—ফাইল চিত্র।
রোজ কত কী ঘটে যাহা তাহা! ভোট-পর্ব যত এগোচ্ছে, ততই একের পর এক ঘটনায় রাজনীতি নতুন নতুন বাঁক নিচ্ছে। সব ঘটনার মাত্রা এবং অভিঘাত সমান নয়। ভোটারদের উপর তার কোনটা কতটা প্রভাব ফেলতে পারছে বা পারবে, সেটা চূড়ান্ত ফল বলবে। তবে ভোট-আবহে এগুলি ফেলনা নয়।
আর দেখেশুনে আপাতত বহুচর্চিত একটি কথাই বার বার মগজে ঘুরপাক খায়। সেটি হল ‘পারসেপশন’। এই বস্তুটি বড় আকার পেয়ে গেলে, অর্থাৎ মানুষের ধারণায় দানা বাঁধতে থাকলে অনেক সময় কোনও ঘটনার সত্যাসত্যকে তা অনায়াসে পিছনে ফেলে দিতে পারে।
আমরা তো সেই দেশের ‘গর্বিত’ ভোটার, যাঁদের রায়ে ১৯৮৯-তে রাজীব গান্ধী ‘চোর’ অপবাদে হেরে গিয়েছিলেন। জনতার পারসেপশন। বফর্স-এ রাজীবের দুর্নীতি কিন্তু প্রমাণ করা যায়নি। ২০১৯-এ পুলওয়ামাতে সিআরপি-র বাসের কনভয়ে বহিঃশত্রুর মদতে সন্ত্রাসবাদীদের ঘটানো বিস্ফোরণে আমাদের এক দল জওয়ান বেঘোরে ছিন্নভিন্ন হয়ে যান। প্রত্যাঘাত হয় বালাকোটে। তীব্র জাতীয়তাবোধ সে বার ভোটে স্বাভাবিক কারণেই শাসক বিজেপির পালে হাওয়া বাড়িয়েছিল। পারসেপশন।
কিছু কাল পরে অবশ্য জম্মু-কাশ্মীরের তদানীন্তন রাজ্যপালের বক্তব্যে দেশ জানতে পারে, সে দিন নিরাপত্তার স্বার্থে জওয়ানদের জন্য বিমান চেয়েও মেলেনি এবং ঘটনার দিনই ওই রাজ্যপালের কাছে সেই কথা শুনে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নাকি তাঁকে বিষয়টি ‘চেপে যেতে’ বলেছিলেন!
বহরে ছোট। তবু বলতেই হবে, এমনই এক পারসেপশন ১৯৮৮ সালে মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর সাদা পাঞ্জাবিতে কাদা লাগিয়ে দেয়। যার নাম বেঙ্গল ল্যাম্প কেলেঙ্কারি। মুখ্যমন্ত্রী তাঁর ছেলের ‘সুপারিশ’-এ বেঙ্গল ল্যাম্প সংস্থাকে সরকারি আলোর বরাত দিতে বলেছিলেন পূর্তমন্ত্রী আরএসপি-র যতীন চক্রবর্তীকে। সরকারি ফাইলে সেই কথা লিখে দেওয়ার জেরে যতীনবাবুর মন্ত্রিত্ব যায়। ফাইলের পাতাটি পর্যন্ত ছিঁড়ে ফেলা হয়!
