লক্ষ্য: পশ্চিমবঙ্গে এসে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর জনসভা, সিউড়ি, বীরভূম, ১৪ এপ্রিল। পিটিআই।
ঝটিকা বঙ্গ-সফরে এসে রাজ্য বিজেপিকে ফের ‘ভোকাল টনিক’ দিয়ে গিয়েছেন অমিত শাহ। গত বিধানসভা ভোটে এমন ‘টনিক’ দিয়েই তাঁর দলকে দু’শো আসনে জেতানোর চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। শেষ পর্যন্ত যা দাঁড়িয়েছিল ৭৭। তার পর থেকে ‘ঘটনাচক্রে’ শাহকে বাংলায় খুব বেশি আসতে দেখা যায়নি। এ বার এমন এক সময়ে তিনি সভা করতে এলেন, যখন পঞ্চায়েত নির্বাচন দোরগোড়ায়। যখন দুর্নীতির বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় তদন্তের জালে তৃণমূল-শিবিরের লোকজনের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। যখন রাজ্যের সঙ্গে রাজ্যপালের সম্পর্ক চিড় খাচ্ছে। এবং যখন ‘সকলকে নিয়ে’ বিজেপি-বিরোধী জোটের বার্তা দিচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
হাওয়ায় আগুন ছুটলেও শাহ হয়তো ভেবেছেন, এখানে এটাই তাঁর ‘পৌষ মাস’! বস্তুত সভার জন্য সিউড়িকে বেছে নেওয়া তার অন্যতম ইঙ্গিত। যে কেউ মানবেন, এ এক এমন জায়গা, যেখানে সহজেই এক তিরে অনেক ‘লক্ষ্য’ ভেদ করা যেতে পারে। প্রথমত, রাজ্যে পঞ্চায়েত (বা, অন্য) নির্বাচনে জোর-জুলুমের নিরিখে বীরভূমের ওই তল্লাটের ‘নামডাক’ সবচেয়ে বেশি। দ্বিতীয়ত, দুর্নীতিতে অভিযুক্ত হয়ে সেখানকার একচ্ছত্র ‘বীর’ অনুব্রত মণ্ডল এখন সিবিআই হেফাজতে জেল খাটছেন। তৃতীয়ত, সেই অনুব্রত এখনও বীরভূমে তৃণমূলের জেলা সভাপতি। চতুর্থত, গত বছরের মার্চে এই জেলারই বগটুই গ্রামে এক তৃণমূল নেতা খুনের পরে গ্রাম জ্বালিয়ে লোকজনকে পুড়িয়ে মারার ঘটনা এখনও দগদগে।
সব মিলিয়ে তাই বিরোধীরা সরকার ও শাসক দলের দিকে আঙুল তোলার ‘রসদ’ এখানে পেয়ে যেতে পারেন। শাহের সভার জায়গা বাছার সময় বিজেপি তা বিবেচনা করেছে বলেই মনে হয়। তবে সেই সভায় তিনি যা যা বলেছেন, তাতে বিজেপির ব্যাটে রান উঠল, না কি মাঠে নেমেই ‘হিট উইকেট’, সেই তর্কে রাজ্যের রাজনীতি এখন জমজমাট।
সবাই জানি, শাহ সে দিন বিজেপির জন্য লোকসভায় বাংলা থেকে ৩৫ আসনের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে দিয়েছেন। এই চাওয়ার মধ্যে দোষের কিছু নেই। এটা খুব স্বাভাবিক রাজনৈতিক দাবি। বিয়াল্লিশটি আসনের সব ক’টি পাব বললেও কিছু বলার থাকত না। যদিও লোকসভায় কে কত পাবে, এখন সেটা মাসির গোঁফ গজানোর মতো কল্পনামাত্র! তবু শাহের কথা ধরে নিয়ে বলি, তাঁরা লোকসভায় পঁয়ত্রিশটি আসন পেয়ে গেলেই এ রাজ্যে সরকার পড়ে যাবে, এমন ইঙ্গিত তিনি দিলেন কেন? এটা কি শুধুই দলকে ‘উজ্জীবিত’ করার কৌশল?
প্রকাশ্যে তার কোনও ব্যাখ্যা শাহ দেননি। তবে দলের ভিতরে নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অর্থপূর্ণ মন্তব্য, “আপনারা যতটা ভাবছেন, তৃণমূলের হাল তার চেয়েও খারাপ হতে চলেছে। দেখতে থাকুন।” শাসক শিবিরের বিরুদ্ধে একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগ এবং সে-সব নিয়ে কেন্দ্রীয় তদন্তের মাত্রা যে ভাবে বেড়ে যাচ্ছে, তাতে শাহের ওই ‘ভবিষ্যদ্বাণী’র তাৎপর্য সুদূরপ্রসারী। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিযোগ অনুযায়ী, এটা সরকার ভেঙে দেওয়ার ‘কেন্দ্রীয় চক্রান্ত’ কি না, তা অবশ্যই রাজনৈতিক বিতর্কের উপাদান। সাধারণত কোনও নির্বাচিত সরকার ভেঙে যাওয়ার প্রধান কারণ দু’টি। এক, বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানো। সেটা রাজনৈতিক। দুই, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া। যেটা প্রশাসনিক। তেমন পরিস্থিতিতে রাজ্যপাল সরকার ভাঙার পথে যেতে পারেন।
কিন্তু ১০ জন মন্ত্রী জেলে গেলেও বিধানসভায় যত ক্ষণ গরিষ্ঠতা বজায় থাকবে, তত ক্ষণ সোজা পথে অর্থাৎ সাংবিধানিক ভাবে নির্বাচিত সেই সরকারের পতন ঘটানো যায় না। তার জন্য অপেক্ষা করতে হয় ভোটের। প্রশ্ন উঠতে পারে, বিজেপি নেতারা কি তা হলে ধরে নিয়েছেন, লোকসভায় দলের ফল ‘ভাল’ হলে গত বারের মতোই তৃণমূল থেকে ওই দিকে ঢল নামবে? তাঁরা কি আশা করছেন, এ বার কেন্দ্রীয় তদন্ত ‘ব্রহ্মাস্ত্র’ হয়ে উঠবে? না কি লোকসভায় বিজেপি বেশি আসন পেয়ে গেলে তার জোরে রাজ্যে আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়ার পরিসর প্রশস্ত হবে?
উত্তর জানা নেই। তবে অনুমান করা যায়, তাঁদের সুদূর ভাবনায় অনেক কিছুই হয়তো সম্পৃক্ত হয়ে আছে। শাহের বক্তব্য হয়তো তারই কিছু আভাস। যদিও অতীত বলে, এখানে দল ভাঙিয়ে দল ভারী করার খেলায় বিজেপি আগেই পর্যুদস্ত হয়েছে। উনিশের লোকসভায় আঠারোটি আসনে জেতার পরে বিজেপি কী ভাবে একুশের বিধানসভা ভোটে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এবং শাসক তৃণমূলে ভাঙন ধরিয়ে তাদের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল, তা আর নতুন করে বর্ণনার অপেক্ষা রাখে না। তার পরিণতিটিও এই রাজ্যের রাজনীতিতে অবশ্যই একটি সূচক। ওই লোকসভা ভোটের নিরিখে ধরলে বিধানসভায় বিজেপি প্রায় পঞ্চাশটি আসন কম পায়। আর তৃণমূলের আসন বেড়ে যায় প্রায় পঞ্চাশটি। ভোট-পণ্ডিতদের কাছে এর বহুবিধ ব্যাখ্যা আছে। তবে সাধারণ মানুষ সহজ বুদ্ধিতে এটুকু বোঝে, লোকসভা এবং বিধানসভার ভোট সর্বদা এক হিসাব মেনে চলে না।
এ কথা ঠিক, সম্প্রতি বাংলায় প্রধান রাজনৈতিক দলগুলির শক্তির বিন্যাসে কিছু পরিবর্তন বোঝা যাচ্ছে। ক্ষমতায় আসার সময় থেকে রাজ্যে সংখ্যালঘু ভোট কার্যত তৃণমূলের একচেটিয়া হয়ে থেকেছে। তবে ইদানীং অনেকের ধারণা, সংখ্যালঘু ভোটে কংগ্রেস ও বামেদের জোটের অল্প-বিস্তর প্রভাব পড়া অসম্ভব নয়। সাগরদিঘির উপনির্বাচন হয়তো একটি ইঙ্গিত। কিন্তু এই ধরনের বিন্যাস থেকে বিজেপির লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা কম। ভোটের প্রবণতা থেকে সেটা নজরে পড়ে। উপরন্তু মেরুকরণের রাজনীতিতে আস্থা রেখে শাহ প্রকাশ্য সভায় এটাও স্পষ্ট করে দিয়েছেন, “এক বার আমাদের ৩৫ আসনে জিততে দিন। তার পরে কারও হিম্মত হবে না রামনবমীর মিছিলে হামলা করার!”
পোড়-খাওয়া নেতা তিনি। ফলে মুখে যা-ই বলুন, আসলে তিনি বিলক্ষণ বোঝেন, বাংলায় জিততে গেলে মমতার মতো প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধেই তাঁদের লড়তে হবে। সে জন্য সবার আগে চাই সংগঠন। আর রাজ্য বিজেপির সেটাই সবচেয়ে দুর্বল জায়গা! ভিত এখনও নড়বড়ে। দল এখানে ভোটের জন্য কতটা তৈরি তার আঁচ করতে গিয়ে শাহ থেকে জেপি নড্ডা কেউই যে খুশি হতে পারেননি, এটাও এখন আর গোপন নেই। একাধিক বার এ নিয়ে রাজ্য নেতৃত্বকে ‘সতর্ক’ করেছেন কেন্দ্রীয় নেতারা। ফাঁক ঢাকতে এখন আবার ধরা পড়ছে ফাঁকিও!
যেমন ‘বুথ স্বশক্তিকরণ’ অভিযান। দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সম্প্রতি বাংলায় তাঁদের ওই কর্মসূচির হাল যাচাই করতে এসেছিলেন। জানা যায়, তাঁদের কাছে রাজ্য নেতৃত্ব যে হিসাব দাখিল করেন, তার অনেকটাই নাকি বাস্তবের সঙ্গে মেলেনি। কেন্দ্রীয় নেতারা দেখেন, রাজ্যের নেতারা পঞ্চাশ শতাংশ বুথে কর্মী-সংযোগ হয়ে যাওয়ার ‘তথ্য’ দিলেও বিভিন্ন জেলার রিপোর্ট থেকে বোঝা যাচ্ছে সেই সংখ্যা বড়জোর ৩৫ শতাংশ! অসন্তুষ্ট কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বক্তব্য, এর পরে রাজ্য নেতৃত্বের কথায় ভরসা রাখা যাবে কেমন করে!
তথাপি ভিন্ন পরিস্থিতিতে এ বার মমতার রাজ্যকেই শাহ ৩৫ আসনের লক্ষ্য হিসাবে তুলে ধরলেন। শুধু তা-ই নয়, রাজ্য নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে নির্দেশ দিলেন, এই মর্মে প্রচার শুরু করে দিতে হবে। শুনেছি, বৈঠকে রাজ্য নেতাদের কারও কারও মনে সংশয় উঁকি দিয়েছিল, এতটা কি সম্ভব! শাহ সকলকে জানিয়ে দেন, “কেউ প্রশ্ন করলে বলবেন, এ কথা অমিত শাহ বলেছেন।”
এটাই বোধ হয় শাহি-অঙ্কের না-বলা সমাধান। হতে পারে, তৃণমূলের অবস্থা ‘কত খারাপ হবে’, সেই হিসাবটি তিনি কষে ফেলেছেন। তবে উত্তর মিলল কি না, বোঝা যাবে সময় এলে।