হত্যাকাহিনি: নিজ্জর-হত্যার ক’দিন আগে কানাডায় ভারতীয় কনসুলেটের সামনে খলিস্তানপন্থীদের বিক্ষোভ, ভ্যাঙ্কুভার, ২৫ সেপ্টেম্বর। রয়টার্স।
আমেরিকা ও অন্যান্য পাশ্চাত্য দেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক এখন ঠিক কোন পর্যায়ভুক্ত? তা কি সত্যই উচ্চ পর্যায়ের, যা লক্ষ করা গিয়েছিন ২০০৫ সালে, যখন তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ ও আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জর্জ উইলিয়াম বুশ শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক শক্তিতে সহযোগিতার জন্য এক যৌথ বিবৃতির অংশীদার হন? না কি তা এক মাঝারি পর্যায়ের, যেমন অটলবিহারী বাজপেয়ীর আমলে ঘটেছিল? অথবা চূড়ান্ত খারাপ, যেমন ইন্দিরা গান্ধীর কালে হয়েছিল?
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী পশ্চিমে তাঁর ভাবমূর্তিকে সর্বদা প্রাধান্য দিয়েছেন। পশ্চিম তাঁকে চেনে হিন্দু জাতীয়তাবাদী নেতা হিসাবেই। সেখানকার মিডিয়ায় অসংখ্য প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে ভারতীয় জনতা পার্টি-শাসিত মোদীর ভারতে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও সমালোচনার কণ্ঠরোধ করার বিভিন্ন ঘটনার বিবরণ দিয়ে। তবু পশ্চিমের চোখে, বিশেষ করে আমেরিকার চোখে, মোদী হয়ে উঠেছিলেন ‘উঠতি’ বিশ্বশক্তি চিনকে ঠেকানোর একমাত্র বেড়া। ভারতকে ভাবা হত এক মূল্যবান সম্পদ, বিশেষ করে ইন্দো-প্যাসিফিক সমুদ্রাঞ্চলে। তাই নিজের দলের বহু সাংসদের মোদী সম্পর্কে সতর্কবাণী গ্রাহ্য না করেই আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তাঁকে সাদর অভ্যর্থনা দিয়েছিলেন হোয়াইট হাউসে, গত বছর জুন মাসে। সাউথ লনে সাজানো অভ্যাগতদের টেবিলে ছিল একটি করে প্রস্ফুটিত পদ্ম, অতিথির দলের চিহ্ন। ভোজসভার নিরামিষ আহারে বিশেষ স্বাদ সৃষ্টি করতে ক্যালিফোর্নিয়া থেকে উড়িয়ে আনা হয়েছিল এক প্রসিদ্ধ ‘শেফ’কে। কিন্তু যখন বারান্দা থেকে অভ্যাগতদের দিকে হাত নাড়ছিলেন মোদী, এক পাশে গৃহস্বামী বাইডেন অন্য পাশে ফার্স্ট লেডি জিল, তার কয়েক দিনের মধ্যেই এমন কিছু ঘটনা ঘটবে যা বহুকাল ধরে পশ্চিমের চোখে ভারত সম্পর্কে ধারণা কালিমালিপ্ত করে দেবে, জানা ছিল না তখন।
সেই ঘটনার সূত্রপাত কানাডায়, যার পশ্চিমাঞ্চলের প্রদেশ ব্রিটিশ কলম্বিয়ায়— যার রাজধানী ভ্যাঙ্কুভারে অসংখ্য শিখের বাস। তাঁদের একাংশ খলিস্তান আন্দোলনের সমর্থক, যাঁদের দাবি শিখদের জন্য ভারতের পঞ্জাবকে পরিণত করতে হবে এক সার্বভৌম রাষ্ট্রে। ভারতের পক্ষে তা এক বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন, কিন্তু পাশ্চাত্য ‘আইনের শাসন’-এর ধারণা অনুযায়ী তা একান্তই মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, অবশ্যই যতক্ষণ তা সহিংস না হচ্ছে বা অপরের স্বাধীনতাকে বিঘ্নিত না করছে। সেই কারণে কানাডায়, বা ব্রিটেন ও আমেরিকায়, যখন খলিস্তানের দাবিতে শিখেরা সরব হন ভারতীয় দূতাবাসের সম্মুখে— তখন দূতাবাসকর্মীদের করণীয় কিছুই থাকে না।
