কাজী নজরুল ইসলাম। —ফাইল চিত্র।
সুরকার এ আর রহমান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন কাজী নজরুল ইসলামের ‘কারার ঐ লৌহকপাট’ গানটি নিয়ে, এবং তা নিয়ে বিস্তর গোলযোগ। আপাত ভাবে, গোলযোগ কারণহীন। নিরীক্ষাজাত পরিবর্তন বা ‘অ্যাডাপ্টেশন’ তো হয়েই থাকে। আগেও তিনি ‘বন্দে মাতরম্’-এর মতো ধ্বনি-ভাবনা গেঁথেছেন নিজের সুরে। সে-গান বহু কালের চেনা সুরকাঠামো ভুলিয়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে পরিবেশিত হয়ে চলেছে। তা কি আদৃত হওয়ার ক্ষমতা নয়?
মনে হতেই পারে, যদি নদীর গতিপথের আপন স্বরলিপি বদলে দিতে পারি আমরা, তবে একই কাজ নজরুলের গানে করতে পারব না কেন? সে তো ‘অ্যাডাপ্টেশন’ই। পরমপ্রকৃতি ভেবেচিন্তে পৃথিবী বানিয়েছেন, বেশ করেছেন। কিন্তু তা বলে জঙ্গল কেটে আমরাও ‘ভেবেচিন্তে’ জনপদ বানাতে পারব না? তেমনই রহমান যদি নজরুলের ভেবেচিন্তে বানানো চিরহরিৎ অরণ্য সাফ করে আপন মনের মাধুরীটুকু দেখাতে চান, সমস্যা কোথায়?
রহমান ‘বন্দে মাতরম্’ নতুন ভাবে চিনিয়েছেন ‘মা তুঝে সালাম’ বেঁধে। তবে সেখানে বঙ্কিম-বয়ানের সামান্যই ব্যবহার করেছেন এবং তাঁর আগে ওই একই কাব্য-বয়ানে প্রচুর কিসিমের সুরও হয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্র ছাড়াও এ-গানের সঙ্গে জড়িয়ে যদুভট্ট, রবীন্দ্রনাথের নাম। পরে আরও-আরও অনেক। যদিও সে-সবই ভুলিয়ে ছেড়েছে রহমানের চিৎকৃত ‘বন্দে মাতরম্’। অর্থাৎ, ‘অ্যাডাপ্টেশন’।
‘অ্যাডাপ্টেশন’ যুগে-যুগে যেমন শৈলীর মেলবন্ধন ঘটিয়েছে, তেমনই ‘শ্লীলতাহানি’র স্তরেও ‘উন্নীত’ হয়েছে। দু’টিরই নজির রয়েছে চিত্রকলা, সঙ্গীত, নৃত্য, নাট্য আর চলচ্চিত্রে। হিন্দি ছবিতে রবীন্দ্রসুরের সরাসরি-প্রভাবিত-অনুসারী প্রয়োগ তুমুল হয়েছে। তার কিছু দারুণ সফল, কিছু রক্তাপ্লুতও। সময় বলে দিয়েছে, কে থাকবে, কে থাকবে না। এবং ‘কে থাকবে’ বিষয়টিও আপেক্ষিক। আজ যা রইল, কাল না-থাকতেও পারে। নেই যা আজ, সে খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তনও অসম্ভব নয়।
লতা মঙ্গেশকরকে নির্ভুল উচ্চারণে বাংলা গান পেশ করানোয় অসুবিধা হয়নি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরীদের। অমোল পালেকরের সমস্যা হয়নি সংলাপের জঠরে বিজড়িত ভিন ভাষার অমরা হৃদয়ঙ্গম করতে। কিন্তু রহমানের বাংলা গানে বাঙালি গায়কেরা কী গাইছেন, কেন গাইছেন, অর্থ কী দাঁড়াচ্ছে, বুঝেও উঠতে পারলেন না! গানের মাঝে তেল-ছিটকে-ওঠা ‘ও-ও-ও-ও-ও’ অংশটি কোন ঘটের কাঁটালি কলা? জোধা আকবর ছবিতে ‘খাজা মেরে খাজা’ বাঁধার সময় রহমানে সুফিগানের যে নিবিড় গবেষককে দেখা গিয়েছিল, নজরুলের গান নিয়ে কাজ করার সময়ও তেমন অন্বেষণই তো কাঙ্ক্ষিত ছিল! প্রশ্ন জাগে, আদৌ কাজটি রহমান নিজে করেছেন তো?
