যন্ত্র মানুষের মতো ভাবছে, মানুষও যন্ত্রের মতো
Artificial Intelligence

রক্তমাংসের (রো)বট

খেলাটা কঠিন থেকে কঠিনতর হবে। তার কারণ, যন্ত্রমেধা আমাদের মগজকে আরও আরও নিখুঁত ভাবে অনুসরণ করবে। খুঁত এখনও বিস্তর আছে বইকি।

Advertisement

অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৫:১৫
Share:

যন্ত্রমেধার এই নাটকীয় অভিযানে চ্যাটজিপিটি এক নতুন পর্বের সূচনা করল। প্রতীকী ছবি।

বট অর নট?— এটি একটি ‘খেলা’। কথার পিঠে কথা চালানোর— যাকে বলে কথোপকথনের— এই খেলাটি নেট-দুনিয়ায় চালু হয়েছিল বছরকয়েক আগে। কার সঙ্গে কথোপকথন? সেখানেই হল গিয়ে আসল ঝঞ্ঝাট। এ খেলার সঙ্গীরা পর্দার ও পারে সব সময় হাজির। ডাকলেই কেউ না কেউ চলে আসবে, কথা শুরু করলেই জবাব দেবে, কখনও মুখ ভার করে বসে থাকবে না, ও-সব তার ধাতে নেই, মানে সোজাসাপটা ভালমানুষ আর কি। প্রশ্ন একটাই: সে কি সত্যিই মানুষ? না কি মানুষের তৈরি করা একটি কম্পিউটার প্রোগ্রাম? এক ধরনের যন্ত্র-মানব, অথবা মানব-যন্ত্র। রোবট। ছোট করে বললে, ‘বট’। খেলাটা এই নিয়েই। কথার পিঠে কথা লিখতে লিখতে আপনাকে অনুমান করতে হবে, যার সঙ্গে আলাপ চলছে, সে মানুষ না বট? ঘুরিয়ে দেখলে, বট অর নট? উল্টো দিকে যে, সে-ও জানে না আপনি কী বা কে, বট অর নট। ভাবলে গা-শিরশির করে বইকি।

Advertisement

খেলাটির কথা ইদানীং আবার ইতস্তত ফিরে আসছে। ফিরে আসছে ‘চ্যাটজিপিটি’র আলোচনায়। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই)-এর এই নতুন অবদানটির পুরো নাম: চ্যাট জেনারেটিভ প্রি-ট্রেনড ট্রান্সফর্মার। মাসকয়েক আগে ভার্চুয়াল দুনিয়ার হাটে এর আবির্ভাব। এআই বা যন্ত্রমেধা ব্যবহার করে তৈরি এই ‘চ্যাটবট’টি হাজার প্রশ্নের চটজলদি উত্তর দিয়েই ক্ষান্ত নয়, স্বর্গ মর্ত এবং তার মধ্যবর্তী বহু বিষয়ে সে আমাদের বায়না মাফিক গোটা গোটা রচনা চটপট লিখে দিতে পারে, তৈরি করে দিতে পারে আরও অনেক কিছুই। সেগুলো দেখে প্রায়শই বোঝা যাচ্ছে না যে উত্তরপত্রটি লৌকিক নয়, যান্ত্রিক। অর্থাৎ কিনা, দিদিমনি প্রশ্ন দিয়েছেন, ছাত্রছাত্রীরা উত্তর লিখেছে, এ-বার তিনি ধরতেই পারছেন না, কে নিজে খেটেখুটে বা অন্তত বইপত্র খুলে লিখেছে আর কে সিধে চ্যাটবট-এর রাস্তা নিয়েছে। বট অর নট?

প্রযুক্তির অন্দরমহল একেবারেই চিনি না, তবে পল্লবগ্রাহিতায় ভর করে এইটুকু জেনেছি যে, যন্ত্রের ভান্ডারে ক্রমাগত তথ্য সরবরাহ করে এবং তার সৃষ্টিকর্মকে বারংবার সংশোধন করে তাকে ‘শিক্ষিত’ করে তোলার প্রযুক্তিকৌশলই হল যন্ত্রমেধার মূল চালিকাশক্তি, এই ভাবেই সে উত্তরোত্তর ‘মেধাবী’ হয়। নিজে আসলে কিচ্ছুটি জানে না, কিন্তু মানুষের জ্ঞান আর চিন্তার ফসল বিপুল পরিমাণে ‘কাঁচামাল’ হিসেবে আত্মস্থ করে করে সে বহু বিষয়ে মানুষের বিকল্প হয়ে ওঠে, অনেক সময় বিকল্পতর। এই প্রক্রিয়া চলছে অনেক দিন ধরে, উন্নত যন্ত্রমেধা উন্নততর হচ্ছে। নানা কাজে দুরস্ত হয়ে উঠছে, শিখে ফেলছে নতুন নতুন বিদ্যে।

Advertisement

যন্ত্রমেধার এই নাটকীয় অভিযানে চ্যাটজিপিটি হয়তো এক নতুন পর্বের সূচনা করল। আবির্ভাবের মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই তাকে নিয়ে দিকে দিকে শোরগোল। ভাঁজ পড়েছে গুগল নামক সর্বজ্ঞ এবং সর্বময় দেবতাটির কপালে— নয়া অবতারের সঙ্গে চ্যাট করতে করতে যদি সব কিছু জেনে নেওয়া যায়, এমনকি তাকে দিয়ে যা দরকার লিখিয়ে বা বানিয়ে নেওয়া যায়, তা হলে আর লোকে তাকে পুজো দেবে কেন? অন্য দিকে, নতুন উদ্বেগ দেখা দিয়েছে কাজের বাজারে— মানুষের অনেক রকমের কাজই তো যন্ত্রমেধা কেড়ে নিয়েছে, এ-বার কি তবে স্কুলকলেজের নোটবই, বিজ্ঞাপনের কপি, সংবাদ প্রতিবেদন কিংবা বিশ্লেষণী প্রবন্ধ থেকে শুরু করে রকমারি কম্পিউটার প্রোগ্রাম অবধি সবই চ্যাটজিপিটি বা তার উত্তরসূরিরা করে দেবে? এমনকি, কে বলতে পারে, চ্যাটজিপিটি খুলে সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলে স্কুলকলেজের আর প্রয়োজনই থাকবে না, অতএব শিক্ষক নিয়োগও করতে হবে না, নিয়োগ না হলে নিয়োগ-দুর্নীতিও হবে না। দুয়ারে অমৃত কাল?

প্রশ্ন উঠতে পারে, যন্ত্রমেধার মহিমা যদি এমন জায়গায় পৌঁছে যায় যেখানে তার কীর্তিকে মানুষের কাজ থেকে তফাত করা অসম্ভব, তা হলে কি অনেক ব্যাপারেই ডিজিটাল প্রযুক্তির বিশ্বাসযোগ্যতায় বড় রকমের ঘা লাগবে না? আর তার ফলে সেই প্রযুক্তির সর্বগ্রাসী অভিযানে বাধা পড়বে না? পঠনপাঠনে, গবেষণায়, কর্মক্ষেত্রে, যেখানেই ডিজিটাল পরিসরে ফাঁকির অবকাশ আছে, ‘বট না মানুষ’ বুঝতে না পারলে ঠকে যাওয়ার আশঙ্কা আছে, সেই সব ক্ষেত্রে কি জানবার দায়, ভাববার দায়, কাজ করবার দায় যন্ত্রের হাতে সঁপে দেওয়ার তাড়না কমবে? এবং, ‘শারীরিক দূরত্বের’ নেশা থেকে সমাজের অন্তত কিছুটা রেহাই মিলবে? বাধ্য হয়েই আমরা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অফিস-কাছারি, সর্বত্র সাক্ষাতে একে অন্যের কথা বলব, শুনব, আলোচনা করব? হতেই পারে। অনেক সময়েই একটি প্রযুক্তির অতিরিক্ত ‘সাফল্য’ তার সঙ্কট ডেকে এনেছে, যেমন বড় বাঁধ কিংবা তাপবিদ্যুৎ। যন্ত্রমেধার অতিব্যবহারও সে-পথে যেতে পারে বইকি। মানুষী অহঙ্কারে আমরা তাকে ডেকে বলতেই পারি: অতি বাড় বেড়ো না...

কিন্তু সম্ভাবনা মানে তো আর নিশ্চয়তা নয়। বরং উল্টোটাও খুবই সম্ভব যে, ডিজিটাল প্রযুক্তি এবং যন্ত্রমেধার দাপট দুর্বার গতিতে বেড়ে চলবে। ফাঁকি দিয়ে বা ঠকিয়ে কার্যসিদ্ধির যে বিপদ এআই প্রযুক্তি ডেকে আনছে, তার মোকাবিলার উপায়ও সেই প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়েই উদ্ভাবন করা হবে। ইতিমধ্যেই বহু ক্ষেত্রে মুশকিল আসানের বিস্তর উপায় প্রযুক্তির সাহায্যেই খুঁজে নেওয়া হয়েছে; আমরা বারংবার দেখেছি— জালিয়াতির কৌশল যদি ডালে ডালে ঘোরে তবে জালিয়াতি ধরবার কৌশল ঘোরে পাতায় পাতায়। ফাঁকি এবং প্রবঞ্চনা বন্ধ হবে না, তার লীলায় বিপদ ঘটতে পারে, বিপর্যয়ও আসতে পারে, যন্ত্রমেধার অশ্বমেধের ঘোড়া সাময়িক ভাবে থমকে যেতে পারে, কিন্তু এটা মনে করার কোনও কারণ নেই যে, সে থেমে যাবে। বট অর নট— এ-খেলা বন্ধ হওয়ার নয়।

খেলাটা কঠিন থেকে কঠিনতর হবে। তার কারণ, যন্ত্রমেধা আমাদের মগজকে আরও আরও নিখুঁত ভাবে অনুসরণ করবে। খুঁত এখনও বিস্তর আছে বইকি। যেমন, চ্যাটজিপিটির শিক্ষাদীক্ষায় ফাঁকফোকর অনেক, অনেক কিছুই সে জানে না, অথবা ভুলভাল জানে, অনেক সময় সেই সব ভুল তথ্যই বেমালুম লিখে দেয়— আমাদেরই মতো আর কি। শুধু কি তা-ই? তার যে সব লেখা এক নজরে মানুষের সৃষ্টি বলে মনে হয়, সেগুলি একটু খুঁটিয়ে দেখলে একটা যান্ত্রিকতা ধরা পড়ে; রক্তমাংসের লেখকের প্রতিবেদনে যে ছক-ভাঙা, অপ্রত্যাশিত, হয়তো কিছুটা অস্বাভাবিক ভাষাভঙ্গির দেখা মেলে, সেটা যন্ত্রমেধার সৃষ্টিতে সুলভ নয়। মানে, যন্ত্র যখন ঠিকঠাক লেখে, তখনও সে যন্ত্রের মতোই লেখে। কিন্তু এ-সব ত্রুটি চিরকাল একই রকম থাকবে না। তথ্যগুলো ঠিকঠাক শিখিয়ে দেওয়া তো বটেই, মানবিক আবেগ বা অনুভূতির বাগ্‌ধারাও হয়তো যন্ত্রকে শিখিয়ে-পড়িয়ে নেওয়া যাবে, এমনকি তার লেখায় সরবরাহ করা যাবে অ-যান্ত্রিক চমক। যন্ত্র ক্রমশই আরও বেশি মানুষের মতো হবে।

এবং মানুষ ক্রমশই আরও বেশি যন্ত্রের মতো? তার চিন্তাভাবনা এবং তা প্রকাশের ভাষাভঙ্গি মানবিক অনুষঙ্গগুলি ছেড়ে ফেলে যন্ত্রমেধার পথ অনুসরণ করবে? করবে নয়, করছে। নানা দিক থেকেই আমরা যান্ত্রিকতার বশ হয়ে উঠছি। তার প্রথম নিদর্শন আমাদের শিক্ষাজগৎ। একেবারে শৈশব থেকে ভাবী নাগরিকদের যে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে তা আপাদমস্তক যান্ত্রিক। এই যান্ত্রিকতা সুপরিকল্পিত— ছোটদের আনকোরা মগজকে তার নিজের মতো বেহিসেবি চিন্তায় হারিয়ে যেতে না দিয়ে যত শিগগির পারা যায় বাঁধা সড়কে দৌড় না করালে সেই মগজ জীবনে ‘শাইন’ করবে কী করে? শিক্ষার এই যান্ত্রিকতা বড় রকমের ছাপ ফেলছে শিক্ষার্থীদের চিন্তাশক্তিতে, বাঁধা গতের বাইরে গিয়ে ভাববার সামর্থ্য ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছে।

তার সঙ্গে তাল মিলিয়েই আমাদের জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রায় নিরঙ্কুশ সাম্রাজ্য বিস্তার করেছে বাঁধা গতের ভাবনা আর কথামালা। রাজনীতির মঞ্চে, সাহিত্য-সংস্কৃতির আসরে, টিভি চ্যানেলের বৈঠকখানায়— সমাজের সমস্ত পরিসরে যে কোনও বিষয়ে কথার পাহাড় জমতে থাকে, কিন্তু নতুন কথা বা অন্য রকম কথা বিরলের মধ্যেও বিরলতম। সমাজমাধ্যমে প্রতিনিয়ত সেই যান্ত্রিক গড্ডলিকার অবিরাম প্রবাহ— যে কোনও বিষয়ে যে কেউ একটা কথা পাড়লে একশোটা প্রতিক্রিয়ার মধ্যে পঁচানব্বইটা আগে থেকেই বলে দেওয়া যায়। বস্তুত, যন্ত্রমেধাকে বাজার-চলতি একটি বিষয় দিয়ে বক্তৃতা, আলোচনা, সাক্ষাৎকার বা বিতর্কের বয়ান তৈরি করতে বলা হলে সে অনায়াসে তা করে দেবে, এবং তাকে চট করে নকল বলে ধরে, কার সাধ্য।

তাই ভাবছিলাম, আমরা যদি বাঁধা গতের ভাবনার পথে এই ভাবেই এগোতে থাকি, রক্তমাংসের মস্তিষ্ক আর আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের প্রকৌশল যদি একে অন্যের প্রতিলিপি হওয়ার সাধনা চালিয়ে যায়, তা হলে ‘বট অর নট’-এর পার্থক্য বিচার করা অসম্ভব হয়ে উঠতে পারে। অবশ্য তখন আর সেই বিচারের প্রয়োজনও থাকবে না। কারণ, সেই অ-লৌকিক ভুবনে যাহা মানুষ তাহাই রোবট।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement