—প্রতীকী ছবি।
ছত্তীসগঢ় রাজ্যে বিজেপি সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মাত্র সাড়ে পাঁচ মাস। এরই মধ্যে, সরকারি ঘোষণা অনুসারে, ১৩৬ জন মাওবাদীকে হত্যা করেছে রাষ্ট্রীয় বাহিনী। বিভিন্ন জনজাতি অধ্যুষিত গ্রামে আকাশপথে ড্রোন থেকে বোমা ফেলা হচ্ছে। কেন্দুপাতা সংগ্রহের মরসুমে এ ভাবে বোমাবর্ষণের ফলে প্রতি বছর আহত হচ্ছেন বেশ কিছু মানুষ। গ্রামবাসীদের অভিযোগ, তাঁদের ভয় দেখিয়ে গ্রামছাড়া করার জন্য বোমা ফেলা হচ্ছে। বড় বড় প্রতিবাদ সভা করেও জনজাতির মানুষেরা এই আক্রমণ বন্ধ করতে পারেননি। নিজের দেশের মানুষের উপর ঘটে চলা এই লাগাতার হত্যাকাণ্ড, এমন অবাধ বোমাবর্ষণ নাড়া দিতে পারেনি দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে। সমাজের বিশিষ্ট মানুষরাও অধিকাংশই চুপ করে আছেন।
অথচ, মাওবাদী-হত্যার ধারাবাহিকতা চুপ করে থাকতে দেয় না। সরকারি তথ্য বলছে, ১৬ জুন নারায়ণপুরে আট জন, ১৩ মে বিজাপুরে বারো জন, ৩ এপ্রিল বিজাপুরে এবং ৩০ এপ্রিল নারায়ণপুরে যথাক্রমে তেরো জন এবং দশ জনকে হত্যা করেছে যৌথবাহিনী। সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে বড় ঘটনাটা ঘটে ১৬ এপ্রিল। সে দিন কাঁকের-নারায়ণপুর সীমান্তে মাওবাদী বলে এক দিনে ঊনত্রিশ জনকে হত্যা করা হয়। মাঝে-মাঝে পাল্টা হামলা চালায় মাওবাদীরাও। সরকারি হিসাবমতো মাওবাদীদের হাতে এ বছর ১ জানুয়ারি থেকে ২৫ জুন পর্যন্ত বারো জন আধাসেনা নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও অনেকে। সরকারের দাবি, রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে নিহতরা অধিকাংশই মাওবাদীদের গেরিলা বাহিনী পিএলজিএ-র সদস্য। বাকিরা গ্রামবাসীর ছদ্মবেশে তাদের সমর্থনকারী।
প্রশ্ন হচ্ছে, কেউ মাওবাদী দল করলেই রাষ্ট্র কি তাকে হত্যা করতে পারে? বিনা বিচারে রাষ্ট্র কাউকে মৃত্যুদণ্ড দিতে পারে না। ভারতের সংবিধানের ২১ নম্বর ধারা অনুযায়ী জীবনের অধিকার অলঙ্ঘনীয়। মাওবাদী নেতা আজ়াদের হত্যার বিচার করতে গিয়ে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বলেছিল, প্রজাতন্ত্র তার সন্তানকে হত্যা করতে পারে না। সুপ্রিম কোর্ট ও হাই কোর্টের একাধিক রায়ে বলা হয়েছে, শুধুমাত্র মাওবাদী বা কোনও নিষিদ্ধ দলের সদস্য হওয়ার জন্য রাষ্ট্র কাউকে গ্রেফতার করতে, সাজা দিতে পারে না। এই হত্যা আড়াল করতে সরকারি বয়ানে তাই বলা হয় ‘সংঘর্ষে মৃত্যু’। বলা হয়, রাষ্ট্রীয় বাহিনী মাওবাদীদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ায় গুলি চালাতে বাধ্য হয়েছে। এ ভাবেই মাত্র কয়েক মাসে শতাধিক মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। অথচ, বেলা ভাটিয়ার মতো মানবাধিকার কর্মীরা তদন্ত করে দেখেছেন, দু’একটি বাদে প্রায় সব ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রীয় বাহিনী পরিকল্পিত ভাবে একতরফা হঠাৎ আক্রমণ করেছে, বা ধরে এনে ঠান্ডা মাথায় গুলি করে হত্যা করেছে সন্দেহভাজনদের। অর্থাৎ, ভুয়ো সংঘর্ষে হত্যা করা হচ্ছে নাগরিকদের, এমন আশঙ্কার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
মাওবাদীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের এই কার্যসূচি নিয়ে সে ভাবে প্রতিবাদ ধ্বনিত হচ্ছে না। কিছু মানবাধিকার সংগঠনের ক্ষীণকণ্ঠের প্রতিবাদ শোনা যায় বড় জোর। দেশে নতুন সরকার এসেছে। আজ সময় হয়েছে সমগ্র বিষয়টিকে নতুন করে দেখার।
ছত্তীসগঢ়ের উপমুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রী বিজয় শর্মা গত ২৪ মে বলেছেন, “শুনেছি ওরাও মানুষের ভাল চায়। আমরাও ভাল চাই। আমাদের আলোচনা হওয়াই উচিত।” মাওবাদীরা চাইলে ভিডিয়ো কনফারেন্সেও আলোচনা হতে পারে, বলেছেন তিনি। এর উত্তরে মাওবাদীদের তরফে সমাজমাধ্যমে বিবৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, রক্তপাত এড়ানোর জন্য তারাও শান্তি আলোচনা চায়। তবে জল, জমি, জঙ্গল কেড়ে নেওয়া, বা ধ্বংস করা বন্ধ না হলে আলোচনা করে লাভ হবে না। তারা উন্নয়নের রাষ্ট্রীয় মডেল নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। মাওবাদীরা উন্নয়নের বিকল্প কর্মসূচি মেনে চলে। তারা চায়, আলোচনায় সেই কর্মসূচি নিয়েও কথা হোক।
এর আগে এক বার কেন্দ্রীয় সরকার শান্তি আলোচনার উদ্যোগ করেছিল। কিন্তু ১ জুলাই, ২০১০ সালে মাওবাদীদের তরফে আলোচনার দায়িত্বপ্রাপ্ত চেরাকুরি রাজকুমার বা আজ়াদকে এনকাউন্টার করে অন্ধ্রপ্রদেশের পুলিশ। তার পর আলোচনা পরিত্যক্ত হয়। অভিযোগ উঠছে যে, সরকার মুখে আলোচনার কথা বললেও, কাজের বেলা দ্রুত গতিতে জঙ্গল কেটে সাফ করছে। জনজাতি অধ্যুষিত এলাকায় বা গহন অরণ্যে আধাসেনা প্রবেশ করাচ্ছে। অন্তত আশি হাজার কেন্দ্রীয় বাহিনী রয়েছে মাওবাদী অধ্যুষিত বলে পরিচিত এলাকাগুলিতে। একটি হিসাবে, প্রতি সাত জন জনজাতি মানুষ পিছু তিন জন সেনাকর্মী মোতায়েন রয়েছে। অতীতে ‘সালোয়া জুডুম’-এর মতো, জনজাতি গোষ্ঠীর যুবকদের নিয়ে এখন তৈরি হয়েছে ‘বস্তার ফাইটার্স’ বাহিনী। অপারেশন গ্রিনহান্ট, অপারেশন সমাধান-প্রহারের পর এখন চলছে অপারেশন কাগর। ‘কাগর’ মানে ‘দ্য ফাইনাল মিশন’— শেষ যুদ্ধ। যার মানে দাঁড়ায়, আরও রক্তক্ষয়, আরও মৃত্যু।
দ্বিতীয় ইউপিএ সরকার ২০০৯ সালে সিপিআই(মাওবাদী) দলকে নিষিদ্ধ করে। তার পর পনেরো বছর কেটে গিয়েছে। এত দিনে স্পষ্ট, কোনও মতাদর্শকেই বলপূর্বক সমাজ থেকে নিশ্চিহ্ন করা যায় না। তাই ভারত সরকার সেনা সংবরণ করে, আলোচনার টেবিলে আসুক। রাজনৈতিক প্রশ্নের রাজনৈতিক সমাধান খুঁজুক। বন্ধ হোক এই খতম অভিযান।