—ফাইল চিত্র।
সম্প্রতি আছড়ে পড়া ‘রেমাল’ ঘূর্ণিঝড়ের সময় ক্রিকেটের ধারাবিবরণীর ঢঙে টেলিভিশন চ্যানেলে মানুষ দেখেছে ঝড়ের আনাগোনা। কিন্তু প্রযুক্তিনির্ভর বিপর্যয়ের পূর্বাভাস এখন যেমন কার্যকর, সেইমতো সরকারি প্রস্তুতি কিংবা পরিকল্পনাও কি কার্যকর হচ্ছে? রেমালের ধাক্কা আবার প্রমাণ করে দিল বিপর্যয় মোকাবিলার পরিকাঠামোর করুণ অবস্থা।
বিপর্যয় মোকাবিলার ক্ষেত্রে বিপর্যয় পূর্ববর্তী প্রয়াস, বিপর্যয় চলাকালীন তৎপরতা এবং পরবর্তী কালের শিক্ষা গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। বিপর্যয়ের চরিত্র এবং ব্যাপ্তি সব রাজ্যে এক নয়। রাজস্থানে খরা, সিকিমে ভূমিকম্প যেমন মুখ্য চরিত্রে, তেমনই পশ্চিমবঙ্গে ঘূর্ণিঝড় এবং বন্যা। ফলে ঘূর্ণিঝড়, বন্যা— দুটোরই সঙ্ঘবদ্ধ উপায়ে মোকাবিলা জরুরি। কারণ, ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে ভারী বৃষ্টি স্বাভাবিক ঘটনা। আর দীর্ঘক্ষণের ভারী বৃষ্টির প্রভাবে গ্রাম, শহর, অথবা মরসুমি জলে ভরা নদীতে প্লাবন অবশ্যম্ভাবী। এ ক্ষেত্রে বোঝা দরকার, ঘূর্ণিঝড় তৈরি হচ্ছে আন্দামানে, আছড়ে পড়ছে ওড়িশায়, বৃষ্টি হচ্ছে ঝাড়খণ্ডে আর বন্যা হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে। সুতরাং, বিপর্যয় মোকাবিলায় উপদ্রুত রাজ্যগুলিতে সঙ্ঘবদ্ধ এবং সুসংহত সংস্কার আশু প্রয়োজন।
গবেষণায় প্রকাশিত, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বঙ্গোপসাগরের জলের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার এই অঞ্চলের বিভিন্ন সাগর বা মহাসাগরের তুলনায় প্রায় সাত গুণ বেশি। ফলে সমুদ্রের জলের উষ্ণতা দ্রুত বৃদ্ধির সঙ্গেই বাড়ছে সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ের মাত্রা ও সংখ্যা। বঙ্গোপসাগরে তৈরি হওয়া ঘূর্ণিঝড়ের আক্রমণের মুখে পড়ছে অন্ধ্রপ্রদেশ, ওড়িশা এবং পশ্চিমবঙ্গের উপকূলবর্তী অঞ্চল। আক্রান্ত হচ্ছেন প্রান্তিক আয়ের মানুষ। অথচ, ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের মতোই আজও এ রাজ্যে ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় সুন্দরবন-সহ উপকূল রক্ষার মাস্টার প্ল্যান নির্মাণ অধরা থেকে গিয়েছে।
বিপর্যয় মোকাবিলার ক্ষেত্রে বিপর্যয়ের চরিত্র, আক্রান্ত অঞ্চলের আর্থসামাজিক বিন্যাস এবং সেই বিন্যাসে সবচেয়ে স্পর্শকাতর প্রান্তিক মানুষদের রক্ষার ভাবনা জরুরি। দুর্ভাগ্য, সরকারি পরিকল্পনা আর নজরদারির অভাবে গত ত্রিশ বছরে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ হ্রাস পেয়েছে প্রায় ২৫%। আয়লা কিংবা
আমপানের পর যে তৎপরতায় ম্যানগ্রোভ লাগানো সরকারের লক্ষ্য ছিল, কার্যত সেটি হয়নি। পাশাপাশি নিত্যদিন কাটা ম্যানগ্রোভের ডালপালা হয়ে উঠেছে ইটভাটায় বিকল্প জ্বালানি। সস্তায় দ্রুত লাভের লক্ষ্যে সেই ইটভাটার
পলিমাটির প্রয়োজনে জায়গায় জায়গায় নদীবাঁধ কেটে জল ঢুকিয়ে তার থেকে
