লড়াই: বকেয়া মহার্ঘ ভাতার দাবিতে আন্দোলনে বসেছেন সরকারি কর্মচারীরা। ৩০ মার্চ, কলকাতা। পিটিআই।
গত তিন বছরে বিশ্ব জুড়ে মাথাচাড়া দিয়েছে চড়া মূল্যবৃদ্ধি, ভারতেও যার আঁচ পড়েছে। কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান মন্ত্রকের হিসাবে, দেশে খুচরো মূল্যবৃদ্ধির বার্ষিক হার গত তিন অর্থবর্ষে গড়ে বার্ষিক ৬ শতাংশের বেশি থেকেছে। পশ্চিমবঙ্গে সেই হার গত তিন বছরে থেকেছে ৭ শতাংশের উপরে। এই অবস্থায় দীর্ঘ দিনের বকেয়া মহার্ঘ ভাতা আদায় করার দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন পশ্চিমবঙ্গের সরকারি ও সরকার-পোষিত কর্মচারীরা।
কেন্দ্রীয় সরকার সম্প্রতি কর্মচারীদের মহার্ঘ ভাতার হার মূল বেতনের উপর ৩৮% থেকে বাড়িয়ে ৪২% করেছে। কেন্দ্রের সপ্তম বেতন কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী ২০১৬ সাল থেকে ডিএ-র এই হার নির্ণয় করা হচ্ছে। দেশের অধিকাংশ রাজ্য সরকারই তাদের কর্মচারীদের কেন্দ্রীয় হারে ডিএ দেয়। কিছু রাজ্য কেন্দ্রীয় হারের থেকে একটু পিছিয়ে থাকলেও বর্তমানে ৩০ শতাংশের বেশি হারে ডিএ দেয়। ত্রিপুরা সরকার বর্তমানে ডিএ দেয় ২০% হারে। পশ্চিমবঙ্গের সরকারি কর্মচারীদের ডিএ-র হার দেশের মধ্যে সর্বনিম্ন— মাত্র ৬%।
কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারীদের মধ্যে সর্বনিম্ন স্কেলে মাসিক বেতন আঠারো হাজার টাকা, তার উপর ৪২% ডিএ ধরে বেতন দাঁড়ায় ২৫৫৬০ টাকা। পশ্চিমবঙ্গের সরকারি কর্মীদের মধ্যে সর্বনিম্ন স্কেলে বেতন সতেরো হাজার টাকা, ৬% ডিএ ধরে মাসিক বেতন হয় ১৮০২০ টাকা। অর্থাৎ, পশ্চিমবঙ্গের সর্বনিম্ন স্কেলে বেতন পাওয়া কোনও সরকারি কর্মচারী কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মীদের থেকে মাসে অন্তত ৭৫৪০ টাকা কম বেতন পান। অন্যান্য ভাতা ধরলে পার্থক্য আরও বেশি। উচ্চতর স্কেলগুলিতে কেন্দ্র-রাজ্য বেতনের পার্থক্যও অনেক বেশি। এই রাজ্যের কর্মচারীরা অন্যান্য রাজ্যের সরকারি কর্মীদের থেকেও গড়ে মাসিক চার-পাঁচ হাজার টাকা কম বেতন পাচ্ছেন।
কলকাতা হাই কোর্টের রায়কে উপেক্ষা করে ২০০৬ সাল থেকে ন্যায্য হারে ডিএ বকেয়া হয়ে আছে। এই নিয়ে রাজ্য সরকার সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টে মামলা করে জানিয়েছে যে, হাই কোর্টের রায় মেনে বকেয়া ডিএ মেটানোর আর্থিক সামর্থ্য রাজ্য সরকারের নেই। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, রাজ্য কোষাগারের যা অবস্থা, তাতে কেন্দ্রের সমতুল্য হারে এই রাজ্যে ডিএ দেওয়া সম্ভবপর নয়।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রাজস্ব ঘাটতি ২০১৮-১৯ অর্থবর্ষের শেষে রাজ্যের মোট উৎপাদনের (জিএসডিপি) এক শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২২-২৩’এর শেষে এসে দাঁড়িয়েছে ২.৫৫ শতাংশে। সরকারের মোট ঋণের বোঝা ২০১৯-এর মার্চে ৪ লক্ষ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ২০২৩-এর মার্চের শেষে ৬ লক্ষ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। তবে গত চার বছরে রাজ্যের সরকারি কোষাগারের এই অবনতি কিন্তু শুধু পশ্চিমবঙ্গেই ঘটেনি, অতিমারি এবং মন্দার পর কেন্দ্র এবং অনেক রাজ্যেই রাজস্ব ঘাটতি, সরকারি ঋণ এবং সুদের বোঝা বেড়েছে।
রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের তথ্য অনুযায়ী, তামিলনাড়ু এবং উত্তরপ্রদেশে সরকারের মোট ঋণের বোঝা ২০২৩-এর মার্চের শেষে সাত লক্ষ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে, মহারাষ্ট্রের ৬.৮ লক্ষ কোটি। রাজ্যের মোট উৎপাদনের (জিএসডিপি-র) অনুপাতে মোট সরকারি ঋণ ২০২৩ মার্চের শেষে পশ্চিমবঙ্গে ৩৫ শতাংশ, বিহার আর কেরলে ৩৯ শতাংশ, রাজস্থানে ৪০ শতাংশ আর পঞ্জাবে দেশের সর্বোচ্চ, ৪৭.৬ শতাংশ। এই রাজ্যগুলিতে কিন্তু কর্মচারীদের ডিএ কেটে রাজস্ব ঘাটতি কমানোর চেষ্টা হচ্ছে না।
রাজ্য সরকার কর্মীদের মাইনে দেয় তার রাজস্ব আয় থেকে; সেই রাজস্ব আয়ের উৎস মূলত চার রকমের— কেন্দ্রীয় করের ভাগ, কেন্দ্রীয় অনুদান, রাজ্যের নিজস্ব কর এবং রাজ্যের নিজস্ব কর-ব্যতীত রাজস্ব। চতুর্দশ এবং পঞ্চদশ কেন্দ্রীয় অর্থ কমিশনের রিপোর্টে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ২০১০-১১ সালে, বামফ্রন্ট সরকারের শেষ বছরে, কেন্দ্রীয় করের ভাগ এবং অনুদান মিলিয়ে কেন্দ্র পশ্চিমবঙ্গকে দিয়েছিল ২৩৭৫৪ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে কেন্দ্রীয় করের ভাগ এবং অনুদান মিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গ পেয়েছে ১.১৩ লক্ষ কোটি টাকা, অর্থাৎ কেন্দ্রের থেকে পশ্চিমবঙ্গের রাজস্ব প্রাপ্তি গত বারো বছরে চার গুণের বেশি বেড়েছে, মূলত চতুর্দশ অর্থ কমিশনের সুপারিশের ফলে।
২০২২-২৩ অর্থবর্ষে দেশের সমস্ত রাজ্যের কেন্দ্রের করের ভাগ এবং অনুদান মিলিয়ে গড় প্রাপ্তি যেখানে ছিল ভারতের জিডিপি-র ৬.৩%, সেখানে পশ্চিমবঙ্গের কেন্দ্রের থেকে প্রাপ্তি রাজ্যের জিএসডিপি-র ৭.৩%। অন্য দিকে, সমস্ত রাজ্যের নিজস্ব কর আদায়ের গড় যখন জিএসডিপি-র ৬.৫ শতাংশ আর কর-ব্যতীত রাজস্ব আদায়ের গড় জিএসডিপি-র এক শতাংশ, সেখানে পশ্চিমবঙ্গের নিজস্ব কর আদায় দীর্ঘ কাল ধরে আটকে আছে জিএসডিপি-র ৫ শতাংশে, কর-ব্যতীত রাজস্ব আদায় নেমে গেছে ০.১ শতাংশে। এর থেকে স্পষ্ট যে, পশ্চিমবঙ্গের রাজস্ব ঘাটতি বা ঋণ বৃদ্ধির জন্য কেন্দ্রের বঞ্চনা নয়, দায়ী রাজ্যের নিজস্ব কর এবং কর-ব্যতীত রাজস্ব আয় বাড়ানোর ক্ষেত্রে ব্যর্থতা।
