রাজনীতির নিজস্ব ভাষা ও ভঙ্গি নির্মাণের সুযোগ
Rahul Gandhi

রাহুল গান্ধীর দায়িত্ব

জনাকয়েক অবশ্য তুলনায় ঈষৎ হিসাবি এবং চতুর। তাঁরা নাসিকাগ্রটি সামান্য উঁচুতে তুলে গুরুদেব বা বাবাজিদের ঢঙে সুগম্ভীর নীতিবাক্য শুনিয়েছেন।

Advertisement

অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৮ অগস্ট ২০২৩ ০৫:২৬
Share:

রাহুল গান্ধী। —ফাইল চিত্র।

মানহানির মামলায় রাহুল গান্ধীর উপর গুজরাতের আদালতের দণ্ডাদেশ সুপ্রিম কোর্ট স্থগিত করে দেওয়ায় বিজেপির রথী মহারথী এবং তাঁদের বড় মেজো খুচরো অনুগামীরা যে বেশ ঝঞ্ঝাটে পড়েছেন, সম্পূর্ণ নির্বোধ অথবা আকাঁড়া ভক্তজন ছাড়া সেটা বুঝে নিতে কারও অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। একে তো সামনে অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে সংসদীয় বিতর্কসভা। অনুমান করা যায়, সেই সভার জবাবি ভাষণে আসর মাত করে শেষ হাসি হাসবেন বলে প্রধানমন্ত্রী জোরদার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এমন মাহেন্দ্রক্ষণে ‘বিজয়ী’ রাহুল গান্ধী সংসদে ফিরে এসে পাদপ্রদীপের আলোয় বড় রকমের ভাগ বসাবেন যে! আবার, সেই বিপদ ঠেকাতে যদি তাঁর ফেরার পথে কাঁটা বিছিয়ে দেওয়ার বন্দোবস্ত হত, তা হলেও লোকজন ছ্যা-ছ্যা করত— কেবল অহঙ্কারী বিরোধীরা কিংবা আন্দোলনজীবী আর্বান নকশালরা নয়, তার বাইরেও অনেকেই বেসুর গাইছে আজকাল। অতএব, উপস্থিত রাহুল গান্ধীর থেকে অনুপস্থিত রাহুল গান্ধীর ছায়া সংসদে দীর্ঘতর হতে পারত।

Advertisement

এহ বাহ্য, আগে কহ আর। অনাস্থা প্রস্তাবের শোরগোল তো দু’দিনে মিটে যাবে, কিন্তু ও-দিকে লোকসভা নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে। এই মরসুমেই রাহুল গান্ধীর ক্রমবর্ধমান গুরুত্বে নতুন মাত্রাটি যুক্ত হতে হল? বিরোধী জোটের অন্য নেতা-নেত্রীরা যাতে এই গুরুত্ব নিয়ে মুখ ভার করেন, সে জন্য অবশ্যই রকমারি গূঢ় মন্ত্রণাদি চালাতে হবে, কিন্তু তাতে কতটা কাজ হবে বলা শক্ত— ‘ইন্ডিয়া’-র ব্যাপারটা যেন ক্রমে ক্রমে দানা বাঁধছে, তার মহড়া নিতে প্রধানমন্ত্রী বা তস্য শব্দ-জোগাড়েদের খুঁজেপেতে অহঙ্কারী-র প্রতিশব্দ ‘ঘমণ্ডী(য়া)’ নামাতে হচ্ছে। সবচেয়ে বড় চিন্তা, কী নিয়ে লড়াই, সেটা শাসকরা আর ষোলো আনা ঠিক করে দিতে পারছেন না, আপন মন কি বাত সরিয়ে রেখে বিরোধীদের প্রশ্নের জবাব শাণাতে হচ্ছে। সত্যিই, আগের মতো সুখ নাই।

এই অসুখ আর অশান্তির তাড়নাতেই বোধ করি শাসক শিবির থেকে তড়িঘড়ি রকমারি প্রত্যাঘাত ছুটে এসেছে, যুগপৎ তৎপর হয়েছে মুখপাত্রমণ্ডলী এবং ট্রোলবাহিনীর সম্প্রচারযন্ত্র। প্রচারের একটা বড় অংশ, যথারীতি, কুৎসিত গালিগালাজ, সুতরাং ধর্তব্য নয়। তবে এরই মধ্যে ইতস্তত কিঞ্চিৎ কৌতুকের স্বাদও মেলে বইকি। যেমন, কে যেন মন্তব্য করেছেন, রাহুল গান্ধী তো খিড়কি দিয়ে সংসদে ফিরছেন! দেখে মায়াই হল— কোনটা সদর কোনটা খিড়কি, সেই হিসাবটুকুও গুলিয়ে গেছে! আর এক দলের বয়ানে আবার প্রচ্ছন্ন হুমকি: ঠিক আছে, এটায় নাহয় ছাড় মিলল, মামলা তো আরও অনেক আছে। এই হুমকি শূন্যগর্ভ নয়— মামলা নামক খেলার প্রতিভায় বর্তমান ভারত এবং তার কোনও কোনও রাজ্যের ক্ষমতাবানেরা অলিম্পিক পদক আনতে পারেন।

