পাঠ্যসূচি থেকে ইকবালকে বাদ দেওয়া ভারতেরই অসম্মান
Muhammad Iqbal

অখণ্ড ভারতী মানসের ফুল

উপাচার্য সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে বলেছেন, ইকবাল পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখিয়েছেন, ইকবাল ‘সারে জহাঁ সে অচ্ছা’ লিখেছিলেন, কিন্তু তিনি নিজেই তা বিশ্বাস করতেন না।

Advertisement

সুবোধ সরকার

শেষ আপডেট: ১৭ জুন ২০২৩ ০৬:১৩
Share:

ক্রান্তদর্শী: আল্লামা মহম্মদ ইকবাল। উইকিমিডিয়া কমনস

দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচি থেকে উৎপাটিত হলেন কবি ইকবাল। বি এ ক্লাসের ‘মডার্ন ইন্ডিয়ান পলিটিক্যাল থট’ পেপার থেকে বাদ— ক্ষতি হল ছেলেমেয়েদের। যদি কাল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচি থেকে কাজী নজরুল ইসলামকে তুলে ফেলা হয়, সেটা যে ওজনের বিপর্যয় তৈরি করবে, তার অর্ধেকের অর্ধেকও অভিঘাত তৈরি হল না ভারতে। মাত্র পাঁচ জন অধ্যাপক মিটিং চলাকালীন প্রতিবাদ করেছিলেন। উপাচার্য সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে বলেছেন, ইকবাল পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখিয়েছেন, ইকবাল ‘সারে জহাঁ সে অচ্ছা’ লিখেছিলেন, কিন্তু তিনি নিজেই তা বিশ্বাস করতেন না। উপাচার্যকে সম্মান জানাই, তিনি অন্তত অর্ধসত্য বলেছেন— ইকবাল পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখিয়েছেন সেটা ঐতিহাসিক ভাবে সত্য, বিশেষ করে জিন্নাকে উৎসাহিত করেছিলেন, সেটা আমরা জানি। দ্বিতীয় যে কথাটা উপাচার্য বলেছেন, ইকবাল ‘সারে জহাঁ সে’ লিখেছিলেন ঠিকই কিন্তু তিনি তা বিশ্বাস করতেন না, এই তথ্য তিনি কোথা থেকে পেলেন?

Advertisement

নজরুল বাংলাদেশের জাতীয় কবি। ইকবাল পাকিস্তানের জাতীয় কবি। বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ কিন্তু এক জন রবীন্দ্রনাথের লেখা। আবার ইকবাল সারা ভারতের কবি হয়ে উঠেছেন, সামরিক কুচকাওয়াজ থেকে শুরু করে মাঠেঘাটে যুদ্ধে ও শান্তি উপাসনায় ইকবাল ঠোঁটে ঠোঁটে উচ্চারিত সর্বভারতীয় কবি হিসাবে মর্যাদা পেয়ে এসেছেন। তখন কি আমরা অনেক বেশি উদার ছিলাম? এখন অমৃত মহোৎসব করতে এসে আমরা কি পাশের বাড়ির ছেলেটার মুখ থেকে অন্নজল কেড়ে নেব? পাকিস্তানের জাতীয় কবি বলে তিনি আমাদের শত্রু? তাঁকে পড়ানো যাবে না? আমরা যদি নজরুলের কবিতা নজরুলের গান বুকে জড়িয়ে ঘুমোতে পারি, তবে ইকবাল আমাদের কোনখানে ব্যথা দিয়েছেন? এখানেও কেউ কেউ আছেন যাঁরা নজরুলকে ‘বাংলাদেশের জাতীয় কবি’ বলে কুচুটে তর্ক তৈরি করেন। বাঙালি নজরুল ছাড়া বাঁচতে পারবে না। সিলেবাস থেকে তুলে ফেলা— বাঙালি সে কাজ কখনও করেনি, কখনও করবেও না। কেননা ‘বেঙ্গলি নেশনহুড’ দাঁড়িয়ে আছে রামমোহন বিবেকানন্দ রবীন্দ্রনাথ নজরুলের স্বপ্নের উপর।

যে অন্যের ভাষা, পরিধেয়, খাদ্য, কবিতাকে সম্মান করতে পারে না, ক্ষতি তারই বেশি হয়। রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন শুধুই শান্তিনিকেতন হয়ে উঠতে চায়নি, জ্ঞানচর্চার এমন একটা আন্তর্জাতিক উঠোন হয়ে উঠেছিল যার ভিত্তি ছিল ‘অখণ্ড ভারতী মানস’। ভারতে এত সহস্র কোটি টাকা ব্যয় হয় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় চালাতে, কিন্তু দ্বিতীয় একটা শান্তিনিকেতন করতে পারেনি কেউ। কারণ টাকা নয়, জমি নয়, স্বপ্ন দেখার এখন সাহস নেই আমাদের। লন্ঠনের আলোতেই ‘অখণ্ডভারতী মানস’ জ্বলজ্বল করে উঠতে পেরেছিল। এখন সব শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত, আলো কই? এক ছটাক জমি নিয়ে কুরুচিকর লড়াই করে যাও, দিল্লিতে নম্বর বাড়বে। বাঙালির ‘অখণ্ড ভারতী মানস’কে তুচ্ছ জমি সংঘর্ষে নামিয়ে আনো। পৃথিবীর লোক ছিছিক্কার করুক।

Advertisement

সেই ‘অখণ্ড ভারতী মানস’-এর সন্তান কবি ইকবাল। তিনি আল্লা এবং উপনিষদ হাতে নিয়ে জন্মেছিলেন। জন্ম পঞ্জাবের শিয়ালকোটে। ইকবালের শিরায় রয়েছে কাশ্মীরি ব্রাহ্মণের রক্ত। তিনশো বছর আগে তাঁদের পরিবার ইসলাম গ্রহণ করে। লাহোরে পড়াশোনা করে তিনি চলে যান কেমব্রিজে, সেখান থেকে জার্মানির মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে, সেখান থেকেই তিনি পিএইচ ডি করেন। উপনিষদ পড়ে যিনি বড় হয়েছেন, উপনিষদ যাঁর কাছে শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ, তিনি রবীন্দ্রনাথের ‘দূত’ অমিয় চক্রবর্তীকে লিখছেন ভগবদ্‌গীতার কী গভীর প্রভাব তাঁর লেখায়, তাঁর জীবনে! তাঁর দু’টি বিখ্যাত কাব্য, আসরার-ই-খুদি এবং রুমুজ-ই-বেখুদি’তে ইকবাল নিজেকে বিলীন করে দেওয়ার কথা বলছেন, নিজেকে সবার মধ্যে নিয়ে যেতে বলছেন, সমাজের মধ্যে সবার উপকারের জন্যে নিজেকে বিলীন করে দিতে বলছেন। কোন গান মনে পড়ে এ কথা শুনে? ‘আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া’, ‘আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না’, ‘বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো’... এ রকম অনেক গান, উপনিষদের কার্নিস ছুঁয়ে গীতবিতান-এর পৃষ্ঠায় নেমে এসেছে যারা। রেনল্ড নিকলসন আসরার-ই-খুদি ইংরেজিতে অনুবাদ করে ইকবালকে পশ্চিমে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন এই বলে যে, ইকবাল যেন আমাদের মধ্যে মসিহার মতো এসেছেন, মৃতকেও নাড়িয়ে দিয়েছেন জীবনের ছন্দে। ইকবাল মসিহা না সন্ত সেটা বড় কথা নয়, তার চেয়েও বড় কথা তাঁর কবিতা পাশ্চাত্য থেকে সিরিয়া প্যালেস্টাইন পশ্চিম এশিয়া হয়ে, আফগানিস্তান পাকিস্তান হয়ে ভারতে যে ভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল সে তো ভারতের সম্মান, সেটা ‘সারে জহাঁ সে অচ্ছা’র উদ্‌যাপন। ইকবালকে এখন ভারতীয় পাঠ্যসূচি থেকে উপড়ে ফেলে দিতে হলে ইকবালের কবিতা থেকে ছাঁকনি দিয়ে ছেঁকে ছেঁকে ‘প্যান-ইন্ডিয়ান ইথোজ়’ বার করে গঙ্গায় ভাসিয়ে দিতে হবে।

