ফাইল চিত্র।
এই গ্রীষ্মে গোটা দেশ জুড়ে চলতে থাকা প্রবল তাপপ্রবাহ থেকে বাঁচতে ঘরে থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। দিনমজুর, খেতমজুর, খুচরো বিক্রেতা-সহ যাঁরা রোজগারের তাগিদে ঘরের বাইরে কাজ করতে বাধ্য হন, তাঁদের ঝুঁকি নিয়ে সরব হয়েছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)। কিন্তু যাঁরা কাজ করেন ঘরের মধ্যে? যতই গরম পড়ুক, রসুইঘর থেকে ছুটি নেই মেয়েদের। এবং যে সব পরিবারে ফ্রিজ, মাইক্রোওয়েভ আছে (বা রাখার সঙ্গতি আছে), সদ্য-তৈরি গরমাগরম খাবারের দাবি জারি রয়েছে সে সব সংসারেও।
বছর দুয়েক আগে মুক্তি পাওয়া মালয়ালম ছবি দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান কিচেন-এর একটি দৃশ্যে আমরা দেখতে পাই, শ্বশুরমশাই গরম ধোসা চাওয়ায় রান্নাঘর থেকে প্রায় ছুটে ধোসা বানিয়ে নিয়ে আসছেন নববধূ। স্বামী শিক্ষক। সেই পরিবারে প্রেশার কুকারে তৈরি ভাতের স্বাদ পছন্দ না হওয়ায় কাঠের উনুনে ভাত রাঁধতে বলা হয় বধূকে। নরম স্বরে বলা হলেও তা যে আসলে কঠোর নির্দেশ, তা স্পষ্ট হয়ে যায়। পুরুষতন্ত্রের এই বাস্তব ছবি তুলে ধরার পরে বিপুল চর্চা হয়েছিল ছবিটিকে নিয়ে।
উচ্চ-শিক্ষিত, প্রগতিশীল কেরলের একটি পরিবারকে নিয়ে তৈরি দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান কিচেন দেখিয়েছিল, শিক্ষিত সমাজের গার্হস্থের শ্রম-বিভাজনে কী তীব্র লিঙ্গ-অসাম্য কাজ করে। নববিবাহিতা স্ত্রীর সঙ্গে খুনসুটি করতে রান্নাঘরে আসা স্বামীকে হাসি-মুখেই তার রন্ধনরত, শিক্ষিতা স্ত্রী বলে, “খুব গরম এখানে।” কে-ই বা ভারতীয় পরিবারের রান্নাঘরের গঠন নিয়ে ভেবেছে? রান্নাঘরে হাওয়া চলাচলের ব্যবস্থা করে, অতিরিক্ত রোদ থেকে বাঁচানোর ছাউনি করে, বা অন্য কোনও ভাবে তাকে সহনীয় করার কথা ভেবেছে? গ্রামের রান্নাঘর তো দূরের কথা, শহরের ক’টি রান্নাঘরেই বা পাখার দেখা মেলে? জলবায়ু পরিবর্তন ও উষ্ণায়নের ঝুঁকি নিয়ে চর্চার পরিসরে আজও ঢোকেনি নারীদের গৃহশ্রম।
রান্না যখন পেশা হয়ে ওঠে, তখন তা শ্রম হিসাবে স্বীকৃতি পায়। এবং তখন সেই পেশায় পুরুষদের দেখা যায়। একটি সমীক্ষায় দাবি, বাড়ির রান্নার কাজ সামলান, এমন পুরুষের সংখ্যা যেখানে ৬.১ শতাংশ, সেখানে পেশাদার রাঁধুনিদের ৯৬ শতাংশই পুরুষ। ইতিহাসবিদ রানা সাফভি এ প্রসঙ্গে একটি আলোচনায় বলেছিলেন, মোগল ও ব্রিটিশ আমল থেকেই খানসামা বা পেশাদার পাচকেরা ছিলেন পুরুষ। তাঁদের রান্নাঘর ছিল অনেক উন্নত। মেয়েদের জন্য বরাদ্দ ছিল সাধারণ রান্নাঘর। দৈনন্দিন রান্না কখনও ‘শিল্পকলা’ বলেও মর্যাদা পায়নি, তা নিছক দায়িত্ব বলে গণ্য হত। সাফভির মতে, সেই দায়িত্বের ভার বরাবরই ছিল মহিলাদের কাঁধে।
এই স্বীকৃতিহীন, অদৃশ্য শ্রমের পরিমাণ কী বিপুল, পরিসংখ্যান থেকে তার একটা আন্দাজ পাওয়া যায়। আইএলও-র রিপোর্ট (২০১৮) বলছে, ভারতের শহরাঞ্চলে এক জন মহিলা গড়ে প্রতি দিন ঘরের কাজের জন্য সময় দেন ৩১২ মিনিট, এক জন পুরুষ দেন গড়ে ২৯ মিনিট। গ্রামের ছবি— মহিলা ২৯১ মিনিট আর পুরুষ ৩২ মিনিট। ২০১৯-২০ সালের কেন্দ্রীয় সরকারের ‘সময়-ব্যবহার সমীক্ষা’-ও বলছে, এক জন ভারতীয় পুরুষ এক জন নারীর থেকে অনেক বেশি সময় পান ব্যক্তিগত কাজ, পরিচিতদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা, ঘুমানো এবং খাওয়ার জন্য।
সাম্প্রতিক একটি পরিসংখ্যান বলছে, বাংলার গ্রামে ৭৬ শতাংশ মহিলা কাঠে রান্না করেন। তাঁদের অধিকাংশকে নিজেদেরই সেই কাঠ, বা জ্বালানির অন্য উপাদান, সংগ্রহ করে নিয়ে আসতে হয় প্রতি দিন। বনভূমি কমছে, এই জ্বালানি সংগ্রহের পথ ক্রমশ দীর্ঘ হয়েছে মেয়েদের জন্য। তাতে হিংসার মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনাও বাড়ে। রাষ্ট্রপুঞ্জের এক সাম্প্রতিক রিপোর্ট বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে বাড়ছে মেয়েদের উপর অপরাধের সংখ্যাও।
মধ্যবিত্ত বাড়িতে পুরুষ বা অন্য সদস্যরা সারা দিন কাজের শেষে এসি-র ঠান্ডা হাওয়ায়, বা অন্তত পাখার হাওয়ায় বসে জিরিয়ে নিতে পারেন। আর মেয়েরা? শহুরে মধ্যবিত্ত বাড়িতে রান্না যে সময় হয়, সেই সময়ে বাড়ির কোনও ঘরেই এসি চলে না বলে জানাচ্ছে সমীক্ষা। তাই ঘেমেনেয়ে রান্না করতে করতে অন্য ঘরে গিয়ে এসি-তে জিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ হয় না সচ্ছল পরিবারের মেয়েদেরও। সমীক্ষা-সংস্থা ‘কাউন্সিল অন এনার্জি, এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ওয়াটার’-এর আধিকারিক শালু আগরওয়াল জানিয়েছেন, তাঁরা উত্তরপ্রদেশের দুই শহর, বরেলী ও মিথিলার ১০০টি মধ্যবিত্ত বাড়ি ঘুরে একটি সমীক্ষা করেছিলেন। তাতে দেখা গিয়েছিল যে, অধিকাংশ পরিবার বিদ্যুতের বিল বাঁচানোর জন্য কেবল রাতে ঘুমোনোর সময় কয়েক ঘণ্টার জন্য এসি চালায়।
এই অসাম্য, বিভাজন এতটাই ‘স্বাভাবিক’ বলে মনে করা হয় যে, তা কারও চোখেও লাগে না। সেই স্বাভাবিকতা আমরা দেখতে পাই মৃণাল সেনের চালচিত্র (১৯৮১) ছবিতেও। উনুনের ধোঁয়া দেখে ছেলের বিরক্তি দেখে মা বলেন, “কোনও দিন রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে দেখেছিস?” ছেলে জবাব দেয়, “না, দেখিনি! তুমিই বা এখানে বসে আছ কেন? তোমার চোখ জ্বালা করে না?” এই দৃশ্যের পরিবর্তন দরকার। অসাম্যকে ‘স্বাভাবিক’ করে তোলা বস্তুত নিপীড়নকে দীর্ঘস্থায়ী করা। জলবায়ু পরিবর্তনের আলোচনা এ বার প্রবেশ করুক প্রতিটি পরিবারের রান্নাঘরে।