দেওয়ানেওয়া: বেঙ্গালুরুতে বিরোধী দলগুলির বৈঠকে রাহুল গান্ধী ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ অন্য নেতারা। ১৮ জুলাই। ছবি: পিটিআই।
পটনা, বেঙ্গালুরুর পরে মুম্বই। ৩১ অগস্ট আর ১ সেপ্টেম্বর বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’ বৈঠকে বসবে দেশের ‘বাণিজ্য-রাজধানী’তে। তবে, এই বৈঠক হতে পারত ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটন-এর এক অতি সাদামাটা তেতলা বিল্ডিংয়ের তিনতলার কোণঘেঁষা ঘরেও। যে ঘরকে সবাই চেনে ‘লাভ ল্যাব’ নামে! সেখানে দিনের পর দিন, দশকের পর দশক গবেষণায় বুঁদ ইমেরিটাস অধ্যাপক জন গটম্যান। এমআইটি-তে গণিত নিয়ে স্নাতকোত্তর স্তরে পড়েছিলেন, কিন্তু পিএইচ ডি আর অধ্যাপনা মনস্তত্ত্বে। গবেষণার বিষয়? বিবাহ বিচ্ছেদ!
সেই ১৯৮০ সাল থেকে অজস্র দম্পতি আর প্রেমিক-প্রেমিকাকে ওই ‘লাভ ল্যাব’-এর একচিলতে ঘরে ‘সম্পর্কের পরীক্ষা’য় বসিয়েছেন জন। কলেজ ক্যাম্পাসে কোনও যুগল হয়তো প্রেমে হাবুডুবু, কিংবা হাওয়াই থেকে হানিমুন সেরে হয়তো সদ্য ফিরেছেন নবদম্পতি। এঁদের ল্যাবে ডেকে পাঁচ ফুট দূরত্বের দুই চেয়ারে বসিয়ে মিনিট পনেরো শুধু নিজেদের মতো গল্প করতে বলেছেন। কথা বলতে দিয়েছেন তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয়ে— বাড়ির পোষা কুকুরটিকে রোজ হাঁটাতে নিয়ে যাবেন কে? পাউরুটি-দুধ-ডিম-কলা আনতে রোজ সকালে কে ছুটবেন বাজারে? আর এমন সমস্ত নিতান্ত সাধারণ, আটপৌরে কথোপকথনের ভিত্তিতেই বুক ঠুকে বলে দিয়েছেন, আদতে সেই সম্পর্ক কতখানি টেকসই! কিংবা আজ থেকে ১০-১৫ বছর পরে ওই সম্পর্ক টিকবে কি না! আর কী আশ্চর্য, চার দশকেরও বেশি সময় ধরে এত হাজার যুগলকে পরীক্ষার কুর্সিতে বসিয়ে করা জনের ভবিষ্যদ্বাণী ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রেই নির্ভুল!
জনের এই হিসাব জটিল গণিত-নির্ভর। তবু এক ঝলকে সহজে বুঝতে বসলে, মোটামুটি এ রকম: লাভ ল্যাবে দুই চেয়ারে দু’জনকে মুখোমুখি বসান জন। তাঁদের কথা বলতে বলেন অতি সাধারণ কোনও বিষয়ে। কথা গড়াতে থাকে। আর তা রেকর্ড করতে থাকে দু’টি ভিডিয়ো ক্যামেরা। পরে সেই ভিডিয়োর প্রতিটি ফ্রেমকে জুড়ে কয়েক হাজার ‘স্টিল ছবি’র কোলাজ তৈরি করেন সম্পর্ক-বিজ্ঞানী। তার কোনওটিতে হাসি, কোনওটিতে রাগ, কোনওটিতে দুঃখ, কোনওটিতে বিরক্তি আবার কোনও ছবিতে হয়তো ফুটে ওঠে অবিশ্বাসের ঝলক।
দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় জন দেখেছেন, কথা বলার সময়ে দম্পতির মুখে যত রকম অভিব্যক্তি ফুটে ওঠে, তা মূলত ২০ রকমের। এবং তার প্রতিটির জন্য একটি করে সংখ্যা বেঁধে রেখেছেন জন। ধরা যাক, বিরক্তি: ১, অনুতাপ: ২, রাগ: ৭, অনমনীয়তা: ১০, দুঃখ: ১২, চিৎকার: ১১, রাগে চোয়াল শক্ত: ১৩, নির্বিকার: ১৪ ইত্যাদি। এ বার দু’জনেরই ভিডিয়ো রেকর্ডিংকে ভেঙে তৈরি করা স্টিল ছবির শৃঙ্খলকে সংখ্যার মালায় সাজিয়ে ফেলেন গটম্যান। হয়তো দেখা গেল, কথা যে ভাবে এগিয়েছে, তাতে স্ত্রীর ছবিমালার সংখ্যারূপ দাঁড়াল— ‘৭, ৭, ১৪, ১০, ১১, ১১...’। অর্থাৎ, এই ছ’সেকেন্ডে তিনি প্রথমে রাগী, তার পরে নির্বিকার, তার পরে অনমনীয় এবং শেষে চিৎকার করে ঝগড়ার আশ্রয়ে। এ ভাবেই সংখ্যার পিঠে সংখ্যা বসিয়ে ভালবাসা মাপার সমীকরণ তৈরি করেন ‘বিচ্ছেদের অধ্যাপক’।
কিন্তু, এমন তো হতেই পারে যে, মুখে হাসি ধরে রেখে আসলে ভিতরে রাগে গরগর করছেন স্ত্রী। কিংবা মুখ-ফুটে বলতে না পারলেও, স্বামীর মোটে ইচ্ছা নেই রবিবারের ঘুম মাটি করে বাজারে যাওয়ার। তখন? তা তো সম্পর্কের জন্য আরও খারাপ। জন সে কথা আলবত জানেন। তাই মুখ না-ফোটা মনের তল পেতে চেয়ারে বসামাত্র দুই ‘পরীক্ষার্থীর’ই আঙুলে, কানে লাগানো হয় ইলেক্ট্রোড আর সেন্সর। কথা বলার সময়ে চেয়ারে নড়াচড়া হঠাৎই বেড়ে যাচ্ছে কি না, তা মাপার জন্যও লাগানো থাকে যন্ত্র। ফলে ‘মিথ্যে’ বলার সময়ে চেয়ারে সামান্যতম অস্বস্তির নড়াচড়া, হাতের তালুতে জমে ওঠা ঘাম, লাফিয়ে বেড়ে যাওয়া হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকুনি— প্রতিটি খুঁটিনাটি জমা হতে থাকে ল্যাবের খাতায়। এই সমস্ত তথ্যকে সংখ্যায় তৈরি সমীকরণে ‘অনুঘটক’ হিসাবে জুড়ে দেন তিনি। বিয়ে কিংবা সম্পর্ক টিকবে কি না, তার উত্তর মেলে ওই সমীকরণ সমাধান করেই। এক ঘণ্টার ভিডিয়ো বিশ্লেষণের সুযোগ পেলে, জনের সাফল্যের হার ৯৫ শতাংশ। মাত্র ১৫ মিনিটের কথোপকথনেও তা ৯০ শতাংশের আশেপাশে!
এ-হেন ‘অব্যর্থ ভবিষ্যদ্বাণী’ করা জন যদি ‘ইন্ডিয়া’র মুম্বই-বৈঠকে থাকতেন? কিংবা বিরোধী জোটের বৈঠকই হত তাঁর ‘লাভ ল্যাবে’?
পটনায় বিরোধীদের বৈঠকে সূত্রধর যদি বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার হয়ে থাকেন, দেশের ‘তথ্যপ্রযুক্তি-রাজধানী’তে প্রচারের আলো তবে অনেকটাই কেড়ে নিয়েছিলেন সনিয়া এবং রাহুল গান্ধীর মাঝে বসা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শোনা গিয়েছে, নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁর দলকে প্রবল অস্বস্তিতে ফেলার ‘ইন্ডিয়া’ নামটি প্রস্তাব করেছেন তৃণমূলনেত্রীই। আর তাতে সিলমোহর রাহুলের। ‘যুগলবন্দি’। কখনও দু’জনকে হাসিমুখে কথা বলতে দেখা গিয়েছে, কখনও গম্ভীর বৈঠকের ফাঁকে হাত বদলেছে লজেন্স, বাদামভাজা। এমন দৃশ্য যত তৈরি হয়েছে, তত বেশি করে ঔৎসুক্যে ঝুঁকেছে সংবাদমাধ্যম। তবে কি ‘অ্যালার্জি’ সারিয়ে বিশ্বাসের ‘খোলা বাতাস’ লাগল দুই দলের সম্পর্কের গায়ে? তৈরি হয়েছে আরও এমন বহু টুকরো-টুকরো ছবির কোলাজ। বৈঠকের ফাঁকে কখনও প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে হাসিমুখে নির্ভেজাল আড্ডায় মেতেছেন সীতারাম ইয়েচুরি, কখনও রাহুলকে বিয়ের পিঁড়িতে বসার ‘আবদার’ করেছেন লালু প্রসাদ যাদব। কখনও মোদীকে গদিচ্যুত করার কৌশল ভাঁজতে গোপন শলা-পরামর্শে মগ্ন দেখিয়েছে শরদ পওয়ারকে, তো কখনও মেহবুবা মুফতির সঙ্গে এক মঞ্চে সাবলীল হতে চেয়েছেন উদ্ধব ঠাকরে।
এমনিতেই রাজনীতি অনন্ত সম্ভাবনার শিল্প। সেখানে বিশ্বাস এত ভঙ্গুর, সম্পর্ক এত জটিল, দেওয়া-নেওয়ার ফল্গুধারা মাটির এতটাই গভীরে যে, তার তল পাওয়া শক্ত। তার উপরে ‘ইন্ডিয়া’য় যে দলগুলি শরিক, বিভিন্ন রাজ্যে তারা একে অপরের প্রবল ‘শত্রু’। তাই মুখে হাসি কিংবা হাতে লজেন্স নিয়ে বৈঠকের সময়েও হৃদয়ে বিষ ছিল কি না, থাকলেও আপাতত ‘জোট-অমৃত’এ তা চাপা থাকবে কত দিন, এই সমস্ত কিছু জরিপ করার আদর্শ লোক সম্ভবত এক জনই। জন গটম্যান!
মুম্বইয়ে জন ‘মধ্যমণি’ হলে নির্ঘাত তাঁর নজর এড়াত না যে, সেখানে আসার আগে দল ভাঙার ‘লাঠালাঠি’ সম্পর্কের পরেও ভাইপো অজিতের সঙ্গে গোপনে বৈঠকে বসেছেন শরদ পওয়ার। মোদীকে সম্মাননা দিচ্ছেন মহারাষ্ট্রের মঞ্চে। ইয়েচুরি আর রাহুলের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলার পরে রাজ্যে ফিরে বঙ্গে বিজেপির দোসর বলে কংগ্রেস এবং সিপিএমকে দাগিয়ে দিচ্ছেন তৃণমূলনেত্রী। বিরোধী জোট নিয়ে নীতীশ যেন হঠাৎই কিছুটা ‘আনমনা’। ছত্তীসগঢ়ে ভোট আসতেই কংগ্রেসকে কাঠগড়ায় তুলে হুঙ্কার ছাড়ছেন অরবিন্দ কেজরীওয়াল। বিরোধী জোটের নেতাদের বক্তব্য, এ সব মামুলি বিষয়। মোদীকে হটানো, সংবিধান রক্ষার মতো বড়-বড় বিষয়ে তাঁরা এককাট্টা। শুনলে জন কি খুব একচোট হাসতেন?
কোনও বড় প্রশ্নে নয়, সাধারণত ঘর ভাঙে বাজারের থলি, ঘুম থেকে উঠে কাপড় কাচার মতো ‘অতি সাধারণ’ বিষয় থেকেই। ঠিক যেমন ‘ইন্ডিয়া’র নেতারাও বিলক্ষণ জানেন যে, এই জোটের টিকে থাকা এবং সাফল্য অনেকাংশেই নির্ভর করবে নিচুতলায় নেতাদের বোঝাপড়া, আসন সমঝোতা, একে-অন্যের দিকে আঙুল না তোলার অভ্যাসের উপরে। ‘বড়’ নেতারা যতই এগুলিকে ‘ছোট’ বিষয়ের তকমা দিন, এগুলির উপরেই দাঁড়িয়ে তাঁদের দলের ব্যালট-যুদ্ধে অস্তিত্ব, রাজনৈতিক ভবিষ্যৎও। ‘দেখতে ছোট, আসলে বড়’ বিষয় বলেই না মমতার হুঙ্কার, “এ রাজ্যে ‘ইন্ডিয়া’র প্রতিটি ভোট তৃণমূলকে দিন।” আর সংশয়ে দীর্ণ দলকে অধীর চৌধুরীর আশ্বাস, সব আসন ছেড়ে দিয়ে তো কংগ্রেস জোট করার কথা বলেনি!
প্রেম আর জোট-রাজনীতি এক নয়। তার উপরে রাজনীতির কারবারিরা যে ভাবে ভাবলেশহীন মুখে, নির্বিকার ভঙ্গিতে অপ্রিয় সত্য কিংবা মিষ্টি মিথ্যে কথা অক্লেশে বলে যান, তাতে জোটের আয়ু মাপার কাজ হয়তো খুব সহজ হত না জনের পক্ষেও। অত সহজে ঘেমে উঠত না কারও ‘পোড়খাওয়া’ হাতও। তবে সম্ভাবনা ছিল ‘সেয়ানে সেয়ানে কোলাকুলি’র। এই টক্কর নেহাত মন্দ হত না।
ও হ্যাঁ, আশি পেরোনো জনের তৃতীয় বিয়ে দীর্ঘ মধুর দাম্পত্যের। আগের দুই বিয়েই কিন্তু গড়িয়েছে বিচ্ছেদের অতল খাদে।