ফলে এটি একটি সমস্যা হয়ে উঠেছিল। এবং এই সমস্যা সমধানের জন্য যা প্রয়োজন ছিল, তা হল কূটনৈতিক স্তরে বলিষ্ঠ প্রয়াস। তাতে কাজ হয়নি। ফলে তার বিকল্প হিসাবে ভাবা হল হিংসার কথা। অথচ হিংসা, বিশেষ করে বিদেশের মাটিতে— অতীব সমস্যাজনক। ওই মারাত্মক বিকল্পটিই বেছে নিয়েছে ভারত বলে অভিযোগ উঠল। এমনও শোনা গেল, খলিস্তানি প্রতিবাদ ঠান্ডা করতে ছকা হয়েছিল খুনের প্ল্যান। তার একটি লক্ষ্য ভ্যাঙ্কুভারের শহরতলি সারে-র গুরু নানক গুরুদ্বারের পরিচালক, কট্টর খলিস্থানপন্থী, হরদীপ সিংহ নিজ্জর। ১৮ জুন দুপুরে যখন নিজ্জর গুরুদ্বার থেকে ঘরে ফিরছিলেন, তখন মুখোশ-পরিহিত আততায়ীরা তাঁকে চালকের সিটের উপরেই গুলি চালিয়ে ঝাঁঝরা করে দেয়।
এটি প্রধানমন্ত্রী মোদীর হোয়াইট হাউস অভ্যর্থনার ঠিক চার দিন আগেকার ঘটনা। এবং ২২ জুন যখন ওয়াশিংটনে চলছে মোদীর সংবর্ধনা, তখন, আদালতে দাখিল করা গোয়েন্দা বয়ান অনুযায়ী— ভারতের গোয়েন্দা দফতর থেকে জনৈক অফিসার ভাড়াটে খুনিদের এক প্রতিনিধিকে নিউ ইয়র্ক হোয়াটসঅ্যাপ মারফত নির্দেশ দিচ্ছেন আর এক জন খলিস্তানপন্থীকে সাবাড় করে দিতে। সেই পরিকল্পনা আঁটা হচ্ছিল যাঁকে ঘিরে, তিনি কিন্তু আমেরিকার ভূমিতে বসবাসী, নিউ ইয়র্ক শহরে। সেই শিকারের নাম গুরুপতবন্ত সিংহ পন্নুন— আমেরিকার নাগরিক। দিল্লি থেকে অফিসার-প্রবর ফোনে লিখেছেন, পন্নুনের হত্যা ‘এখনই জরুরি’ (প্রায়রিটি নাও)।
আমেরিকার বিচারবিভাগ এই কথোপকথনের প্রতিলিপি পাঠায় নিউ ইয়র্কের আদালতে। সেই প্রতিলিপি অবলম্বন করে সে দেশের সংবাদপত্র ওয়াশিংটন পোস্ট-এ যে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, তাতে জানা যায়, ভারতের গোয়েন্দা দফতরটি হল ‘রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং’, বা ‘র’, এবং ওই ‘অতি বুদ্ধিমান’ অফিসারটি না কি জনৈক বিক্রম যাদব, যিনি ডেপুটেশনে সেন্ট্রাল রিজ়ার্ভ পুলিশ থেকে যোগ দিয়েছিলেন ‘র’-তে।
যাদবের এই ডিজিটাল বার্তালাপ যাঁর ফোন থেকে সংগৃহীত সেই নিখিল গুপ্ত— যিনি নিজে মাদক ও অস্ত্র পাচারে লিপ্ত বলে চিহ্নিত— তিনি যাকে পন্নুন হত্যার ঠিকা দিয়েছিলেন সে নিজেই যে এক আমেরিকান গোয়েন্দা সংস্থার সংবাদসূত্র তা তিনি জানতেন না। ফলে সিআইএ এবং এফবিআই শুরু থেকেই ওয়াকিবহাল ছিল ওই ‘ভারতীয় জেমস বন্ড’-এর কার্যকলাপ সম্পর্কে। গুপ্তচরবৃত্তির অভিধানে যার নাম ‘কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স’। তাদের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে নিখিল গিয়েছিলেন প্রাগ শহরে, তাঁর ‘হিটম্যান’-এর আহ্বানে। তৎক্ষণাৎ গ্রেফতার হন তিনি চেক পুলিশের হাতে, সঙ্গে এফবিআই এজেন্ট। দিনটি ৩০ জুন, হোয়াইট হাউস মাত করে সবে দেশে ফিরেছেন মোদী। নিখিল গুপ্ত এখনও প্রাগের জেলে বন্দি, আমেরিকার বিচার দফতর তাঁর দেশান্তরণের আবেদন নিয়ে চেক শীর্ষ আদালতে উপস্থিত। ও-দিকে নিখিলের ফোন ও ল্যাপটপ-সহ এই আন্তর্জাতিক হত্যা ষড়যন্ত্রের প্রমাণাদি এখন আদালতে দাখিল।
