Dementia

স্মৃতিভ্রম ও বার্ধক্য সঙ্কট

সম্প্রতি জার্নাল অব ইকনমিক লিটারেচার-এর (জুন ২০২৩) একটি পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে পঁয়ষট্টি-ঊর্ধ্ব বয়সের ব্যক্তির স্মৃতিহীনতা রোগটি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

Advertisement

পরন্তপ বসু

শেষ আপডেট: ২১ অগস্ট ২০২৩ ০৫:১৯
Share:

—প্রতীকী চিত্র।

মনে পড়ে, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের সত্যি ঘটনার উপর লেখা ‘সাক্ষী ডুমুর গাছ’ গল্প। সাতাশি বছরের বৃদ্ধ ধীরে ধীরে বিস্মরণের জগতে চলে গেলেন। সম্পূর্ণ আত্মবিস্মৃত বাবাকে হাওড়া স্টেশনে ট্রেনে তুলে দিল মেয়ে, মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিল যে, কোনও এক অজানা স্টেশনে কেউ তাঁকে নামিয়ে নেবে।

Advertisement

ভয়ানক এই গল্প এখন প্রায় পরিচিত বাস্তব হওয়ার জোগাড়। বিস্মরণ রোগ সারা বিশ্বব্যাপী এক বিরাট সমস্যা। যখন শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলি ধীরে ধীরে অচল হতে থাকে তখন আমরা অসহায় বোধ করি। কিন্তু যখন মাথাটিও ধীরে ধীরে তার কর্মক্ষমতা হারাতে শুরু করে এবং অবশেষে নিজের মানুষকে চেনার ক্ষমতাও হারিয়ে যায়? সেই পরিস্থিতির মোকাবিলা কী ভাবে করবে পরিবার ও সমাজ?

সম্প্রতি জার্নাল অব ইকনমিক লিটারেচার-এর (জুন ২০২৩) একটি পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে পঁয়ষট্টি-ঊর্ধ্ব বয়সের ব্যক্তির স্মৃতিহীনতা রোগটি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। মহিলাদের এই ব্যাধির সম্ভাবনা পুরুষদের থেকে দুই-তৃতীয়াংশ কম। শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় কৃষ্ণাঙ্গ এবং মেক্সিকানদের এই ব্যাধির প্রকোপে পড়ার সম্ভাবনা বেশি। পড়াশোনার জগতের লোকেদের রোগটি হওয়ার সম্ভাবনা কম।

Advertisement

বিস্মরণ রোগের (অ্যালঝাইমার’স ডিজ়িজ়) তিনটি স্তর। প্রথম স্তরে কিছু সাম্প্রতিক ঘটনা ভুলে যাওয়া, নাম ভুলে যাওয়া। এই ধরনের বিভ্রম অনেক প্রৌঢ় লোকেরই হয়, যার জন্য ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হয় না। দ্বিতীয় স্তরে এই লক্ষণগুলি বৃদ্ধি পায়। পরীক্ষা করে মস্তিষ্কের ভিতর কিছু কোষে অস্বাভাবিকতা ধরা পড়ে। তার ফলে স্মরণশক্তি, আচরণগত ও সামাজিক দক্ষতা, এ সবই ধীরে ধীরে নষ্ট হতে থাকে; তা সত্ত্বেও, হাঁটাচলা এবং ব্যক্তিগত কাজকর্ম করার ক্ষমতা তখনও পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। শেষ স্তরটি ডিমেনশিয়া, যখন মানুষ মস্তিষ্কের কোষ বা নিউরনের ক্রমাগত অবক্ষয়ে বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যায়। রোগীর স্বাভাবিক ও স্বাধীন ভাবে শারীরিক কার্য সম্পাদন করার ক্ষমতা হ্রাস পায়। কিছুই আর তাঁর কাছে পরিচিত ঠেকে না।

ইংল্যান্ডের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের ওয়েবসাইট থেকে জানছি এই ব্যাধিটি শুরু হচ্ছে মস্তিষ্কের কোষে দু’রকম প্রোটিন জমা হয়ে, যার একটি হল বিটা অ্যামাইলয়েড ও অপরটি টাউ প্রোটিন। সহজ কথায় এই প্রোটিনগুলি পুঞ্জীভূত হয়ে স্নায়ুগুলির মধ্যে নিউরোফাইব্রিলারি ট্যাঙ্গেলস বা জট তৈরি করে। আবার যে নিউরোট্রান্সমিটার এক স্নায়ুকোষ থেকে আর এক স্নায়ুকোষে রাসায়নিক সঙ্কেত পাঠায়, সেগুলি যদি যথাযথ কাজ না করে, তা হলেও রোগটি দানা বাঁধতে পারে। এই রোগের চিকিৎসায় আমেরিকায় কয়েকটি ওষুধ বেরিয়েছে যা রোগের প্রকোপ স্তিমিত করতে সক্ষম। নিরাময়ের পথ কিন্তু এখনও অজানা।