যে কাব্যটিকে ইকবালের শ্রেষ্ঠ এবং সবচেয়ে পরিণত কাব্য হিসাবে ধরা হয়, তার নাম জাভিদনামা। সেখানে তিনি ঋষি বিশ্বামিত্র ও ভর্তৃহরির বন্দনা করেছেন। স্বপ্ন দেখেছেন একটা সুন্দর দেশের— “আকাশ সেই দেশে ধোঁয়ায় ধোঁয়াকার নয়/... তাদের নেই কোনও জমির মালিকের ভয়/ ...তাদের ফসলে তো অন্য কারো নেই হাত/ সে দেশে কোনখানে সৈন্য নেই কোনো, নেই-বা ব্যূহনির্মাণ/...কানের পীড়া নেই আর্ত ভিখিরির কান্নায়” (অনুবাদ: শঙ্খ ঘোষ)। বাং-ই-দারা বইটি থেকে প্রথম সংস্করণের ভূমিকাটি তিনি বাদ দিয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে অমিয় চক্রবর্তীকে লিখছেন, বাদ দিতে হল মোল্লা-মৌলবির আক্রমণে, কেননা এই ভূমিকাতেই তিনি লিখেছিলেন— উপনিষদের গভীর প্রভাব রয়েছে তাঁর উপর। ইকবাল বলেছিলেন, দলকে বলেছিলাম তোমাদের মতামতে আমি বিশ্বাসী নই, আমি কবি। দল বলেছিল, তোমার বিশ্বাস চাই না, তোমার নামটা চাই। এই জন্যই কী তিনি লিখেছিলেন, “জাহিদ-এ তং নজ়রনে মুঝে কাফির জানা/ আউর কাফির ইয়ে সমঝোতা হ্যয় মুসলমান হুঁ ম্যয়।” সেই চিরন্তন প্যারাডক্স— এরা আমাকে কাফের ভাবে, আর কাফের আমাকে ভাবে মুসলমান।

জাভিদনামা-য় তিনি কবিতাময় ভাষায় লিখছেন, পুঁজিবাদ ও মার্ক্সবাদ দুটো থেকেই সরে এসে একটা প্যান-ইন্ডিয়ান আত্মশক্তি খুঁজছিলেন যা তাঁকে পশ্চিম-নির্ভরতা থেকে মুক্তি দেবে। দিল্লির যশস্বী অধ্যাপকেরা এটাকেই তো পতাকা করে ইকবালকে নিজেদের বলে পতাকা ধরিয়ে দিতে পারতেন। তাতে নাহয় উপনিষদের গায়ে ইসলামের একটু গন্ধ লেগে যেত। এমন কোন পুজো আছে ভারতবর্ষে যার গায়ে ইসলামের ছোঁয়া নেই? যে ফুল দিয়ে পুজো হয় সেই ফুল বীজ থেকে চারা হয়ে গাছ হয়ে ফুল হয়ে রিকশা চড়ে ট্রেনে চড়ে বাজার হয়ে কোশাকুশি পর্যন্ত পৌঁছতে যত হাত হয়ে আসে, তার ক’টা হাত ‘আমাদের’ আর ক’টা হাত ‘ওদের’ তার কি কোনও পরিসংখ্যান আছে? ইকবাল হলেন সেই ফুল, আর ভারতবর্ষ সেই ফুলের গাছ। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় ফুলগাছের ডাল কেটে কী ভাবছে জানি না, তবে ফুল ফুটবে, ফুলকে কেউ আটকাতে পারেনি। পাবলো নেরুদা লিখেছিলেন, ফুলগুলো সব ছিঁড়ে ফেলতে পারো, কিন্তু বসন্তকে আটকাতে পারো না।

ইকবাল শব্দটার একটা অর্থ ‘গরিমা’। স্কুলে ইকবাল দেরিতে পৌঁছতেন। এক দিন মাস্টারমশাই জিজ্ঞেস করলেন, তুমি দেরি করে আসো কেন? বারো বছরের ইকবাল নিজের নামের মানেটা জানতেন, মাস্টারমশাইকে বলেছিলেন, “ইকবাল একটু দেরিতে পৌঁছয়।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement