— প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
আজকের ডিজিটাল যুগ অনেক পুরনো প্রযুক্তির অবসান দেখেছে। মানুষ এখনও হলে গিয়ে সিনেমা দেখার পাশাপাশি অনলাইন স্ট্রিমিং করে মোবাইলে, কম্পিউটারে বা টিভিতে সিনেমা দেখেন। ডিভিডি বা তারও আগের ভিসিডি-র মাধ্যমে সিনেমা দেখার যুগ এখন আর নেই। এই প্রতিস্থাপন একটি ডিজিটাল প্রযুক্তির দ্বারা পূর্বতন ডিজিটাল প্রযুক্তির। একই ভাবে বই প্রকাশের পিছনের কারিগরি প্রযুক্তিতে ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি প্রকাশনার সময়কে হ্রাস করেছে, মানও অনেক ক্ষেত্রেই উন্নত করেছে। কিন্তু মাধ্যম হিসাবে ছাপা বইয়ের চাহিদার আগের তুলনায় পার্থক্য থাকলেও সে বিষয়ে অত্যধিক চিন্তিত হয়ে ওঠার কিছু আছে কি না, সেটা ভাবার বিষয়।
ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, লস অ্যাঞ্জেলেস-এর স্নায়ুবিজ্ঞানী এবং পঠনপাঠন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মেরিয়ান উলফ ‘গভীর পড়া’ এবং ‘অগভীর পড়া’র প্রভাবের মধ্যে পার্থক্য করেছেন। তাঁর বই, রিডার কাম হোম: দ্য রিডিং ব্রেন ইন আ ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড-এ, উলফ পরামর্শ দিয়েছেন যে, আমাদের একটি ‘দ্বি-সাক্ষর’ পড়ার মস্তিষ্ক তৈরি করতে হবে, যা উভয় ধরনের মাধ্যমেই সফল ভাবে প্রয়োগ হবে। মনে রাখতে হবে, কিন্ডল বাজারে আসার (২১ নভেম্বর ২০০৭ সালে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টায় সম্পূর্ণ স্টক নিঃশেষিত হয়েছিল) এক যুগ পরে ব্রিটেনের পুস্তক বিক্রেতাদের সংগঠনের তৎকালীন ম্যানেজিং ডিরেক্টর মেরিল হলস ২০১৯ সালে বলেছিলেন: আমার মনে হয় ই-বুকের বুদ্বুদটা কোনও ভাবে ফেটে গিয়েছে, বিক্রিবাটা কমছে। হাতে ধরে পড়া যায় এমন জিনিসের আবেদন অনেক বেশি। প্রকাশকরা অসাধারণ সব বই তৈরি করছেন, তাই তার প্রচ্ছদের নকশাও প্রায়শই ঝকমকে হচ্ছে, এগুলি সত্যিই সুন্দর।
আজকের ছাপা বইয়ের বিপণনের প্রশ্নে বইয়ের প্রচ্ছদ এই জন্যই এত গুরুত্বপূর্ণ। শুধুমাত্র প্রচ্ছদ নয়, সমস্ত বইয়ের নির্মাণ-মানও সেই কারণেই উন্নত করার প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয়। বাংলা বইয়ের ক্ষেত্রেও। এই সদ্যসমাপ্ত বইমেলার দিকে তাকালে দেখা যায়, এখনও আমাদের বইপ্রেমের বাৎসরিক উৎসবে আবেগের প্লাবন। যুক্তি এবং বিচার সেখানে পিছিয়ে পড়া স্বরমাত্র। তাই বছরের পর বছর বইমেলা হয়, কিন্তু বিভিন্ন ভাবে প্রকাশনা ক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত মানুষরাও মূল কিছু প্রশ্ন থেকে দূরেই থেকে যান। প্রতি বছরই গিল্ড মোট বিক্রির আর্থিক অঙ্কটি জানায়। এই হিসাবের পিছনে তথ্য কী? যত দূর জানি, কোনও প্রকাশক বা স্টল মালিককে (অন্তত ছোট বা মাঝারি) গিল্ডের কাছে তাঁদের বিক্রির হিসাব জানাতে হয় না। একই ভাবে এই বইমেলাটা কেবলমাত্র প্রকাশকদের (যে-হেতু তাঁদের অনেকেরই নিজস্ব বিপণি থাকে না) মেলা না হয়ে কেন তা বই-বিক্রেতাদের সঙ্গে জায়গা এবং বাণিজ্য ভাগ করে নেওয়া হবে, সে প্রশ্নও অধরাই থেকে যায়।
মাথায় রাখতে হবে যে, যত দিন মানুষের জ্ঞানের প্রয়োজন থাকবে, তত দিন মানুষ বইয়ের কাছে পৌঁছে যাবেই। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে আমি নিশ্চিত যে, বইশিল্পের মূল ভিত্তিটি খুব শক্তিশালী ছিল, আছে এবং থাকবে। কিন্তু আমাদের রাজ্যের বাংলা বইয়ের বাজারের দিকে তাকালে অনেক ক্ষেত্রেই সম্পাদনার অনুপস্থিতি বড্ড পীড়াদায়ক। যে কোনও লেখকেরই ভাল সম্পাদকদের কাজকে সম্মান করতে হবে এবং নিজের লেখা যেন সম্পাদনা হয় প্রকাশকের কাছে, এ-হেন দাবিও করতে হবে। বিনিময়ে, প্রকাশনা সংস্থাগুলিকেও দীর্ঘমেয়াদে লেখকদের সমর্থন করতে হবে— নতুন লেখায় উদ্বুদ্ধ করে এবং প্রকাশিত লেখাকে জনসাধারণের কাছে সহজলভ্য রেখে। আজকের ডিজিটাল বিকিকিনির যুগে সাহিত্য-সংস্কৃতি ক্রমশই বিনামূল্যের পরিষেবা হয়ে উঠছে, যেখানে গ্রাহকেরা বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে বিক্রি হয়ে যাচ্ছেন। আমরা যখন ব্লগ লিখি, সমাজমাধ্যমে সাহিত্যচর্চা করি, বিনামূল্যে ই-বুক লিখে ছড়িয়ে দিই কিংবা বিনা খরচে নিজেদের ফিল্ম আপলোড করি, তখন আমরা এই ‘ফ্রি কনটেন্ট’-এর ফাঁদে পড়ে যাই। একটি সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ডিজিটাল সংস্কৃতির দিকে আমাদের এই গমন ত্বরান্বিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এখনও অনিশ্চয়তার অংশীদার হয়ে থাকলে আমাদের ভাষার সাহিত্যের মেয়াদ হয়তো আরও একটি প্রজন্ম টিকে থাকবে। তার পরে, লেখক, সঙ্গীতশিল্পী, চলচ্চিত্র নির্মাতা, সমালোচক, সাংবাদিক বা চিত্রশিল্পীদের জীবিকা নির্বাহের অন্যান্য উপায় খুঁজে বার করতে হবে।
শিশু-কিশোরদের পড়াশোনার শ্রেণিকক্ষটির চরিত্র পাল্টে যাচ্ছে চোখের সামনে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কী ভাবে লিখিত শব্দের সঙ্গে জড়িত হবে, তার দিকনির্দেশ লুকিয়ে আছে এই বিন্যাসে। আজকের অডিয়ো-বুকের বাড়বাড়ন্তে হয়তো সেই যোগসূত্র বেশি করে কথ্য শব্দের সঙ্গেই হবে, জানা নেই। কিন্তু তখনও সাহিত্য থাকবেই, যা মানুষকে জ্ঞানী করবে এবং বইয়ের বিষয় সম্পাদনা তখন আরও জরুরি হয়ে উঠবে।