সমাপন: উপাচার্যের উপস্থিতিতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন অনুষ্ঠান, ২৪ ডিসেম্বর। সুদীপ্ত ভৌমিক।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন কোনও ক্রমে মিটল। বাদ সেধেছিলেন স্বয়ং আচার্য তথা রাজ্যপাল, সর্বোচ্চ আদালতের আদেশ দেখিয়ে। একই আদেশ প্রযোজ্য আরও দু’টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে, যার সমাবর্তনে তিনি সম্প্রতি পৌরোহিত্য করেছেন। বৃহত্তর প্রশ্নে না গিয়ে বলতেই হয়, এ ব্যাপারে যাদবপুর কর্তৃপক্ষ ছাত্রস্বার্থে সাহসী স্বাধীন পদক্ষেপ করেছে, পেয়েছে রাজ্য সরকারের সমর্থন। বলিষ্ঠ পদক্ষেপ করেছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ও, রাজ্য সরকারের নিষেধ সত্ত্বেও কর্মসমিতির বৈঠক ডেকে। নইলে আগামী শিক্ষাবর্ষে লেখাপড়া ব্যাহত হত।
হাসব না কাঁদব, দুই প্রতিপক্ষ অর্থাৎ রাজ্যপাল ও রাজ্য সরকারের আপত্তির অজুহাত একই: রাজ্য জুড়ে যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে তাঁরাই অচলাবস্থা সৃষ্টি করেছেন, তার কর্মসমিতির বৈঠক ডাকতে আইনগত বাধা। উভয়ের অবস্থানে আইনি ভিত্তি অনিশ্চিত, নীতিগত ভিত্তির প্রশ্নই নেই: খণ্ডযুদ্ধে বিভোর হয়ে খেয়ালমতো একই আইনের দোহাই পাড়ছেন আবার অগ্রাহ্য করছেন। রাজায় রাজায় যুদ্ধে প্রাণ যাচ্ছে ছাত্র-শিক্ষক নামী উলুখাগড়ার।
কাজিয়ার সূত্রপাত কয়েক বছর ধরে একাধিক রাজ্যপাল তথা আচার্যের শিক্ষাক্ষেত্রে (অন্যান্য ক্ষেত্রেও) অতিসক্রিয়তায়, প্রায়ই রাজ্য সরকারের সঙ্গে প্রকাশ্য সংঘাতে। যে ব্যক্তির শিক্ষাজগতের অভিজ্ঞতা নেই, শিক্ষায়তনের খুঁটিনাটি ও বৃহত্তর রীতিনীতি তাঁর পক্ষে রাতারাতি বুঝে ওঠা কঠিন। এমন ব্যক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কব্জা করতে চাইলে বিপদ অনিবার্য। এ সমস্যা নিয়ে সরকারের মাথাব্যথার প্রমাণ নেই। নিছক রাজনৈতিক দ্বৈরথবশে রাজ্যপালের বিরুদ্ধে সরকারের পাল্টা চালে উচ্চশিক্ষার নাভিশ্বাস অনিবার্য হয়ে পড়েছিল, অপেক্ষা ছিল সময়ের। আজ সেই সময় আসন্ন: রাজ্যের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় ভেন্টিলেটরে চলছে।
এই ইতিহাসের আর একটা সূত্র আছে। বেশ কিছু দিন আগেই উপাচার্য নিয়োগে নানা ত্রুটি ধরা পড়েছিল। তাতে সতর্ক না হয়ে সরকার থেকে নিয়োগের এক নতুন বিতর্কিত উপায়ের প্রস্তাব হল, চালু হয়নি যদিও। অবধারিত ভাবে পুরো বিষয়টা চলে গেল আদালতের এক্তিয়ারে, অন্য পথে আরও জটিল ভাবে, যেমন স্কুলশিক্ষকদের নিয়োগকাণ্ড।
শিক্ষাসমস্যার উপযুক্ত বিচারস্থল যে আদালত নয়, আদালত নিজেই তা কবুল করে। সুপ্রিম কোর্ট পরামর্শ দিয়েছিল, রাজ্যপাল ও মুখ্যমন্ত্রী যেন ‘কফি খেতে খেতে’ আপসে ঝগড়া মিটিয়ে ফেলেন। ভবী অত সহজে ভোলার নয়। শেষ অবধি আদালত কমিটি করে একত্রিশ জন উপাচার্য নিয়োগ করতে উদ্যত হয়েছে। এটা আদর্শ ব্যবস্থা হতে পারে না। তাতে কর্তাদের হেলদোল নেই: এক দিকে তাঁরা আদালতের দোহাই দিয়ে নিশ্চেষ্ট আছেন, অপর দিকে একই দোহাইয়ে খুশিমতো এটা-ওটা নির্দেশ দিচ্ছেন। কোনও নির্দেশই গঠনমূলক নয়, ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ বন্ধ হচ্ছে, পণ্ড হচ্ছে।