নজরুলের শতাব্দী-অতিক্রান্ত ঐতিহাসিক কবিতা-গীতিটি নিয়ে কাজ করার সময় দলের কেউ কেন ইতিহাস ঘেঁটে দেখলেন না? কেন ভুলে গেলেন অবিভক্ত ভারতের স্বরাজসাধনা আর বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে এ-গানের অবদানের কথা? ছবির নির্মাতারাও দায় এড়াতে পারেন না। দায় এড়াতে পারেন না এ-গানে কণ্ঠ দেওয়া বাঙালি শিল্পীরাও। নজরুলের গান রবীন্দ্রনাথের গানের মতো বিজ্ঞানসম্মত ভাবে রক্ষিত না হলেও স্বরলিপি নেই, তা তো নয়। সুর বদলানো হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ‘কপিরাইট’ বা আইনি ব্যবস্থা নিয়ে কিছু না বলাই ভাল। সরকারি-বেসরকারি সব স্তরেই নজরুল সম্মানের চিরনির্বাসনে থাকতে অভ্যস্ত! কাজেই, বিতর্কের হুজুগ অচিরে কেটে যাবে আর সুরকারও নতুন কাজে মনোনিবেশ করবেন।
নজরুলকে দূরে রেখে যদি গানটির নবনির্মিতি নিয়ে ভাবতে হয়, তা হলে কাজটিকে অপরিসীম ব্যর্থতা বলেই মনে হয়। সোজা কথা, কিছু হয়নি! আর এখানেই ভাবার, হয়ে উঠল না কেন?
সাংস্কৃতিক বৈচিত্রের মধ্যে আদানপ্রদান কাঙ্ক্ষিতই, কিন্তু সংস্কৃতির জিন-কাঠামো বদলে দিয়ে নয়। তা ঘটলে আমসত্ত্ব তৈরি হলেও আমের স্বত্বটির সর্বনাশ ঘটে। রহমানের এ-গানের ক্ষেত্রে সেটাই ঘটেছে। প্রযুক্তি-পারঙ্গম সুরকার সংস্কৃতি-বৈচিত্রের মাধুরী-সন্ধানে সদা-সফল বলে মনেও হয় না। তাই তাঁর দক্ষিণী ছবির গানে যে সুর সাবলীলতার সাম্পান, কিছু ক্ষেত্রে সেই একই সুর হিন্দি ছবিতে হিন্দি ভাষার ভেলায় কাঠকাঠ! কারণ, আমগাছের ছাল জামগাছে লাগানো। সুর এক হলেও গান এক থাকছে না। গীতি অর্থে গান শুধু সুর নয়, কথা-সুরের গার্হস্থ। সমান জরুরি গান-পঙ্ক্তির উচ্চারণকালও। তা ভাষায়-ভাষায় আলাদা। রবীন্দ্রনাথের কোনও গানের হিন্দি বা ইংরেজি তর্জমা করে একই সুরে গাওয়ার চেষ্টা করুন। করুণ অভিজ্ঞতা হবে! কারণ, ছন্দ প্রকৃতিজাত উচ্চারণ-যন্ত্রের শস্য। ইংরেজি ‘টোন’-নির্ভর পতন, উত্থান, উত্থান-পতন স্বর-সঞ্চালন বাংলার নয়। ছন্দের চলনও আলাদা। একই ভাবে উপমহাদেশের নানা ভাষার ছন্দ-প্রকরণ অনেকাংশে আলাদা। তাই সহজ নয় অন্য ভাষার ছন্দোবদ্ধ পঙ্ক্তির উচ্চারণের তালে তাল মেলানো। রহমানের এই বিনির্মাণ-কাজে উচ্চারণকাল গুরুত্ব না পাওয়ায় সম্পূর্ণ নষ্ট হয়েছে কাব্য। এই কারণেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানে ‘স্টিমরোলার’ চালানো নিয়ে আতঙ্কিত ছিলেন।
‘অ্যাডাপ্টেশন’ এমন সর্বনাশ করলে তাতে কিসের প্রয়োজন! নজরুল বরং আমারই থাকুন, বাঙালিরই থাকুন! অক্ষত থাক নির্জন দ্বীপ টিয়া-রং!