Advertisement

জনাকয়েক অবশ্য তুলনায় ঈষৎ হিসাবি এবং চতুর। তাঁরা নাসিকাগ্রটি সামান্য উঁচুতে তুলে গুরুদেব বা বাবাজিদের ঢঙে সুগম্ভীর নীতিবাক্য শুনিয়েছেন। বাণী দিয়েছেন যে, “সুপ্রিম কোর্টের মন্তব্যও খেয়াল করা দরকার; আদালত বলেছে— রাহুল গান্ধীর (সংশ্লিষ্ট) উক্তিটি সুরুচির পরিচয় দেয় না; জনজীবনে যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় থাকেন তাঁদের সংযত ও সতর্ক থাকা উচিত।” অর্থাৎ, অসংযত এবং অসতর্ক আচরণের জন্য সর্বোচ্চ আদালত যে তাঁর সমালোচনা করেছে, সেটাও যেন রাহুল গান্ধী ভুলে না যান।

প্রশ্ন উঠতেই পারে, বিজেপির লোকেরা উচিত-অনুচিত শেখানোর কে? যে শাসক শিবিরে আপাদমস্তক অসংযম এবং কুরুচির সংক্রমণ, যার সমস্ত মহল থেকে বছরের পর বছর প্রতিপক্ষকে নিশানা করে অবিরত ভয়ঙ্কর কটূক্তির ধারাবর্ষণ চলে আসছে, তারা কোন মুখে সংযম, রুচি, দায়িত্ববোধের কথা বলে? এ-প্রশ্ন অসঙ্গত নয়। রাজনীতির ভাষায় অসংযম এবং কুরুচির ব্যাধি এ দেশে নতুন নয়, কিন্তু গত এক দশকে তা যে সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে সেটা নিঃসন্দেহে অভূতপূর্ব। এই পরিণতির বিপুলতম দায়ভাগ কাদের? রাহুল গান্ধীকে সহবত শেখানোর জন্য উচ্চারিত আদালতের কথাগুলি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে তাঁর সহকর্মী, সতীর্থ এবং অনুগামীরা যে যার নিজের গায়ে ফেলে যাচাই করে দেখলেই উত্তর পেয়ে যাবেন। তবে কিনা, তেমন কোনও আত্মপরীক্ষার তিলমাত্র সম্ভাবনা নেই, সম্ভাবনা নেই সংযত ও সতর্ক হওয়ারও। ভোট নামক মহাযুদ্ধ যত এগিয়ে আসবে, অসংযমের মাত্রা উত্তরোত্তর চড়তে থাকবে, এই মহা-আশঙ্কাতেই আপাতত ভারতবাসী দিন গুনছেন।

এবং সেই কারণেই, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা রাহুল গান্ধীর উক্তিতে অসতর্কতা ও অসংযমের যে সমালোচনা করেছেন সেটি মনে রাখা তাঁর অত্যন্ত জরুরি কর্তব্য। শাসক শিবির থেকে কে বা কারা তাঁর প্রতি কত রকমের কটূক্তি, ব্যঙ্গ বা উপদেশ নিক্ষেপ করছেন তা নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই, রাহুল গান্ধীর প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব নিজের কাছে। সর্বোচ্চ আদালত থেকে স্থগিতাদেশ ঘোষিত হওয়ার পরে তিনি জানিয়েছেন, তাঁর কর্তব্য কী সে বিষয়ে তাঁর নিজের ধারণা পরিষ্কার। কথাটিতে এবং তার উচ্চারণের ভঙ্গিতে যে আত্মপ্রত্যয়ের সুর সুস্পষ্ট, তা আকাশ থেকে পড়েনি, কংগ্রেসের ভূতপূর্ব সভাপতি সাম্প্রতিক কালে, বিশেষত তাঁর ভারত জোড়ো যাত্রার মধ্য দিয়ে স্পষ্টতই নিজের সঙ্গে অনেকখানি বোঝাপড়া করেছেন, নিজেকে নতুন করে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। তাঁর এই ‘প্রত্যাবর্তন’ নির্বাচনী রাজনীতির তহবিলে কত দূর ফলপ্রসূ হবে, তার উত্তর ভবিষ্যৎ বলবে, কিন্তু এই ফিরে-আসা রাজনীতিককে যে আর ‘পাপ্পু’ বলে উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব নয়, সেই সত্য প্রধানমন্ত্রীর নির্বোধতম ভক্তরাও টের পেয়ে গিয়েছেন।