রাজ্যের নিজস্ব করের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ স্ট্যাম্প ডিউটি, গাড়ির উপর কর এবং ভূমি রাজস্ব আদায়ে দেশের অন্য বড় রাজ্যগুলির তুলনায় অনেক পিছিয়ে। কর-ব্যতীত রাজস্ব আয়ে রাজ্যের করুণ অবস্থার জন্য এক দিকে যেমন বেশ কিছু ক্ষেত্রে ‘বিনামূল্যে’ নিম্নমানের সরকারি পরিষেবা দেওয়ার সংস্কৃতি দায়ী, অন্য দিকে রাজ্য সরকার পরিচালিত ৭৩টি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বেহাল দশার অবদানও কম নয়। পশ্চিমবঙ্গে বালি, পাথর, মাটি, কয়লা ইত্যাদির মতো প্রাকৃতিক সম্পদের খনন থেকে যে পরিমাণ রাজস্ব আদায় হওয়ার কথা, তার সিকি ভাগও সরকারি কোষাগারে ঢোকে না— মূলত শাসক দলের বেলাগাম দুর্নীতির কারণে।
হালে কমানো স্ট্যাম্প ডিউটি এবং সার্কল রেটের হার বৃদ্ধি করে, বিলাসবহুল গাড়ির উপর কর বৃদ্ধি করে, ভূমি রাজস্ব বৃদ্ধি করে, রাজ্যের রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলিকে লাভজনক বানিয়ে, কিছু ক্ষেত্রে সরকারি পরিষেবার মান উন্নত করার বিনিময়ে মাসুলবৃদ্ধি করে এবং সর্বোপরি প্রাকৃতিক সম্পদের খননে চুরি-তোলাবাজি বন্ধ করে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর যথেষ্ট সুযোগ আছে। রাজ্যের নিজস্ব কর এবং কর-ব্যতীত রাজস্ব আয় জিএসডিপি-র ১ শতাংশ-বিন্দু করে বাড়াতে পারলেই ৩৫ হাজার কোটি টাকা বাড়তি আয় বৃদ্ধি হতে পারে, যা দিয়ে রাজ্যের সরকারি কর্মচারীদের বর্ধিত হারে ডিএ প্রদান এবং বকেয়া ডিএ মেটানো সম্ভব।
সুপ্রিম কোর্টে রাজ্য সরকারের দায়ের করা মামলায় বলা হয়েছে রাজ্য সরকারি কর্মচারীর সংখ্যা ৩.১৯ লক্ষ। ২০০৯ সালে প্রকাশিত পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চম বেতন কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী সরকারি কর্মচারীদের অনুমোদিত পদ ছিল ৯.৬১ লক্ষ, যার মধ্যে এক লক্ষের মতন শূন্যপদ ছিল। ২০১৪-১৫’র সরকারি স্টাফ সেন্সাস অনুযায়ী সরকারি দফতরের কর্মী এবং সরকারি স্কুল-শিক্ষকের সংখ্যা জুড়ে কর্মচারীদের সংখ্যা ছিল ৭.৪৫ লক্ষ। ২০২৩-এ এসে রাজ্য সরকারি কর্মচারীর সংখ্যা ৪ লক্ষের বেশি কমে ৩.১৯ লক্ষ হয়ে গেল কী করে? ৩.১৯ লক্ষের মোট সংখ্যায় স্কুল-শিক্ষকদের ধরা আছে, না কি রাজ্য সরকার ডিএ-র হিসাব স্কুল-শিক্ষকদের বাদ রেখেই কষছে, সেটাও পরিষ্কার নয়।
বর্তমান সরকারের আমলে পশ্চিমবঙ্গে ২০১৫ সালে ষষ্ঠ বেতন কমিশন গঠিত হয়েছিল, যার রিপোর্ট আসে ২০১৯ সালে। সেই রিপোর্ট আজ পর্যন্ত রাজ্য সরকার ধামাচাপা দিয়ে রেখেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের সমস্ত বেতন কমিশনের রিপোর্ট সরকারি ওয়েবসাইটে পাওয়া যায়, অথচ পশ্চিমবঙ্গের বেতন কমিশনের রিপোর্ট জনপরিসরে নেই। তাই রাজ্যের বেতন কমিশন কোন তথ্য বা যুক্তির ভিত্তিতে কী সুপারিশ করেছে, জানার উপায় নেই। সরকারি কর্মীর মোট সংখ্যা, শূন্যপদ এবং নিয়োগ সংক্রান্ত তথ্যের ব্যাপারে রাজ্য সরকারের স্বচ্ছতার অভাব স্পষ্ট। সরকারের উচিত ষষ্ঠ বেতন কমিশনের রিপোর্ট এবং সরকারি স্টাফ সেন্সাসের রিপোর্ট যথাশীঘ্র জনসমক্ষে নিয়ে আসা।