সফল? ভারত জোড়ো যাত্রা-র শেষ পর্যায়ে শ্রীনগরে সমর্থকদের সঙ্গে রাহুল ও প্রিয়ঙ্কা গান্ধী। ২৯ জানুয়ারি, ২০২৩। ছবি: পিটিআই।
এক মাস হল, কাশ্মীরের লালচকে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে ভারত জোড়ো যাত্রা শেষ করেছেন রাহুল গান্ধী। দেড়শো দিন, কেরল থেকে জম্মু ও কাশ্মীর অবধি ১৪টা রাজ্য, চার হাজার কিলোমিটারেরও বেশি রাস্তা— এই মাপের কোনও রাজনৈতিক পদযাত্রা ভারত এর আগে দেখেনি। এই বিপুল কর্মসূচিতে ঠিক কতটা লাভ হল রাহুলের, কংগ্রেসের, ভারতেরও? যাত্রা শুরুর আগেই রাহুল জানিয়েছিলেন, কোনও নির্দিষ্ট রাজনৈতিক লাভের কথা ভেবে নয়, তিনি পথে নামছেন ভারতের বহুত্ববাদী আত্মাটিকে বাঁচিয়ে তোলার জন্য। পাঁচ মাস ধরে সেই বার্তাই দিয়ে গিয়েছেন রাহুল। কিন্তু, দিনের শেষে তিনি তো সমাজ সংস্কারক নন, আধ্যাত্মিক গুরুও নন— তিনি দেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দলটির শীর্ষনেতা। ফলে, তাঁর পদযাত্রার সাফল্য-ব্যর্থতার মূল্যায়ন রাজনীতির মাপকাঠিতেই হবে।
ভারতীয় রাজনীতিতে যাত্রা ব্যাপারটা চিরকালই তাৎপর্যপূর্ণ। সম্ভবত, তার মধ্যে যে কৃচ্ছ্রসাধন আছে, সঙ্কল্প আছে, তা ভারতীয় গণস্মৃতিতে প্রাচীন তীর্থযাত্রার মূর্ছনা তৈরি করে বলেই। রাহুলের যাত্রাপথে যে ভাবে সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ঢল নেমেছে, তাতে বোঝা সম্ভব যে, এই যাত্রা সাধারণ মানুষের কাছে একটা অর্থ তৈরি করতে পেরেছে। কিন্তু, তার বেশি কিছু পারল কি? ভারত জোড়ো যাত্রায় ভারতের সাম্প্রতিক সমস্যাগুলির কথা সবই এসেছে— মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, সংখ্যালঘু ও দলিতদের সমস্যা। বারে বারেই এসেছে ঘৃণার বদলে ভালবাসার গুরুত্বের কথা। কিন্তু, শেষ অবধি এই যাত্রা কি কোনও একটি স্পষ্ট বার্তা দিতে পারল? সম্প্রীতি, সৌভ্রাত্রের মতো কথাগুলো চমৎকার, কিন্তু বড় বেশি বিমূর্ত। কোনও যাত্রাকে কী ভাবে একটা তীক্ষ্ণ, সুনির্দিষ্ট অর্থে পৌঁছে দেওয়া যায়, তার অন্তত দুটো মোক্ষম উদাহরণ ভারতীয় রাজনীতি গত একশো বছরে দেখেছে। প্রথমটা ১৯৩০-এর ডান্ডি মার্চ। ২৪ দিনে ৩৮৫ কিলোমিটার পথ হেঁটেছিলেন গান্ধী, একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে— সমুদ্রের জল থেকে লবণ তৈরি করবেন। ব্রিটিশ অপশাসনের বিরুদ্ধে যাবতীয় ক্ষোভকে সেই একটা প্রতীকের সূচ্যগ্রে নিয়ে এসেছিলেন তিনি। তার ফল ভারতীয় রাজনীতি জানে। তার ষাট বছর পরে, ১৯৯০ সালে, গুজরাতের সোমনাথ থেকে অযোধ্যার উদ্দেশে রথযাত্রা করেছিলেন লালকৃষ্ণ আডবাণী। ঘোষিত লক্ষ্য একটাই— রাম মন্দির প্রতিষ্ঠা। তার ফলও ভারতীয় রাজনীতি হাড়ে হাড়ে জানে। দুটো সম্পূর্ণ ভিন্নমুখী, আদর্শগত ভাবে বিপরীত মেরুর রাজনৈতিক যাত্রা একটা জায়গায় এক ছিল— সেই যাত্রা ছিল একদম স্পষ্ট ভাবে ঘোষিত, নির্দিষ্ট লক্ষ্যে। ভারত জোড়া যাত্রা শেষ হওয়ার এক মাস পরেও কিন্তু তেমন কোনও লক্ষ্যের সন্ধান মেলেনি।