এখানেই রাহুল গান্ধীর সুযোগ। রাজনীতির নিজস্ব ভাষা ও ভঙ্গি তৈরি করার সুযোগ। সেই নবনির্মাণের প্রথম শর্ত সংযম, যে সংযমের কথা সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা বলেছেন। বর্তমান ভারতীয় রাজনীতির পরিসরে সেই শর্ত পূরণ খুব সহজ কাজ নয়, বিশেষত রাহুল গান্ধীর পক্ষে। তাঁর প্রতিপক্ষ অতীতেও তাঁর বিরুদ্ধে লাগাতার রকমারি বাউন্সার দিয়ে এসেছে, ভবিষ্যতেও তার ব্যতিক্রম হওয়ার কোনও প্রত্যাশা তাঁর থাকার কথা নয়। বস্তুত, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এই মরসুমে বডিলাইন বোলিং দেখলেও বিস্ময়ের কিছু থাকবে না, তেমন আক্রমণ শাণানোর ক্ষমতাধারী বিস্তর প্রতিভা তো শাসক শিবিরে মজুত আছেই। সুতরাং সংযম হারানোর প্রভূত প্ররোচনা থাকবে, এমনটা ধরে নেওয়াই ভাল। প্ররোচনায় সাড়া না দিয়ে নিজের কাজ করে চলাই পরিণত মানসিকতার দায়িত্ব। যে ধরনের মন্তব্যের কারণে তিনি বিপাকে পড়েছেন, আদালতে কার্যত তিরস্কৃত হয়েছেন, সেগুলি মানসিক অপরিণতির লক্ষণ ছাড়া আর কিছুই নয়। অত্যন্ত সুস্থিত ভাষায় যে কঠোর সমালোচনা করা যায়, সুতীব্র প্রতিবাদ শাণানো যায়, সংসদে এবং সংসদের বাইরে তিনি নিজেই অনেক বার সেটা প্রমাণ করেছেন। তাঁর স্বাভাবিক ভাষা ও বাগ্‌ভঙ্গিতে অসংযত, ছাতি-চাপড়ানো উগ্রতার ব্যাধি, নেশা বা অভিনয়রীতি কখনওই দেখা যায়নি। এমনকি, জনসভায় বক্তৃতা থামিয়ে তিনি আপন সমর্থকদের স্বাভাবিক, স্বতঃস্ফূর্ত এবং সুস্পষ্ট ভাষায় বলতে পারেন: কারও নামে মুর্দাবাদ দেবেন না। কিন্তু ব্যঙ্গ বা বক্রোক্তির ছলে মাঝে-মধ্যেই রাহুল গান্ধী এমন উক্তি করে থাকেন, যা রুচিসম্মত নয়, আত্মমর্যাদার অনুকূলও নয়। এখানেই আত্মশুদ্ধির প্রয়োজন।

প্রয়োজন, কোনও ব্যক্তিগত নৈতিকতার দাবিতে নয়, রাজনৈতিক অনুশীলনের নিজস্ব স্বার্থেই। জনপরিসরের রাজনীতিতে, বিশেষত নির্বাচনী প্রস্তুতি ও প্রচারের সর্বব্যাপী রণভূমিতে যে ভয়ঙ্কর ভাষা ও আচরণের দাপট উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে, তার ‘যুক্তি’ হিসাবে এই ধারণা বহুলপ্রচলিত যে, লোকে এই উগ্রতাই পছন্দ করে। সাদা বাংলায় একেই বলে শেয়ালের যুক্তি। লোকের পছন্দ বা রুচি বলতে আমরা যা বুঝি ও বোঝাতে চাই, তা আসলে সমাজ ও রাজনীতির নিরন্তর টানাপড়েনের ফল, রাজনীতিকরা যে টানাপড়েনের ক্ষমতাবান শরিক। তাঁদের আচরণও ওই টানাপড়েনের মধ্যে দিয়েই বিবর্তিত হয়। রাহুল গান্ধী ব্যক্তিগত ভাবে কতটা সফল হবেন বা হবেন না, সেটা নিতান্তই গৌণ প্রশ্ন। মুখ্য প্রশ্ন হল, এই উগ্র, আস্ফালনসর্বস্ব, ঘমণ্ডী রাজনীতির পরিসরে তিনি সংযত এবং দায়িত্বশীল একটা রাজনীতির ভাষাভঙ্গির সার্থক অনুশীলন করতে পারবেন কি না।

যদি পারেন, তবে ইতিহাস তাঁকে শ্রদ্ধা করবে। আইনসভার সব ক’টি আসন দখল করে দেশ বা রাজ্যকে বিরোধী-মুক্ত করেও দুনিয়ার একেশ্বর বা একেশ্বরীরা কোনও দিন যে শ্রদ্ধার নাগাল পাননি, পাবেনও না।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement