—প্রতীকী ছবি।
অভিযোগ, গত কয়েক বছরে পশ্চিমবঙ্গ যেন দুর্নীতির আঁতুড়ঘরে পরিণত হয়েছে। তোলাবাজি, সিন্ডিকেট, নারদা, সারদা, গরু পাচার, কয়লা পাচার, শিক্ষাক্ষেত্রে নিয়োগ দুর্নীতি, রেশন দুর্নীতি— তালিকাটি দীর্ঘ। একই সময়ে সমাজে এত রকমের দুর্নীতি ঘটতে পারে নাকি? সমাজবিজ্ঞান বলে, অবশ্যই পারে। বস্তুত, সমাজে একই সঙ্গে বিবিধ রকমের দুর্নীতির মাথাচাড়া দিয়ে ওঠাটাই দস্তুর। তার কারণ দুর্নীতির প্রধান বৈশিষ্ট্যই হল, তা সেলফ-রিইনফোর্সিং বা স্বশক্তিবৃদ্ধিকারী। সোজা বাংলায় এর মানে হল সমাজে যত দুর্নীতি বাড়ে, দুর্নীতি ততই আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে আমাদের কাছে। এবং সেটা হয় বলেই আরও অনেকে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন, যার ফলে সমাজে দুর্নীতি আরও বেড়ে যায়। দুর্নীতির স্বশক্তিবৃদ্ধিকারী হওয়ার বিবিধ কারণ আছে। দুর্নীতির পাঁকে একটি সমাজ কী ভাবে ডুবে যায় সেটা বুঝতে গেলে, এই কারণগুলি বোঝাটা জরুরি।
দুর্নীতির স্বশক্তিবৃদ্ধিকারী হওয়ার প্রথম কারণ হল দুর্নীতি থেকে উৎসারিত অর্থ। দুর্নীতিতে যুক্ত যাঁরা, তাঁরা বিপুল অর্থের অধিকারী হয়ে ওঠেন। অর্থ দিয়ে সব কিছু কেনা না গেলেও, সরকার এবং প্রশাসনের একাংশকে যে কেনা যায়, সেটা না বললেও চলে। এর ফলে, দুর্নীতি দেখলেও, নেতা-মন্ত্রীদের নির্দেশে, প্রশাসনের চোখ বুজে থাকাটাই দস্তুর হয়ে ওঠে এবং দুর্নীতিবাজরা আরও বেশি দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ার সাহস এবং সুযোগ পান। আরও ফুলে ফেঁপে ওঠেন তাঁরা, সমাজে হুহু করে ছড়িয়ে পড়ে তাঁদের শাখা-প্রশাখা। এর ফলে আরও অর্থ হাতে আসে দুর্নীতিবাজদের। এবং সেই অর্থের একটি অংশ আবারও যায় সরকার এবং প্রশাসনের কাছে, প্রণামী হিসাবে। দুর্নীতির চক্র এ ভাবে চলতেই থাকে নিরন্তর। দুর্নীতিগ্রস্ত এবং দুর্নীতিবাজ শব্দ দুটোর মধ্যে একটা ফারাক আছে— যাঁরা ইতিমধ্যেই দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন, তাঁরা দুর্নীতিগ্রস্ত; যাঁরা জড়িয়েছেন অথবা এখনও জড়াননি, কিন্তু জড়াতে কোনও নৈতিক আপত্তি নেই, বরং আসক্তি আছে, তাঁদের বলতে পারি দুর্নীতিবাজ।
ইংরেজিতে একটি বহু ব্যবহৃত কথা আছে ‘পার্টনার্স ইন ক্রাইম’। সমস্ত রকমের ক্রাইম ঘটানোর জন্য ‘পার্টনার্স’ প্রয়োজন না হলেও, দুর্নীতির জন্য ‘পার্টনার্স’— বলা ভাল ‘নেটওয়ার্ক’— থাকাটা বাধ্যতামূলক প্রায়। শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতিতে অভিযুক্ত বলে যাঁরা এখন জেলের ভিতরে দিন গুজরান করছেন, তাঁদের নেটওয়ার্কের কথা ভাবুন— প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী থেকে শুরু করে স্কুল সার্ভিস কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান, স্কুল সার্ভিস কমিশনের উপদেষ্টা, শাসক দলের বিধায়ক, শাসক দলের নেতা, যুবনেতা, কেউ বাদ নেই! দুর্নীতি সমাজে বাড়লে এই পার্টনার্স বা সহযোগী পাওয়াটা ভীষণ সহজ হয়ে পড়ে। তাই সমস্যা হয় না নেটওয়ার্ক তৈরি করা। নেটওয়ার্ক যত শক্তিশালী হয়, সমাজ আরও বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থা কেবল দুর্নীতিবাজদেরই আকর্ষণ করে। যাঁরা স্বভাবত দুর্নীতিবাজ নন, তাঁরা দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থার অঙ্গ হতে চান না উপায় থাকলে। ধরুন যদি এটা মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত সত্য হয় যে, সরকারি স্কুলের চাকরি মোটা টাকা দিয়ে ‘কিনতে’ হয়, তা হলে যাঁরা স্বভাবত দুর্নীতবাজ, তাঁরাই কেবল সরকারি স্কুলে শিক্ষক হওয়ার কথা ভাববেন। যাঁরা সেটা করতে প্রস্তুত নন— অর্থাৎ যাঁরা দুর্নীতিবাজ নন— তাঁদের বেশির ভাগই সরকারি স্কুলে চাকরি করার কথা ভাববেন না, অন্তত যদি অন্য কোনও চাকরি পাওয়ার উপায় থাকে। অথবা, সৎ পথে চাকরির (ব্যর্থ) চেষ্টা করবেন। ফলে সরকারি স্কুলে শিক্ষক হিসাবে যাঁদের নিয়োগ হবে, তাঁদের সিংহভাগই দুর্নীতিবাজ। বস্তুত, আমাদের দেশে বেশির ভাগ রাজনীতিবিদই দুর্নীতিগ্রস্ত হওয়ার কারণও কিন্তু দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থার দুর্নীতিবাজদের আকর্ষণ করার ক্ষমতা। যাঁরা সৎ, আদর্শবান, তাঁরা রাজনীতির পাঁক যেচে গায়ে মাখতে চান না। তাই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার কথা তাঁরা ভাবেনও না। দুর্নীতিতে যাঁদের আপত্তি নেই, বরং আসক্তি আছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাঁরাই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন, হয়ে ওঠেন নেতা-মন্ত্রী। দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থায় এই দুর্নীতিবাজদের স্বনির্বাচন— দুর্নীতির স্বশক্তিবৃদ্ধিকারী হয়ে ওঠার আর একটি বড় কারণ।
দুর্নীতিতে যুক্ত হয়ে পড়ার একটা লজ্জা আছে যা অনেক সময় দুর্নীতির নিয়ন্ত্রক হিসাবে কাজ করে। কিন্তু দুর্নীতি সমাজে যত মান্যতা পেতে থাকে, দুর্নীতিতে যুক্ত হওয়ার লজ্জাও ততই কমে যায়। এর ফলে, স্বাভাবিক ভাবেই, দুর্নীতি আরও বেড়ে যায়। সরকারি স্কুলের কোনও মাস্টারমশাইয়ের কথা ভাবুন। আইন অনুযায়ী, তিনি অর্থ নিয়ে টিউশনি করতে পারেন না। কিন্তু মাস্টারমশাইয়ের সেই বন্দোবস্ত না-পসন্দ— তিনি স্কুলের পর টিউশনি করে রোজগার বাড়াতে চান। যদি তাঁর সহকর্মীদের মধ্যে কেউ টিউশনি না করেন, তা হলে এই মাস্টারমশাইয়ের পক্ষেও টিউশনি করাটা সমস্যার, কারণ ‘যদি জানাজানি হয়ে যায়, লোকে কী ভাববে’! কিন্তু তাঁর সহকর্মীদের মধ্যে অনেকেই যদি টিউশনি করেন, তা হলে টিউশনি করাটা তাঁর পক্ষে খুবই সোজা হয়ে যায়, কারণ ‘সবাই তো প্রাইভেটে ছাত্র পড়াচ্ছে’! দুর্নীতি, অতএব, লজ্জার মূল্য কমিয়ে দিয়ে আরও দুর্নীতি তৈরি করতে সাহায্য করে।
লজ্জার মতো অপরাধবোধ এবং কলঙ্কের ভয়ও সমাজে দুর্নীতির নিয়ন্ত্রক। আমার যদি মনে হয় দুর্নীতি জড়িয়ে পড়লে গভীর অপরাধবোধে ভুগব কিংবা কলঙ্কের ভয়ে সারা ক্ষণ কাঁটা হয়ে থাকব, তা হলে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ার আগে বহু বার ভাবব আমি। কিন্তু সমাজে দুর্নীতির বাড়বাড়ন্ত আমাদের অপরাধবোধ এবং কলঙ্কের ভয় কমায়। কারণ, আমাদের অপরাধবোধ এবং কলঙ্কের ভয় নির্ভর করে আমাদের আচরণ আর সমাজ যাকে আদর্শ আচরণ মনে করে, এই দুইয়ের মধ্যে ফারাক কতটা, তার উপরে। সমাজে কেউ যদি দুর্নীতিতে যুক্ত না থাকে, তা হলে দুর্নীতি না জড়ানোটাই আমার পক্ষে আদর্শ। কারণ সে ক্ষেত্রে, আমি সামান্য দুর্নীতিতে যুক্ত হলেই অপরাধবোধে ভুগব, কলঙ্কের ভয় হবে আমার। কিন্তু সমাজে যদি সবাই দুর্নীতিতে যুক্ত হয়, তা হলে দুর্নীতিটাই ‘আদর্শ আচরণ’ হিসাবে বিবেচিত হবে। সে ক্ষেত্রে আমি দুর্নীতিতে যুক্ত হয়ে পড়লেও সমাজ যাকে আদর্শ আচরণ হিসাবে বিবেচনা করে, তার সঙ্গে আমার আচরণের পার্থক্য তৈরি হবে না— আমার অপরাধবোধও হবে না, কলঙ্কের ভয়ও থাকবে না। দুর্নীতিতে যুক্ত হয়ে পড়ার জন্য যে ‘মানসিক জরিমানা’, তার অঙ্কটা কমে যাবে। দুর্নীতি, অতএব, অপরাধবোধ এবং কলঙ্কের ভয় কমিয়ে দিয়ে, আরও বেশি দুর্নীতির জায়গা করে দেয়।
দুর্নীতি লাগামছাড়া হয়ে পড়লে সমাজ নিমেষে পৌঁছে দিতে পারে এমন একটি মন্দ সাম্যাবস্থায়, যেখানে দুর্নীতিই ‘স্বাভাবিক’ হয়ে ওঠে। এই সাম্যাবস্থায় বেঁচেবর্তে থাকার জন্য দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়াটাই মানুষের পক্ষে হয়ে ওঠে যুক্তিযুক্ত। এক বার এই সাম্যাবস্থায় পৌঁছে গেলে সেখান থেকে বেরিয়ে আসাটা সহজ নয়। এবং সেখান থেকে বেরোতে না পারলে, সমাজব্যবস্থা এবং অর্থনীতির অতলে তলিয়ে যাওয়াটাও নেহাতই সময়ের অপেক্ষা। পশ্চিমবঙ্গ যে সে পথে অনেকটা অগ্রসর হয়নি, বুক ঠুকে সেটা আজ আর বলার উপায় নেই।
এর থেকে পরিত্রাণের উপায় কি, জানা নেই। তবে, যেটা জানা আছে তা হল, সরকারের অন্দরে যে বিপুল দুর্নীতি হয়েছে সেটা ক্রমাগত অস্বীকার করলে, তাকে ‘ইন্ডিভিজুয়াল ম্যাটার’ বা ‘কেন্দ্রের চক্রান্ত’ বলে আখ্যা দিলে, কিংবা ‘উন্নয়ন চাইলে একটু দুর্নীতি সহ্য করতেই হবে’ গোছের কথা বলে দুর্নীতির পক্ষে (কু)যুক্তি খাড়া করলে, এই পরিস্থিতি থেকে বেরোনো যাবে না কোনও দিন। দুর্ভাগ্যবশত, ঠিক এগুলিই করে চলেছেন রাজ্যের বর্তমান শাসক দল এবং বিদ্বজ্জনদের একাংশ। রোগটা যে হয়েছে, সেটা যদি স্বীকারই করতে না চাই, তা হলে রোগের চিকিৎসা তো শুরুই হবে না কোনও দিন!