বরং, দু’একটা পচা শামুকে পা কেটেছে। সংখ্যাগরিষ্ঠের আধিপত্যের বিরুদ্ধে বার্তা দিতে গিয়েও রাহুল ব্যবহার করেছেন সংখ্যাগরিষ্ঠেরই ভাষ্য। নিজের যাত্রাকে তিনি বলেছেন ‘তপস্যা’, বক্তৃতায় ভগবদ্গীতা থেকে ফলের আশা না করে কাজ করে যাওয়ার বাণী উদ্ধৃতি দিয়েছেন। কেউ বলতেই পারেন যে, তপস্য অথবা গীতা তো হিন্দুত্ববাদীদের সম্পত্তি নয়— কোন উদ্দেশ্যে, কোন বার্তা দিতে কেউ সেই কথাগুলি ব্যবহার করছেন, সেটাই আসল। কিন্তু, রাহুল তাঁর সর্বজনীনতার, সহিষ্ণুতার বার্তাগুলিকে সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মের ভাষায় বললে সন্দেহ থাকেই যে, নরম হিন্দুত্বের রাজনীতির আকর্ষণ তিনি এড়াতে পারলেন না।
তা হলে কি যাত্রার সাফল্যের পাল্লা নেহাতই খালি? এমন কথা বলার কোনও প্রশ্নই নেই। প্রথমে কংগ্রেসের লাভের কথা বলি। ভারতের রাজনৈতিক কল্পনা থেকেই হারিয়ে যেতে বসা দলটি পাঁচ মাসে যে বিপুল সাংগঠনিক শক্তির পরিচয় দিল, তা উল্লেখযোগ্য। রাজ্যে রাজ্যে সাধারণ মানুষ এই যাত্রার পাশে থেকেছেন ঠিকই, কিন্তু তা দিয়ে তো এত বড় যাত্রা পরিচালনা করা যায় না। বিজেপি-বিরোধী রাজনীতির পরিসরে ‘স্বাভাবিক নেতা’-র আসনটি কার্যত কংগ্রেসের হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল। অনেক বিরোধী দলকে যাত্রার শরিক করতে পেরেছে কংগ্রেস, এই কথাটির তাৎপর্য অস্বীকার করার নয়। সাধারণ মানুষের চোখেও দল হিসাবে কংগ্রেসের গুরুত্ব সম্ভবত বেড়েছে। কিন্তু, দলের রাজনৈতিক উপস্থিতি তৈরি করতে পারা আর তাকে ব্যালট বাক্সে সাফল্যে রূপান্তরিত করতে পারা এক নয়। কংগ্রেসের সংগঠনে অন্তর্দ্বন্দ্ব, দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থকে স্থান দেওয়ার যে ঘুণ লেগেছিল, এই যাত্রা তাকে দূর করতে পারল কি? মানুষের চোখে কংগ্রেস বিজেপির যথেষ্ট যোগ্য বিকল্প হয়ে উঠতে পারল কি না, সংশয় তা নিয়েও।
এই যাত্রা থেকে রাহুল গান্ধীর লাভ বরং অনেক স্পষ্ট, সুনির্দিষ্ট। বিজেপির লাগাতার প্রচার তাঁর পরিচিতি তৈরি করেছিল ‘পাপ্পু’ হিসাবে। পাঁচ মাসের পদযাত্রায় রাহুল সেই পরিচয়কে অনেক পিছনে ফেলে এসেছেন। এই যাত্রায় রাহুলের শারীরিক সক্ষমতার পরিচয় মিলেছে, সেটা তুলনায় কম গুরুত্বপূর্ণ কথা— অনেক বেশি জরুরি বার্তা হল, রাহুল প্রমাণ করতে পেরেছেন যে, তিনি রাজনীতির পথ হাঁটতে ইচ্ছুক। এবং সক্ষম। বার্তাটি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তাঁর নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন শুধু বিজেপিই তোলেনি, দলের অভ্যন্তরেও বারে বারেই অসন্তোষ মাথাচাড়া দিয়েছে। ভারত জোড়ো যাত্রা সেই প্রশ্নগুলির সদর্থক উত্তর দিয়েছে।
