ভবিষ্যৎ? মূলধনি খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধিতে বাহ্যিক পরিকাঠামোর উন্নয়ন ঘটবে ফাইল ছবি।
অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন গত কাল সংসদে যখন ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষের বাজেট পেশ করলেন, তাঁর পিছনে অদৃশ্য, কিন্তু প্রবল ভাবে উপস্থিত ছিল একটি প্রেক্ষাপট— এক দিকে চড়া বেকারত্বের হার, আর অন্য দিকে চাহিদা হ্রাসের ফলে আর্থিক বৃদ্ধির হারের শ্লথগতি। শিল্পক্ষেত্রের এই গতিহীনতা আজকের কথা নয়। গত এক দশক ধরেই শিল্প ক্রমে গতি হারিয়েছে। অতিমারির ধাক্কায় সেই সমস্যা তীব্রতর হয়েছে, এটুকুই। সামগ্রিক ভাবে লাভজনক, অর্থপূর্ণ কর্মসংস্থানের সুযোগ কম থাকা, এবং আয় হ্রাস পাওয়ার ফলে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও সঙ্কুচিত হয়েছে। তার ফলে, ভারতের মোট অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে স্বাভাবিকের চেয়ে শ্লথতর হারে। তার ফলে আবার ধাক্কা লেগেছে আর্থিক বৃদ্ধির হারে এবং কর্মসংস্থানে।
পণ্য এবং পরিষেবার চাহিদা স্বাভাবিকের চেয়ে কম হওয়ার ফলে আবার বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশিত লাভের পরিমাণ কমেছে। ফলে, নতুন বিনিয়োগ কতখানি লাভজনক হবে, সে বিষয়ে তাঁদের সংশয় বেড়েছে, এবং নতুন বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে তাঁদের আগ্রহও কমেছে। তার ফলে, ভারতের জাতীয় আয়ে বেসরকারি লগ্নি এবং দেশের সব বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ক থেকে প্রদত্ত খাদ্য ব্যতিরেকে অন্য পণ্যের জন্য ঋণের অনুপাতও ক্রমেই হ্রাস পেয়েছে। বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও সুসংবাদ নেই। বৈশ্বিক মন্দার কারণে ভারত থেকে রফতানির চাহিদা কমেছে। পেট্রোলিয়াম পণ্যের দাম ও কমোডিটি প্রাইস বৃদ্ধির কারণে আমদানির খরচ বেড়েছে। ফলে, কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ডেফিসিট বা চালু খাতে ঘাটতির পরিমাণ (আমদানি ও রফতানির মধ্যে ব্যবধান) বৃদ্ধি পেয়েছে।
ক্রেতাদের মোট ভোগব্যয়, বেসরকারি বিনিয়োগ, রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের বিনিয়োগ, রাজস্ব খাতে ও মূলধনি খাতে সরকারের ব্যয়, এবং চালু খাতে উদ্বৃত্ত (অর্থাৎ, রফতানির পরিমাণ থেকে আমদানির পরিমাণ বাদ দিয়ে যা পড়ে থাকে)— এই খাতগুলি যোগ করে জাতীয় আয়ের হিসাব কষা হয়। কাজেই, যখন বাজারে ভোগব্যয়ের পরিমাণ কম, বেসরকারি লগ্নি কম, এবং চালু খাতে ঘাটতির পরিমাণ ক্রমবর্ধমান, তখন সরকারের ব্যয় জাতীয় আয় বৃদ্ধির ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এই অবস্থায় এক্সপ্যানশনারি ফিসক্যাল পলিসি বা প্রসারণমুখী আর্থিক নীতি— অর্থাৎ, জিডিপির অনুপাতে সরকারি ব্যয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি— অর্থব্যবস্থার স্বাস্থ্যোদ্ধারে পরিচিত নীতি। এর ফলে আর্থিক বৃদ্ধির হার বাড়ে, কর্মসংস্থানও বাড়ে। অর্থশাস্ত্রের পাঠ্যবইয়ে এই নীতিটি কেন্সীয় ডিম্যান্ড ম্যানেজমেন্ট পলিসি হিসাবে পরিচিত। যেখানে অর্থব্যবস্থা চাহিদার অভাবের কারণে শৃঙ্খলিত, সেখানে সরকারি ব্যয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি করলে বিভিন্ন দফা মাল্টিপ্লায়ার প্রসেসের মাধ্যমে জাতীয় আয়ের উপর তুলনায় বৃহত্তর প্রভাব পড়ে।
মোট কথা, ভারত এখন যেমন চাহিদার অভাবজনিত সঙ্কটে পড়েছে, তার থেকে নিস্তার পাওয়ার পথ ছিল, জিডিপির অনুপাতে সরকারি ব্যয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি করা। তাতেই স্তিমিত চাহিদা, তার ফলে নিচু হারে সামগ্রিক চাহিদা, কম বিনিয়োগ, কর্মসংস্থানের স্বল্পতা, আয়ের পরিমাণ হ্রাস এবং তার ফলে সামগ্রিক চাহিদা আরও হ্রাস পাওয়ার বিষচক্রটি ভাঙা সম্ভব হত।
এই বাজেটে অর্থমন্ত্রী অবশ্য সে পথে হাঁটলেন না। ২০২২-২৩ অর্থবর্ষের সংশোধিত অনুমান থেকে দেখা যাচ্ছে, এই অর্থবর্ষে সরকারি ব্যয়ের পরিমাণ ছিল জিডিপির ১৫.৩ শতাংশ। বর্তমান বাজেটে সেই অনুপাতটি দাঁড়িয়েছে ১৪.৯ শতাংশে। অর্থাৎ, এই বাজেটটি চরিত্রে সঙ্কোচনমুখী— চাহিদার অভাবজনিত সমস্যায় ভোগা অর্থব্যবস্থার জন্য কেন্সীয় অর্থনীতি অনুসারে যে পথে হাঁটার কথা, অর্থমন্ত্রী তাঁর বিপরীত অভিমুখে হেঁটেছেন।
তাঁর বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বললেন, “এই নিয়ে টানা তিন বছর মূলধনি খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ চড়া হারে বাড়ল, এ বছর তা ৩৩% বেড়ে হল ১০ লক্ষ কোটি টাকা, জিডিপির ৩.৩%। সাম্প্রতিক কালে মূলধনি খাতে বিনিয়োগের চড়া বৃদ্ধি আর্থিক বৃদ্ধির হারে গতি আনতে ও নতুন চাকরি তৈরি করতে, বেসরকারি বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করতে, এবং বৈশ্বিক ঝোড়ো হাওয়া থেকে ভারতকে নিরাপত্তা দিতে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রচেষ্টার প্রাণকেন্দ্রে রয়েছে।” তাঁর আর একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘোষণা হল, নতুন কর-কাঠামোয় বছরে সাত লক্ষ টাকা পর্যন্ত আয়ের উপরে কোনও আয়কর দিতে হবে না। অর্থশাস্ত্রের পাঠ বলবে যে, এই দু’টি সিদ্ধান্তেরই সামগ্রিক চাহিদা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব ফেলার কথা। কিন্তু, ভারতের পরিস্থিতি মাথায় রাখলে বোঝা যায় যে, তা হওয়ার নয়। ভারতে মাত্র ৩ শতাংশ লোক প্রত্যক্ষ কর প্রদান করেন। দেশের মোট পরিবারের মাত্র দশ শতাংশের কাছাকাছিতে এমন কোনও সদস্য আছেন, যাঁকে প্রত্যক্ষ কর দিতে হয়। আয়করের ছাড়ে যে সুবিধা, তা শুধু এই দশ শতাংশ পরিবারের কাছেই পৌঁছবে। বাকি ৯০ শতাংশ পরিবারের কাছে এই ছাড়ের কোনও অর্থ নেই। অন্য দিকে, মূলধনি খাতে বরাদ্দ বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু তার উল্টো দিকে কমেছে জিডিপির অনুপাতে রাজস্ব খাতে ব্যয়বরাদ্দ। ২০২২-২৩ অর্থবর্ষের সংশোধিত অনুমান থেকে জানা যাচ্ছে যে, এই অর্থবর্ষে রাজস্ব খাতে ব্যয়ের পরিমাণ ছিল জিডিপির ১২.৭ শতাংশ। এই বাজেটে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১১.৬ শতাংশে।
ফলে জিডিপির অনুপাতে মোট ব্যয়ের পরিমাণ আসলে কমে গিয়েছে। এ বার জিডিপির অনুপাতে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ খানিক বাড়ার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও ব্যয়বরাদ্দের পরিমাণ কাটছাঁট করা হল জিডিপির অনুপাতে রাজস্ব ঘাটতি ও রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ কমিয়ে আনার জন্যই। এই নীতিগত অভিমুখটি নব্য-ধ্রুপদী অর্থনৈতিক দর্শনের অনুসারী। সেই মত বলে, ঘাটতির পরিমাণ বাড়লে সরকারকে বাজার থেকে যে হারে ধার নিতে হয়, তাতে বেসরকারি লগ্নিকারীদের পক্ষে পুঁজি মহার্ঘতর হয়ে ওঠে, ফলে তাঁদের লগ্নির পরিমাণ কমে— পরিভাষায় যাকে বলে ‘ক্রাউডিং আউট’। তাতে কর্মসংস্থান কমে, আয়বৃদ্ধির হারেও ভাটা পড়ে।