পলি তোলার কাজ চলছে পুলিশ-প্রশাসনের নাকের ডগায়। ফলে ম্যানগ্রোভ ছাঁটা জঙ্গলের উপর দিয়ে ছুটে আসা ঝড়ের ধাক্কাকে প্রতিহত করার ক্ষমতা
কমছে এই অঞ্চলের। ঘূর্ণিঝড়ের সময় ঝোড়ো হাওয়ার ধাক্কায় বেড়ে চলেছে জলোচ্ছ্বাসের বহর। ভরা কটালের সময় এমন ঝড়ের ধাক্কায় নদীর জলের বাড়তি গতি ভেঙে ফেলছে দুর্বল কাদামাটির বাঁধ। সুন্দরবন প্রান্তিক আয়ের গ্রামীণ মানুষের জনপদ হওয়ায় ঐতিহাসিক ভাবেই নদী বাঁধের মতো পরিকাঠামো নির্মাণ উপেক্ষিত রয়ে গিয়েছে। অথচ, এই মানুষদের জীবনজীবিকার প্রয়োজনে লাইফলাইন হয়ে উঠেছে এখানকার নদী বাঁধ।
সুন্দরবনের সিংহভাগ নদী মোহনার কাছে হওয়ায় ধারাবাহিক ভাবে পলি পড়ায় সেগুলির জলধারণ ক্ষমতা কমেছে। ফলে বাড়ছে জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা। অথচ, কেন্দ্র কিংবা রাজ্য সরকারের কাছে সুন্দরবনের নদী-খাঁড়িগুলিতে জলোচ্ছ্বাসের সময় জলের উচ্চতা বৃদ্ধির নির্ভরযোগ্য তথ্য-পরিসংখ্যান নেই। জলোচ্ছ্বাসের হাত থেকে নদী বাঁধ বাঁচাতে চাই বাঁধের উচ্চতা ও শক্তি বৃদ্ধি। প্রয়োজন উচ্চমানের নির্মাণ সামগ্রী ও নির্মাণ প্রযুক্তির প্রয়োগ। নদী বাঁধের উচ্চতা এবং ঢাল বাড়াতে চাই বাঁধের চওড়া ভিত, যার জন্য দরকার বাড়তি জমি। কিন্তু এ রাজ্যে জমি-জট চওড়া নদী বাঁধের ক্ষেত্রে অন্তরায়। রাজনীতির জটে দেড় দশক আগে আয়লায় বিপর্যস্ত ৭৭৮ কিলোমিটার ভঙ্গুর বাঁধ নির্মাণের কেন্দ্রীয় অনুদানের প্রায় ৪০০০ কোটি টাকা রাজ্য থেকে ফেরত চলে গেছে। সুন্দরবনের নদীগুলির জলধারণ ক্ষমতা বাড়ানোর লক্ষ্যে প্রয়োজন নদীবক্ষের পলি কেটে সরিয়ে সেই মাটিকেই বাঁধ নির্মাণে ব্যবহার করা। কংক্রিটের আস্তরণ থেকে শুরু করে চুন-মাটির মিশ্রণ, বাঁশের কঞ্চি থেকে শুরু করে ‘জুট জিয়ো-টেক্সটাইল’ কিংবা ‘জিয়ো ব্যাগ’-এর মতো পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি বাঁধ নির্মাণে ব্যবহার করা যায়। নদী বাঁধ নির্মাণের ক্ষেত্রে ফলিত গবেষণা এই দেশে কিংবা রাজ্যে যথেষ্ট পরিমাণে হয়নি। পরীক্ষামূলক বাঁধ নির্মাণ করে সেগুলির স্থায়িত্বের মূল্যায়ন দ্রুত শুরু করা উচিত।
পাশাপাশি প্রয়োজন ঘূর্ণিঝড়ের দাপটে বিপন্ন জেলা এবং ব্লকগুলির দুর্বল কাঁচাবাড়িগুলি চিহ্নিত করে বিভিন্ন সরকারি আবাস যোজনা প্রকল্পের অধীনে পাকা বাড়িতে পরিণত করা। এ বারের ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত শক্তপোক্ত ছাদ না থাকা মাটি এবং ইটের বাড়ি। তা ছাড়া ভাবতে হবে মাটিতে নোনাজলের স্তর বৃদ্ধির কারণে তৈরি হওয়া পানীয় জলের সমস্যার কথাও। সৌরবিদ্যুৎ দিয়ে পানীয় জলকে পরিস্রুত করার প্রকল্প এবং জলের সংযোগ গড়তে অবিলম্বে চাই সরকারি পদক্ষেপ। সুন্দরবনে ধারাবাহিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়া ৬০টি গ্রামের পাঁচ লক্ষ মানুষের বিকল্প পুনর্বাসন ভাবনাও জরুরি। সুন্দরবনের বাস্তুতন্ত্র রক্ষার স্বার্থে কাজগুলি দ্রুত করা চাই।