কিন্তু, তার চেয়েও বড় কথা, কেমন নেতা হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করলেন রাহুল? এই যাত্রার পাঁচ মাসে তাঁর মুখে বারে বারেই ফিরে এসেছে ভারতের প্রসঙ্গ— ভারত কী ছিল, এবং আজকের এই বিদ্বেষের অন্ধকার পেরিয়ে ভারত কী হয়ে উঠতে পারে। রাহুল নিজের উত্তরাধিকার সম্বন্ধে সচেতন— তিনি জানেন, যে ভারতের সম্ভাবনার কথা তিনি বলছেন, তা জওহরলাল নেহরুর ভারত; তিনি যে রাজনীতির কথা বলছেন, তা নৈতিকতার, আদর্শের। কিন্তু, শুধু সেই বিমূর্ত বার্তাটুকুই নয়, নেতা হিসাবে তিনি কেমন, ভারত জোড়ো যাত্রা তারও ইঙ্গিত দিল। রাহুলের বক্তৃতাগুলি আগে থেকে লিখে রাখা গুছানো নয়, তিনি মনের কথা বলেছেন জনসমক্ষে। তাঁর বক্তৃতায় নাটক ছিল না, গলা-বন্ধ-হয়ে-আসা-আবেগ ছিল না। এবং, ছিল না ছাতি চাপড়ে নিজের শক্তি প্রদর্শন, অন্য পক্ষের প্রতি ঘৃণাবর্ষণ, অথবা যুদ্ধের দামামা। বলা যেতেই পারে, রাহুল নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন এমন এক জন নেতা হিসাবে, যিনি নরেন্দ্র মোদী নন— আদর্শগত ভাবেও নন, ব্যবহারিক ভাবেও নন।
মোদীর সঙ্গে তাঁর ফারাক এই যাত্রা আরও এক ভাবে স্পষ্ট করেছে। রাহুল চোদ্দোটা রাজ্যের মানুষের কাছে গিয়েছেন, কিন্তু ভোট চাইতে নয়, মানুষের সঙ্গে সংযোগ গড়ে তুলতে। বলা যেতে পারে, ভোটার হিসাবে নয়, তিনি মানুষকে দেখেছেন সহনাগরিক হিসাবে, যাঁদের সঙ্গে এক মিছিলে পা মেলানো যায়, যাঁদের কথা শোনা যায়, যাঁদের কাছে নিজের কথা বলা যায়। ভারতীয় রাজনীতি থেকে এই অভ্যাসটা গত কয়েক দশকে সম্পূর্ণ হারিয়ে গিয়েছিল। নেতা আর সাধারণ মানুষের মধ্যে সম্পর্ক যে জনসভার মঞ্চ আর তার নীচের আসনের উচ্চাবচতায় বাঁধা নয়, বরং পাশে দাঁড়ানোর, ভারত জোড়ো যাত্রায় এই কথাটা মনে করিয়ে দেওয়াই রাহুলের সবচেয়ে বড় সাফল্য। তবে, এখানেও একটা সংশয় থাকে— নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্ব, সেই ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ ছাপ্পান্ন ইঞ্চির পৌরুষ যাঁদের পছন্দ, রাহুলের বার্তা তাঁদের কাছেও পৌঁছল কি? যাঁরা মোদীর থেকে মুক্তি খুঁজছেন, শুধু তাঁদের গণ্ডিতেই আটকে পড়লেন না তো ‘নতুন রাহুল’?
যাত্রার অর্জনকে কংগ্রেস ব্যালট বাক্সে প্রতিফলিত করতে পারবে কি না, নেতা হিসাবে রাহুল এই নবলব্ধ পরিচিতিটি ধরে রাখতে পারবেন কি না, বিজেপি-বিরোধী রাজনীতিকে এক ছাতার নীচে আনা সম্ভব হবে কি না, সব প্রশ্নের উত্তরই ভবিষ্যতের গর্ভে। কিন্তু, এই যাত্রা থেকে ভারত ইতিমধ্যেই যা পেল, তা একটি সম্ভাবনা— উগ্র, প্রবল পুরুষতান্ত্রিক, বিভাজনবাদী রাজনৈতিক ভাষ্যের বিকল্প যে এই ভারতে এখনও সম্ভব, ভারত জোড়ো যাত্রা তা জানিয়ে গেল।