কিন্তু, ভারতে এখন অন্য সমস্যা। দেশের বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলিতে আমানতের অনুপাতে ঋণগ্রহণের পরিমাণ কম, কারণ সামগ্রিক ভাবে বিনিয়োগের চাহিদা কম। তার উপর, ‘ক্রাউডিং আউট’ ঘটে তখনই, যখন অর্থব্যবস্থা তার পূর্ণ ক্ষমতায় চলে, এবং অর্থব্যবস্থায় মোট সঞ্চয়ের পরিমাণ নির্দিষ্ট হয়। ভারতে সরকারের ব্যয় বাড়লে, এবং তার ফলে রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ বাড়লে বেসরকারি লগ্নিকারীদের জন্য পুঁজি অমিল হবে, এ কথা ধরে নেওয়ার যুক্তি নেই, কারণ ভারতীয় অর্থব্যবস্থা এখন ফুল এমপ্লয়মেন্ট বা উৎপাদনের পূর্ণ ক্ষমতার স্তর থেকে অনেক দূরে। কাজেই, এই বাজেটের অন্তর্নিহিত অর্থনৈতিক ভিত্তিটি ভারতীয় অর্থব্যবস্থার বর্তমান অবস্থার সঙ্গে মানানসই নয়।
দেশ জুড়ে যখন কর্মসংস্থান নিয়ে সঙ্কট অব্যাহত, তখন মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান যোজনার ব্যয়বরাদ্দ ৩৩ শতাংশ (৩০,০০০ কোটি টাকা) কমিয়ে দেওয়ার সংবাদে ধাক্কা লাগা স্বাভাবিক। পাশাপাশি, এই বাজেটে খাদ্যে ভর্তুকি কমেছে ৩১ শতাংশ, সারে ২২ শতাংশ, রান্নার গ্যাসে ৭৫ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবর্ষের সংশোধিত অনুমানে দেখা যাচ্ছে যে, বিভিন্ন রাজ্যের জন্য অর্থ কমিশনের বরাদ্দের পরিমাণ ২০২১-২২ অর্থবর্ষের প্রকৃত ব্যয়ের তুলনায় এ বছর বহুলাংশে কমেছে। বর্তমান বাজেটেও সেই বরাদ্দ কমল ৪২,০০০ কোটি টাকা। এখন সামাজিক ক্ষেত্রে মানব উন্নয়ন সংক্রান্ত ব্যয়ের বেশির ভাগটাই রাজ্য সরকারের দায়িত্ব। রাজ্যের বরাদ্দ কাটছাঁট হলে স্বভাবতই রাজ্যগুলির পক্ষে এই ব্যয়নির্বাহ কঠিনতর হবে, ফলে উন্নয়ন খাতে খরচ কমবে। ২০২২-২৩ অর্থবর্ষের সংশোধিত হিসাব থেকে দেখা যাচ্ছে যে, এই অর্থবর্ষে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যয়ের পরিমাণ বাজেট বরাদ্দের চেয়ে যথাক্রমে ৪৪০০ কোটি টাকা ও ৯২৫০ কোটি টাকা কম। এই কাজগুলি করা হয়েছে একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য মাথায় রেখে— জিডিপির অনুপাতে রাজস্ব ঘাটতির হার কমাতে। কিন্তু, এই তথাকথিত ‘বিচক্ষণ আর্থিক নীতি’র পানসি যে বিচক্ষণ অর্থনীতির ঘাটে ভিড়বেই, তেমন কোনও নিশ্চয়তা নেই।
এই বাজেটে অর্থমন্ত্রী অতিধনীদের জন্য কর কমিয়ে দিলেন। আয়করের উপর সারচার্জের হার কমানোয় অতিধনীদের সর্বোচ্চ করের হার ৪৩ শতাংশ থেকে কমে ৩৯ শতাংশ হল। তাতে দেশের জনসংখ্যার সিংহভাগের কী লাভ, সেই প্রশ্ন করা অর্থহীন। দেশের তথাকথিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি (আসলে যারা দেশের ধনীতম ১০-১৫ শতাংশ মানুষের মধ্যে পড়ে) এই বাজেটে খানিক খুশি হতে পারে— সব দিয়েথুয়েও তাদের জন্য আয়করের পরিমাণ খানিক কমেছে। কিন্তু এই বাজেটে দেশের বেকার জনগোষ্ঠী, দরিদ্র ও বিপন্ন মানুষ, কৃষক ও শ্রমিকদের অবস্থার উন্নতি ঘটবে, তেমন আশা ক্ষীণ। এই বাজেট কাদের দিকে ঝুঁকে, তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ নেই। তার জন্য অর্থনীতির যে দর্শনকে আশ্রয় করা হল, বর্তমান ভারতের অবস্থায় তার প্রয়োগযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন অনেক।
সেন্টার ফর ইকনমিক স্টাডিজ় অ্যান্ড প্ল্যানিং, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়