচ্ছেন পুত্রবধূ অরুন্ধতী দেবী। ননদকে দৃপ্ত কণ্ঠে বলছেন, “তুমি বাবাকে ভয় করো, তাই তাঁর কাছে সব কিছু লুকিয়েছ। আমি বাবাকে ভক্তি করি, তাই তাঁর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার অধিকার আমার আছে।”
ভক্তির, শ্রদ্ধার, ভালবাসার চরিত্রবান পুরুষও যে লিঙ্গসাম্যের প্রশ্নে অসংবেদনশীল হতে পারে, তা তো আশাপূর্ণা বারে বারে দেখিয়েছেন। তবে তাদের সঙ্গে তর্কে মেয়েদের জিতিয়েও দিয়েছেন তিনি। মনে পড়ে যায়, প্রথম প্রতিশ্রুতি-র বালিকা সত্যবতী কী ভাবে তার বিদ্বান, ব্যক্তিত্ববান, চিন্তাশীল বাবা রামকালী কবিরাজের চোখ খুলে দিয়েছিল
সংসারের অন্দরের অসাম্য সম্পর্কে। পুত্রবধূর চাকরি, ছেলের বাইরে ট্রান্সফার, পঞ্জাবি ছেলের সঙ্গে মেয়ের প্রেম এবং বিয়ে, নতুন যুগ ঝড়ের মতো ঢুকে শশীবাবুর সংসারের সমস্ত কিছু যেন একেবারে উলটপালট করে দেয়। শেষে অবশ্য ভারসাম্য ফিরে আসে খানিকটা ‘হ্যাপি এন্ডিং’ প্রতিষ্ঠার টানেই, নরেন্দ্রনাথ মিত্রের প্লটের মতো জটিলতায় আকীর্ণ হয় না গল্প।
মেয়েদের বিষয় নিয়ে তৈরি করা সিনেমা-সিরিজ়ের এখন ছড়াছড়ি। একটু খেয়াল করলে দেখা যায়, প্রশ্নগুলি কিন্তু শশীবাবুর সংসার-এ ওঠা প্রশ্নের চেয়ে চরিত্রগত ভাবে খুব এগোয়নি। পাশাপাশি, টিভি সিরিয়াল এবং মূলধারার অনেক ছবিতে পারিবারিক মূল্যবোধের নামে যে ভাবে লিঙ্গসাম্যের সমস্ত ধারণাকে দুরমুশ করা হচ্ছে, তা দেখেও আশঙ্কা হয়। মেয়েদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা বস্তুটিই যে সমস্ত গোলমালের মূলে, তা বুঝিয়ে দেয় বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান, সমাজমাধ্যমও।
মহিলাদের কাজের বাজারে যোগ না দেওয়া, আঠারো বছরের নীচে বিয়ে হয়ে যাওয়া, অপুষ্টিতে ভোগা, গার্হস্থ হিংসার শিকার হওয়া, আর গার্হস্থ হিংসায় ন্যায্যতা খুঁজে পাওয়ার পরিসংখ্যানে অন্য অনেক উন্নয়নশীল দেশের চেয়ে পিছিয়ে আছে ভারত। মেয়েদের উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে লালন করা, বা কর্মক্ষেত্রে আরও আগ্রাসী হওয়ার প্রয়োজন নিয়ে আলোচনা এখনও বহুলাংশে উন্নত বিশ্বের চর্চার বিষয়। শ্রমের বাজারে লিঙ্গসাম্যের অভাব সেখানে ইতিহাসের কৌটোর তলায় লেগে থাকা গুঁড়ো। এ দেশে সে কৌটো যেন মধুসূদনদাদার ভাঁড়। মহিলাদের শ্রমের কথা উঠলেই ফিরে ফিরে আসতে থাকে সেই পুরনো নাছোড় প্রশ্নগুলো। নতুন প্রশ্নগুলো ওঠার আর অবকাশই পায় না।