সেই সময় সামনে কোনও ভোট ছিল না। উপরন্তু সিপিএম ছিল সব দিক থেকে একনায়ক। বিরোধী কংগ্রেস মিনমিনে, আন্দোলনে অপারগ। তবু জনমনে জ্যোতিবাবুর ‘স্বচ্ছ’ ভাবমূর্তি নিয়ে সংশয় আটকানো যায়নি। আজও ‘বেঙ্গল ল্যাম্প’ রাজ্যের রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক হতে দেখা যায়।
তৃণমূলের আমলে দুর্নীতির আকার, প্রকার, বিস্তার সবই মেগা সাইজ়। দুর্নীতির ক্ষেত্রগুলি দীর্ঘ দিন ধরে জনসমক্ষে স্ফীতকায় হচ্ছে। শাখা-প্রশাখাও ছড়িয়েছে। এর ফলে যে সব পারসেপশন তৈরি হয়, ভোটের বাজারে সেগুলি বিরোধীদের অনায়াস অস্ত্র।
কিন্তু সহসা ভোট চলাকালীন যে দু’টি বিষয় সদ্য দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল, তাতে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপির পক্ষে বিড়ম্বনা এড়ানো সম্ভবত খুব সহজ নয়। সময়ের নিরিখেও এগুলি একেবারে হাতে গরম। একটি সন্দেশখালি নিয়ে স্টিং অপারেশন-এর ভিডিয়ো। অন্যটি রাজ্যপালের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ।
হতে পারে, পরিস্থিতি মোকাবিলার লক্ষ্যে এ বার কেউ আদালতে যাবেন। কেউ কেন্দ্রীয় তদন্তকে ঢাল করতে চাইবেন। কেউ বা সাংবিধানিক রক্ষাকবচের আশ্রয় নেবেন। সে সব পরের কথা। এখন দেখার, বিজেপির জন্য এগুলি ‘চাপ’-এর কারণ কেন।
সকলেই বলছেন, নারদ-কাণ্ডের পরে সন্দেশখালিই সম্ভবত এই রাজ্যে সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর স্টিং অপারেশন। নারদ-ভিডিয়ো সামনে এসেছিল ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনের সময়। তবে সেটি করা হয়েছিল ২০১৪-তে। সেখানে তৃণমূলের বড় বড় নেতামন্ত্রীকে টাকার বান্ডিল নিতে দেখা গিয়েছে।
সবাই জানেন, তৎকালীন মন্ত্রী, অধুনা বিজেপির শীর্ষনেতা, শুভেন্দু অধিকারীকেও ওই ভিডিয়োতে তোয়ালে জড়ানো ‘কিছু’ নিতে দেখা যায়। তবে আদালতে শুভেন্দু কিছু রক্ষাকবচ পেয়েছেন। আবার বিচারপতিত্ব ছেড়ে সম্প্রতি বিজেপি-তে গিয়ে অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় প্রশ্ন তুলেছেন, ওই মোড়কে যে টাকা-ই ছিল, তা কি কেউ নিশ্চিত ভাবে দেখেছে? না, দেখেনি। কিন্তু পারসেপশন কি যুক্তির ধার ধারে?
যাক ও-সব কথা। তাকানো যাক সন্দেশখালির স্টিং অপারেশনের দিকে। অনেকেই জানেন, এই বিষয়ে যে ভিডিয়োটি (নারদ-এর মতো এটিরও সত্যতা আনন্দবাজার যাচাই করেনি) ছড়িয়ে পড়েছে, তার প্রধান উপাদান এলাকায় বিজেপির এক মণ্ডল সভাপতি গঙ্গাধর কয়ালের কথাবার্তা। ভিডিয়ো অনুযায়ী গঙ্গাধরের বক্তব্যের সারমর্ম হল, শাহজাহান-বাহিনী সেখানে কোনও মহিলাকে ধর্ষণ করেনি। কয়েক জনকে দিয়ে ধর্ষণের মিথ্যা অভিযোগ করানো হয়। সেই জন্য তাঁদের মাথাপিছু দু’হাজার করে টাকা দেওয়া হয়েছিল। ভিডিয়ো-তে গঙ্গাধরের দাবি, “শুভেন্দুবাবুর (অধিকারী) নির্দেশে সব হয়েছে।” প্রয়োজনীয় টাকাপয়সা সেখান থেকেই এসেছে বলেও দাবি করেছেন স্থানীয় ওই বিজেপি নেতা।
পশ্চিমবঙ্গের সন্দেশখালি এ বারের ভোটে স্বাভাবিক ভাবেই তৃণমূলের বিরুদ্ধে বিজেপির অন্যতম হাতিয়ার। আমরা জানি, সন্দেশখালি-কাণ্ডের সূত্রপাত তৃণমূল নেতা শেখ শাহজাহানের বাড়িতে রেশন-দুর্নীতির তদন্তে যাওয়া ইডি অফিসারদের উপর হামলা থেকে। ক্রমে শাহজাহান বাহিনীর বিরুদ্ধে জুলুম, গাঁয়ের চাষিদের জমি কেড়ে মাছের ভেড়ি তৈরি করা, তাঁদের প্রাপ্য না দেওয়া ইত্যাদি অনেক অভিযোগ জড়ো হতে থাকে।
কিন্তু দলের দাপট দেখিয়ে গ্রামের মহিলাদের শ্লীলতাহানির মতো ঘৃণ্য অভিযোগ সব কিছুকে ছাপিয়ে মূল বিষয় হয়ে উঠেছে। বৃহত্তর সামাজিক প্রতিবাদ কোনও রাজনীতির গণ্ডি মানেনি। রাজ্যে নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ-দের প্রচারেও এ বার ‘নারীর মর্যাদা রক্ষা’র প্রশ্ন সর্বাধিক গুরুত্ব পেয়েছে। এমনকি, তাঁরা এই প্রচারকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে জাতীয় স্তরেও ‘কাজ’-এ লাগানোর চেষ্টা করেছেন।
ঠিক এই জায়গা থেকেই গঙ্গাধর কয়ালের ‘বক্তব্য’ সম্বলিত স্টিং-ভিডিয়োটি বিজেপি-কে ভরা ভোটের মধ্যে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিল। কারণ সেই একই— পারসেপশন। মুখে ‘মিথ্যা, সব সাজানো’ বলে নস্যাৎ করে দেওয়া, আর প্রকৃতপক্ষে মানুষকে সেটা বোঝানোর মধ্যে যে কতটা ফারাক সেটা বিলক্ষণ টের পাচ্ছে রাজ্যের বিজেপি। গত কয়েক দিন গঙ্গাধরকে তো কার্যত সামনে আনাই হচ্ছে না!
তাঁকে দিয়ে সব অস্বীকার করানোর একটি ভিডিয়ো বার্তা বিজেপি প্রচার করেছে বটে, কিন্তু সত্যের খাতিরে বলতেই হবে, সেখানে গঙ্গাধরের থতমত কথা ও বিভ্রান্ত একটি মুখচ্ছবিই স্পষ্ট হয়েছে। যাতে সংশয়ের নিরসন হওয়া কঠিন।
এ বার রাজ্যপাল-কথা। বাংলার রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোসও তাঁর বিরুদ্ধে রাজভবনে কর্মরত এক জন মহিলার আনা শ্লীলতাহানির অভিযোগ ‘মিথ্যা’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। রাজ্যপালের বিরুদ্ধে এই ধরনের অভিযোগ নজিরবিহীন। এ ক্ষেত্রে বিজেপি বিষয়টি থেকে কিছুটা ‘দূরত্ব’ রাখার কৌশল নিয়েছে। হয়তো বেগতিক বুঝে। তবুও কি দেশের শাসক দল হিসাবে তারা রাজ্যে এর দায় পুরোপুরি এড়াতে পারে?
রাজ্যপালরা আসলে কেন্দ্রীয় শাসকদের ‘হাতের পুতুল’! কিন্তু রাজ্যপালের বিরুদ্ধে এক মহিলার প্রকাশ্য অভিযোগ নিয়ে যাঁরা নীরব থাকেন, সন্দেশখালির মহিলাদের নিয়ে কথা বলার নৈতিক অধিকার তাঁদের থাকে কি? সন্দেশখালির মহিলারাও মুখ ঢেকে শ্লীলতাহানির অভিযোগ জানিয়েছিলেন। তখন সর্বস্তরে সেগুলি বিশ্বাসযোগ্য বলে গ্রাহ্য হয়েছে এবং তাকেই হাতিয়ার করে মোদী-শাহ থেকে রাজ্যের নেতারা সবাই ভোট চাইছেন। তা হলে এক যাত্রায় পৃথক ফল দেখে ‘পারসেপশন’ কী বলবে? এখানেই বিজেপির কাঁটা।
পদে থাকা রাজ্যপালদের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত এবং ফৌজদারি অভিযোগ (যেমন এটি) থাকলেও শুধু সাংবিধানিক রক্ষাকবচের জোরে তাঁদের ছা়ড় পাওয়ার সংস্থান কতখানি যুক্তিসঙ্গত, আজ সেই প্রশ্নও শোনা যাচ্ছে। কারও কারও মতে, এটা স্বাভাবিক ন্যায়বিচারের পরিপন্থী। সেই আলোচনায় যাচ্ছি না।
তবে যাঁর বিরুদ্ধে এই রকম একটি অভিযোগ, তিনি যদি সগর্বে সদর্পে রাজভবনে বিরাজ করেন তা হলে তাঁর রাজনৈতিক উপরওয়ালাদের ভূমিকা বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকতে পারে না। সরিয়ে দেওয়া দূরের কথা, এমন এক জন রাজ্যপালকে অবিলম্বে ছুটিতে পাঠানোরও কি বাধা ছিল?