দশ বছর ধরে প্রস্তুতি চলেছিল। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে দিল্লিকে ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সিটি’ ঘোষণা করার জন্য আবেদন জমা পড়েছিল রাষ্ট্রপুঞ্জের সংস্থা ‘ইউনেসকো’র কাছে। ব্রিটিশদের তৈরি ‘ইমপেরিয়াল নিউ দিল্লি’ ও মোগল সম্রাট শাহজাহানের তৈরি ‘শাহজাহানাবাদ’-কে তুলে ধরা হয়েছিল রাষ্ট্রপুঞ্জের দরবারে।
চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হওয়ার ঠিক এক মাস আগে আচমকাই জানা গেল, নরেন্দ্র মোদী সরকার সেই আবেদন প্রত্যাহার করে নিয়েছে। কেন? মোদী সরকারের বহু কাজকারবারের মতো এই পদক্ষেপেরও কোনও সরকারি ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। আকারে-ইঙ্গিতে বোঝানো হয়েছিল, ‘হেরিটেজ সিটি’ বলে ঘোষিত হলে না কি দিল্লির উন্নয়নের কাজে বাধা পড়তে পারে! সংরক্ষণের গেরোয় নগরোন্নয়নের কাজ আটকে যাবে।
সেটাও এমনই মে মাস। ২০১৫ সাল। সবেমাত্র এক বছর হয়েছে, নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রীর গদিতে বসেছেন। ছয় বছর আগের সেই সিদ্ধান্তেই বোঝা গিয়েছিল, মোদী এ বার নিজের মতো করে, নতুন করে রাজধানী দিল্লিকে সাজাবেন। শাহজাহান বা ব্রিটিশ স্থপতি হার্বাট বেকার-এডউইন লুটিয়ান্সের দিল্লি নয়— তিনি চান ‘মোদীর দিল্লি’।
অমরত্বের প্রত্যাশা সকলেরই থাকে। তাই বলে নরেন্দ্র মোদী কি এখন সম্রাট নিরো হয়ে গেলেন? তাঁর রাজনৈতিক বোধবুদ্ধি কি পুরোপুরি লোপ পেল? কোভিডে মৃত্যুর তালিকা বেড়েই চলেছে। গঙ্গায় শব ভাসছে। কোভিডের টিকা-ওষুধ, অক্সিজেন-হাসপাতালের বেডের জন্য হাহাকার। প্রধানমন্ত্রীর দিকেই অভিযোগের আঙুল। তা সত্ত্বেও তিনি কী ভাবে দিল্লির রাজপথ ও তার চার পাশের এলাকা নিয়ে সেন্ট্রাল ভিস্টা ঢেলে সাজানোর কাজ চালিয়ে যেতে বলেন? এতে যে রাজনৈতিক ভাবে ভুল বার্তা যাচ্ছে, তা কি তিনি বুঝতে পারছেন না?
নরেন্দ্র মোদীকে যাঁরা জানেন, তাঁরা বলবেন, এটাই মোদীর রাজনীতি। গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হয়ে তিনি রাজধানী গাঁধীনগর, আমদাবাদকে এ ভাবেই ঢেলে সাজিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর গদিতে বসে এখন তিনি রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে ইন্ডিয়া গেট পর্যন্ত রাজপথের সৌন্দর্যায়নে মন দিয়েছেন। রাজপথের দু’পাশে স্বাধীনতার পরে কংগ্রেস জমানায় তৈরি পুরনো সরকারি ভবন ভেঙে নতুন নতুন সচিবালয় তৈরি করতে চান। গাঁধীনগরেও তিনি একই ভাবে গুজরাত বিধানসভার রাস্তার দু’পাশে নতুন নতুন সচিবালয় তৈরি করিয়েছিলেন। ‘স্বর্ণিম সঙ্কুল’ নামের সেই প্রকল্পের স্থপতি বিমল পটেলকেই এ বার দিল্লির সেন্ট্রাল ভিস্টা সাজানোর দায়িত্ব দিয়েছেন মোদী। একই ভাবনা। শুধু বড় মাপে।
বিজেপির নেতা-মন্ত্রীরা স্বীকার করেন, আমদাবাদের সবরমতী রিভারফ্রন্টের মতো সেন্ট্রাল ভিস্টাও প্রধানমন্ত্রীর ‘ড্রিম প্রজেক্ট’। ২০১৪-র লোকসভা ভোটের প্রচারে মোদীর ছবির পিছনে ‘ব্যাকড্রপ’ হিসেবে থাকত সবরমতী রিভারফ্রন্টের ছবি। বর্ষার সময় ছাড়া অবশ্য সবরমতীতে জল থাকে না। নর্মদা ক্যানাল থেকে পাম্প করে আনা জল সবরমতী রিভারফ্রন্টের ১১ কিলোমিটার অংশে স্থির হয়ে থাকে। সে অন্য গল্প। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরেও চিনের শি চিনফিংয়ের সঙ্গে বৈঠক বা গুজরাত ভোটের আগে সি-প্লেনে দাঁড়িয়ে ‘ফোটো-অপ’এর জন্য মোদী এই রিভারফ্রন্টকেই বেছেছিলেন।
নিছক শখ-আহ্লাদ নয়। বিশুদ্ধ রাজনীতি। যে কোনও শাসকই নিজের মতো দেশ বা রাজ্যের রাজধানীর একটা অংশকে সাজিয়ে তুলতে চান। নিজের উন্নয়নের কর্মকাণ্ডের প্রতীক হিসেবে। শিশুমৃত্যুর হার কমাতে বা শিক্ষার মান বাড়াতে অনেক সময় লাগে। উন্নয়নের প্রমাণ হিসেবে আমজনতার মনে ও সব তেমন দাগ কাটে না। বদলে শহরের একাংশ ঝাঁ-চকচকে করে তুললে, সহজে চোখ টানা যায়। ভোটারদের মনেও ছাপ পড়ে।
নতুন করে সাজানো আমদাবাদের রিভারফ্রন্ট, গাঁধীনগরের ‘স্বর্ণিম সঙ্কুল’, ‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাত’ শিল্প সম্মেলনের জন্য তৈরি বিশাল ‘মহাত্মা মন্দির’— নগরোন্নয়নের এই সব প্রকল্পই ছিল মোদীর ‘গুজরাত মডেল’-এর প্রতীক। প্রধানমন্ত্রী পদের দাবিদার হিসেবে ‘ব্র্যান্ড মোদী’-কে তুলে ধরার হাতিয়ার। উন্নয়নের সেই রোশনাইতে ধামাচাপা পড়ে গিয়েছিল গুজরাতের মহিলাদের স্বাস্থ্য বা শিশুদের অপুষ্টির করুণ চিত্র। হয়তো বা ২০০২-এর দাঙ্গার ক্ষতও।
এ বার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অর্থনীতির পরিচালনায় বা কোভিড মোকাবিলায় মোদীর ব্যর্থতাও কি নতুন করে সাজানো সেন্ট্রাল ভিস্টার জাঁকজমক দিয়ে আড়াল করার চেষ্টা হবে?
বাজি রেখে বলা যায়, তা-ই হবে। সেন্ট্রাল ভিস্টার বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ শেষ করার যে লক্ষ্য স্থির হয়েছে, তাতে এটা স্পষ্ট। নতুন সংসদ ভবন তৈরির লক্ষ্য ২০২২-এর জুলাই। দেশের স্বাধীনতার ৭৫তম বর্ষপূর্তি বা ‘অমৃত মহোৎসব’-এ নতুন সংসদ ভবনে অধিবেশন বসবে। আগামী ২৬ জানুয়ারির মধ্যে রাজপথের সৌন্দর্যায়নের কাজ শেষ করার লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে। অমৃত মহোৎসবে প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজ হবে মোদীর সাজানো রাজপথে। আর গোটা সেন্ট্রাল ভিস্টা প্রকল্প বা নয়াদিল্লির মুখটাই বদলে ফেলার লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে ২০২৪-এর মার্চের মধ্যে। লোকসভা ভোটের ঠিক প্রাক্কালে।
সোজা কথায়, আলটপকা নোট বাতিলের পর থেকে অর্থনীতির মন্দ দশা, বেকারত্বের হার ৪৫ বছরের রেকর্ড ছুঁয়ে ফেলা, কোভিড মোকাবিলায় ব্যর্থতা— এই সব কিছু ভুলিয়ে দিতে ২০২৪-এর লোকসভা ভোটের আগে নরেন্দ্র মোদী এক নতুন দিল্লি তুলে ধরবেন। তিনি বরাবরই এক ‘নতুন ভারত’-এর স্বপ্ন দেখান। সেটা ঠিক কী, তা স্পষ্ট হয় না। সেন্ট্রাল ভিস্টা-র মাস্টার প্ল্যান-এ স্পষ্ট, একেই নতুন ভারতের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরা হবে। তাতে বলা হয়েছে— সুশাসন, দক্ষতা, স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা ও সাম্যই ‘নতুন ভারত’-এর আকাঙ্ক্ষা। সেন্ট্রাল ভিস্টা তারই দৃষ্টান্ত। এর শিকড় গাঁথা থাকবে ভারতীয় সমাজ-সংস্কৃতিতে। এই কীর্তি অন্তত দেড়-দু’শো বছরের উত্তরাধিকার হিসেবে থেকে যাবে।
সুলতান বা মোগলদের নয়। ১৯১১-য় কলকাতা থেকে দিল্লিতে রাজধানী সরিয়ে আনা ব্রিটিশদের ‘লুটিয়ান্স দিল্লি’ নয়। নরেন্দ্র মোদীর দিল্লি। তাঁর ঐতিহ্য।
এখানেই শেষ নয়। নরেন্দ্র মোদীর রাজনৈতিক ভাবনাচিন্তা এত সহজ অঙ্ক মেনে চলে না। তিনি আসলে শুধুই বিজেপি নেতা নন। আদতে তিনি এক জন আরএসএস প্রচারক। আরএসএস কোনও দিনই শুধুমাত্র বিজেপিকে ভোটে জেতানোর লক্ষ্যে কাজ করে না। সঙ্ঘ পরিবারের মূল উদ্দেশ্য, তার হিন্দুত্ববাদের ধ্যানধারণা সমাজে ছড়িয়ে দেওয়া। একেবারে শিকড়বাকড় গেঁথে ফেলা।
এই গোঁড়া হিন্দুত্ববাদ দেশের যাবতীয় অ-হিন্দু ঐতিহ্যকে অস্বীকার করতে চায়। ইলাহাবাদের নাম তাই হয়ে যায় প্রয়াগরাজ। মুঘলসরাই হয়ে যায় দীনদয়াল। ফৈজাবাদ হারিয়ে যায় অযোধ্যার আড়ালে। আহমেদাবাদের গা থেকে মুসলিম গন্ধ মুছে ফেলতে তাই শহরের পুরসভা শহরের নামের বানান বদলে আমদাবাদ করেছিল। তা বদলে কর্ণাবতী নাম ফিরিয়ে আনার প্রস্তাবও ছিল। অযোধ্যার পরে কাশী-মথুরাতেও মসজিদ হটিয়ে মন্দির তৈরির দাবিটি তাই সঙ্ঘ পরিবারের পুরনো আহ্বান। নিশ্চিত ভাবে বলা যায়, ইউনেসকো-র কাছে হেরিটেজ সিটি-র তকমা পাওয়ার জন্য আবেদন প্রত্যাহারের পিছনে ব্রিটিশদের তৈরি ইমপেরিয়াল দিল্লি বা মোগলদের শাহজাহনাবাদ তুলে ধরতে অনিচ্ছাও অন্যতম কারণ ছিল। কারণ বিজেপি-আরএসএস এই মোগল-ব্রিটিশদের ঐতিহ্যই অস্বীকার করতে চায়।
২০২৪-এ নরেন্দ্র মোদীর সেন্ট্রাল ভিস্টা আত্মপ্রকাশ করবে। একই সঙ্গে আরএসএস-এর শতবর্ষের পথে যাত্রাও শুরু হবে। ২০২৫-এ আরএসএস শতবর্ষে পা দেবে। সেন্ট্রাল ভিস্টা তাই শুধুমাত্র নরেন্দ্র মোদীর ব্যক্তিগত উত্তরাধিকার নয়। খাস দিল্লির বুকে তাঁর রাজনীতির আঁতুড়ঘর আরএসএস-এর শতবর্ষের ঐতিহ্যও বটে।
রাজনীতির নশ্বর জীবনে ভোটে জেতা-হারা থাকবেই। তাতে অমরত্বের আকাঙ্ক্ষা মুছে যায় না।