ভারতের দিকে প্রথম অঙ্গুলি নির্দেশ করেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো, দেশের সংসদে দাঁড়িয়ে বলেন শিখ ধর্মমতাবলম্বী কানাডার নাগরিক হরদীপ সিংহ নিজ্জরের হত্যার অন্তরালে ভারত সরকারের এজেন্টদের হাত রয়েছে। দিল্লি জি২০ শীর্ষ বৈঠকে যেখানে প্রেসিডেন্ট বাইডেন, ট্রুডো উভয়ই উপস্থিত ছিলেন, মোদীকে দুই শক্তিশালী রাষ্ট্রনেতার অনেক শক্ত প্রশ্নের সামনাসামনি হতে হয়। কানাডার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও সিআইএ প্রধান ইতিমধ্যে ভারতে এসে দেখা করেন অজিত ডোভাল-সহ ভারতীয় কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে। কোনও গোলমেলে প্রশ্ন উঠলে কাঁধ ঝাঁকিয়ে “প্রমাণ কোথায়?” বলে এড়িয়ে যাওয়ার যে অভ্যাসটি গত কয়েক বছরে রপ্ত করেছেন মোদীর বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্কর ও তাঁর অনুগামীরা, তা অবশ্য এ বার কার্যকর হয়নি, কেননা জ্যান্ত প্রমাণ এখন প্রাগের জেলে বন্দি।
ক্রমশ আরও শক্ত হচ্ছে ওই হত্যাকাণ্ড ও হত্যা ষড়যন্ত্রের উপর পশ্চিমি রাষ্ট্রীয় তদন্তের নিগড়। নিজ্জর হত্যা মামলায় ইতিমধ্যে গ্রেফতার হয়েছে চার জন কানাডাবাসী শিখ যুবক যাঁদের নাগরিকত্ব কিন্তু ভারতীয়। প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, নিখিল তার বন্ধু আততায়ীকে জানিয়েছে, কানাডায় তারা সম্পন্ন করেছে এক ‘মস্ত কাজ’, ফরোয়ার্ড করেছে গাড়ির মধ্যে রক্তাপ্লুত নিজ্জরের শেষ ছবিটি।
এই ঘটনা, যার ফলে ভারত আজ হারাতে বসেছে পাশ্চাত্য দুনিয়ার আস্থা, তার সত্যতা এখনও আদালতে প্রমাণসাপেক্ষ। কিন্তু ভারত সম্পর্কে ‘মারকুটে’ বা ‘আইনের তোয়াক্কা করে না’ ধরনের খ্যাতি যে ছড়িয়েছে, সেটাও আমাদের মনে রাখতে হবে। ভারত সম্পর্কে ধারণা এখন এতটাই নীচে নেমে গেছে যে অস্ট্রেলীয় গুপ্তচর জানাচ্ছেন যে, তাঁর দেশে ভারতীয় অভিবাসীদের নিয়ে তৈরি হয়েছিল ‘গুপ্তচরের বাসা’ (নেস্ট অব স্পাইজ়)। ২০১৯ সালে দ্বিতীয় বার জয়ের পর মোদী হয়তো সত্যিই ভেবেছিলেন তিনি ‘বিশ্বগুরু’। দেশের মাটিতে যেমন তাঁর দল শক্তিশালী বিরোধীদের প্রতি ‘ঠোক দো’ নীতিতে চলে, শাসন চালায় ‘বুলডোজ়ার’ দিয়ে, তেমনই উন্নত গণতান্ত্রিক শক্তিধর দেশের কাছেও তিনি পার পেয়ে যাবেন, এটাই হয়তো ভেবেছিলেন। পশ্চিমের চোখে দেশকে এবং নিজেকে হেয় করে বেশ একটা ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত তৈরি করলেন তিনি।