আদালতের বিধান, বর্তমান অস্থায়ী উপাচার্যেরা কোনও গুরুতর সিদ্ধান্ত নেবেন না। কোন সিদ্ধান্ত গুরুতর তার ব্যাখ্যা নেই, প্রত্যেক উপাচার্য নিজের বিচারে চলছেন। আরও বড় কথা, গুরুতর সিদ্ধান্ত না নিলে চলে না, গুরুতর বলেই। অনেক সিদ্ধান্ত আবার একাধারে গুরুতর ও গতানুগতিক। যথাসময়ে সমাবর্তন করা খুবই জরুরি, কিন্তু তাতে বিতর্ক থাকার কথা নয়, ফি-বছর প্রথামতো হয়ে আসছে। বিষয়টা এক দিকে মামুলি, আনুষ্ঠানিক, অন্য দিকে অপরিহার্য। এমন ক্ষেত্রে সরকার আদালতের দ্বারস্থ হতে পারত, এই ‘রুটিন অথচ জরুরি’ বিষয়ে অনুমতির জন্য। তেমন উদ্যোগের লক্ষণ নেই: শিক্ষাব্যবস্থা অচল হয়ে পড়লেই যেন কর্তারা দায়মুক্ত, নির্বিকার।
এই সমস্যার আড়ালে আছে আরও গভীর সমস্যা, শাসককুলের মৌলিক নীতি বা মানসিকতা নিয়ে। আজকের অচলাবস্থা বছর পনেরো আগে ঘটতে পারত না, অন্তত এই মাত্রায় নয়। তার একটা কারণ, কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিভূ রাজ্যপালেরা আগে বিরোধীশাসিত রাজ্যে এমন আগ্রাসী ভূমিকা নিতেন না। ভুললে চলবে না, বর্তমান ক্ষেত্রে (এবং আরও অনেক ক্ষেত্রে) আশু পদক্ষেপ যদিও রাজ্যের করতে হবে, বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে কেন্দ্র-রাজ্যের অশুভ যুগলবন্দির ফলে, এবং কেন্দ্রের কিছু একতরফা হানিকর সিদ্ধান্তে। তাতে রাজ্যের দায়ভাগ কমে না। যে প্রসঙ্গ তুলতে যাচ্ছি, তাতে দু’পক্ষের অবদান বিশেষ করেই সমতুল্য।
বিষয়টা হল বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃত্ব সরাসরি সরকারের মুঠোয় আনা। বোঝা সহজ, উপলক্ষ যা-ই হোক, সব কিছুর শুরুতে দরকার কর্মসমিতির সিদ্ধান্ত বা অনুমোদন। দশ বছর আগেও এগুলি মোটামুটি স্বাধীন ভাবে কাজ করত। রাজ্যপাল যখন সেই কাজ নিজের অধীনে আনতে চাইলেন, রাজ্য সরকার প্রতিঘাত করল সভা ডাকতে সরকারি অনুমোদন আবশ্যিক করে। এই এক চালে বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো দখল চলে গেল সরকারের হাতে, শিক্ষায়তনের স্বাধীনতা শিকেয় তুলে। আজ যখন সরকার বলেন স্কুলশিক্ষার পর্ষদ বা সংসদ স্বশাসিত সংস্থা, তাদের দুর্নীতি রুখতে সরকার তাই অক্ষম, সেটা নিষ্করুণ রসিকতার মতো শোনায়: বিদ্যাক্ষেত্রে স্বশাসনের পীঠস্থান যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি, মনে আসে সেগুলির অসহায় বন্দিদশা।
বিদ্যায়তনের স্বাধীনতা খর্ব করা এই সরকারের প্রকৃতিগত। বাম শাসকেরা প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতায় বড় হাত দেননি; তাঁদের পন্থা ছিল উচ্চপদে নিজেদের লোক বসিয়ে স্বাধীনতার অপব্যবহার করা। পাশাপাশি সদ্ব্যবহারও হয়েছে প্রচুর, সেই পুণ্যেই এই গরিব রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি সারা দেশে আজও অগ্রগণ্য। সম্প্রতি সেই স্বাধীনতা যে ভাবে আক্রান্ত, ফলে সারস্বত স্বার্থ যতটা অবহেলিত, তাতে এই স্থান ধরে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ছে।
উচ্চতর গবেষণা দূরে থাক, ক্লাসঘরের দৈনন্দিন পঠনপাঠন বিপর্যস্ত হচ্ছে শিক্ষকের অভাবে। এখানেও একটা দ্বৈরথ কাজ করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে আচার্যের এক প্রতিনিধি লাগে। সেই প্রতিনিধির নাম রাজভবন থেকে আদায় করা দুষ্কর। এ দিকে সরকারের হুকুম, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আচার্যের কাছে সব চিঠি সরকারের হাত ঘুরে যাবে; ফলে এমনও শোনা যায়, প্রতিনিধি মনোনয়নের আর্জি জানিয়ে চিঠিগুলি আচার্যের হাতে পৌঁছয় না। এখানেও প্রাণ যাচ্ছে সেই উলুখাগড়ার— ছাত্র, শিক্ষক, আর সেই মেধাবী হবু-শিক্ষকের দল, যাঁরা চাকরির আশায় দিন গুনে চলেছেন। শিল্পপতিদের সম্মেলনে রাজ্যের মানবসম্পদের বড়াই করা হয়, অথচ সেই সম্পদ আমরা সক্রিয় ভাবে নষ্ট করছি।
আবার বলছি, এই অবস্থার জন্য বহুলাংশে দায়ী কেন্দ্রের ভ্রান্ত নীতি, বৈষম্য, কার্পণ্য। তবুও এই রত্নগর্ভা রাজ্যের বিশেষ সম্ভাবনা ছিল, উচ্চশিক্ষার উচ্চ মান ও গবেষণার কৃষ্টি বজায় রাখা। বন্ধ্যা রাজনীতির আস্ফালনে তা আমরা হারাতে বসেছি।
এক সময়ে শিক্ষাজগতে রাজনীতি বলতে বোঝাত মূলত ছাত্র আন্দোলন। ক্রমে দেখা গেল, ছাত্রদের চেয়ে শিক্ষকদের রাজনীতি আরও বিধ্বংসী হতে পারে। এখন মনে হয় সেই দিনকালও তুলনায় সরল ছিল, যেন ত্রেতা-র পর দ্বাপর যুগ। আজ কলিকালে সর্বোচ্চ শিক্ষাকর্তারাই রাজনীতির ঘায়ে বিদ্যাক্ষেত্র স্তব্ধ করতে সিদ্ধহস্ত ও সফল।
নকশাল যুগের ‘সেশন জট’-এ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হতে বছর ঘুরে যেত। আজ সিমেস্টার চলছে দু’মাস বিলম্বে স্রেফ সরকারের ঢিলেঢালা বন্দোবস্তে। এ দিকে চার বছরের নতুন পাঠ্যক্রম চালু হয়েছে: কর্তাদের কাজিয়ায় তার তোড়জোর আটকে গেলে বিলম্ব বেড়েই চলবে, নয়তো সিমেস্টারের মেয়াদ ক্ষতিকর ভাবে কমাতে হবে, হয়তো দুটোই। উভয় ক্ষেত্রেই লেখাপড়ার মান বিপন্ন হতে বাধ্য।
উচ্চশিক্ষায় রাজনীতিদুষ্ট প্রশাসনিক কড়াকড়ি কতটা হানিকর, আজ তা শোচনীয় ভাবে স্পষ্ট। খবরদারির বজ্র আঁটুনিতে শিক্ষককুলের মনোবল বিধ্বস্ত, ও দিকে পরিচালনার ফস্কা গেরোয় প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ভেঙে পড়ার মুখে। এই অবস্থার একমাত্র প্রতিকার, সারস্বত স্বার্থ হাতিয়ার করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অভ্যস্ত পথে স্বাধীন শুভবুদ্ধি অনুসারে চলা: আইন যদি স্পষ্ট ভাবে স্বপক্ষে নাও থাকে, স্পষ্ট ভাবে বিপক্ষেও থাকবে না। তার চেয়েও বেশি দরকার শিক্ষকসমাজের সমবেত ভাবে এগিয়ে আসা। মিছিল-ধর্মঘট করে নয়: অচল করার অধিকার রাজপুরুষদের একচেটিয়া থাকুক। রাজনীতিতে পুরোপুরি নিমজ্জিত নয় এমন শিক্ষক সংগঠন এ রাজ্যে আজও সক্রিয়। রাহুমুক্তির কিছু উপায় তারা একত্রে ভেবে বার করুক। দেখা যাক, কর্তাদের হরেক যুযুধান শিবির কত দিন সেই দাবি অগ্রাহ্য করতে পারে।