চিকিৎসাশাস্ত্র বলছে বিস্মরণ রোগের মোকাবিলার প্রথম পদক্ষেপটি ব্যক্তিকেন্দ্রিক। নিজের দেখভাল করা, স্বাস্থ্যকর খাওয়াদাওয়া, মনকে অবসাদমুক্ত রাখা, যোগব্যায়াম বা অন্য কায়িক পরিশ্রম করা, মস্তিষ্কের কোষগুলিকে চালু রাখার চেষ্টা করে যাওয়া। যেমন, ধাঁধা সমাধান, সুদোকু খেলা, শব্দজব্দ, ছবি আঁকা, বই পড়া, নতুন ভাষা শেখার চেষ্টা ইত্যাদি।

দ্বিতীয় পথটি সরকারি হস্তক্ষেপ। অ্যালঝাইমার’স সোসাইটির একটি সমীক্ষা জানাচ্ছে যে, সারা বিশ্বে এই রোগটি নিরাময়ের জন্য যে গবেষণা প্রয়োজন তার জন্য সরকারি অনুদান ক্যানসার বা অন্যান্য ব্যাধির তুলনায় অনেক কম। ভারতের মতো দেশে, যেখানে প্রৌঢ়-যুবার অনুপাত উন্নত দেশগুলির থেকে তুলনামূলক ভাবে অনেক কম, এই রোগটি অবহেলিত।

জীবননির্বাহ ক্রমশ জটিল হয়েছে। সন্তান কাজের জন্য বৃদ্ধ বাবা-মাকে ছেড়ে দূরদূরান্তে পাড়ি দিচ্ছেন। অনেকে বাবা-মায়ের কাছে থেকেও তাঁদের দেখাশোনা করতে আগ্রহী নন। এ ক্ষেত্রে কী করণীয়? বৃদ্ধাশ্ৰম একটি বিকল্প। ভারতে এখন কিছু ভাল বৃদ্ধাশ্রম তৈরি হয়েছে। তবে সেগুলি সাধারণত আমজনতার সাধ্যের বাইরে। অবশ্য সেখানেও কোনও প্রিয়জনের তত্ত্বাবধানের প্রয়োজন।

যাঁর সে রকম কেউ নেই, তাঁর কী উপায়? অর্থনীতিতে একটি ধারণা আছে, যাকে বলে ঝুঁকি বণ্টন (রিস্ক শেয়ারিং), যা বাজারি বিমার বিকল্প হিসাবে কাজ করতে পারে। ধরুন, আমি আমার সমবয়সি বা সমমনস্ক বন্ধুদের নিয়ে একটি কমিউনিটি বানালাম। তাদের সঙ্গে সুখ-দুঃখের কথা বিনিময় করলাম। এরাই আমার বার্ধক্যের ঝুঁকি খানিকটা বহন করতে পারেন। আবার একই সাহায্য আমি বন্ধুদের জন্য করার চেষ্টা করতে পারি। এই ধরনের কমিউনিটি আমার দাদু তৈরি করেছিলেন অনেক বছর আগে। গোলদিঘিতে প্রতি দিন তিনি তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করে আড্ডা দিতেন। এখন আমাদের গোলদিঘিতে যাওয়ার আর দরকার নেই, হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জার বা জ়ুম ‘গ্রামে’ আমরা এই গোষ্ঠী তৈরি করতে পারি। যে কোনও গোষ্ঠী নয়, তার জন্য সচেতন যৌথ উদ্যোগ রাখতে হবে। অবশ্য এই ধরনের অলিখিত ঝুঁকি বণ্টন বাস্তবে কি কার্যকর হয়? রবার্ট টাউনসেন্ড এবং তাঁর গবেষকদের তাইল্যান্ডের কিছু গ্রাম নিয়ে ২০১৪ সালের সমীক্ষা বলছে যে, একই গ্রামে আত্মীয়বন্ধুদের মধ্যে ঝুঁকি বণ্টন সুষ্ঠু ভাবেই কাজ করেছে।

অর্থাৎ বাজার বা রাষ্ট্র যখন সমস্যার সমাধান করতে পারে না, বন্ধুবান্ধব ভার্চুয়াল প্রতিবেশীরা ব্যক্তিগত স্তরে এই ঝুঁকি বণ্টনের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান ও মীমাংসা করতে পারেন। শেষের সে দিন হয়তো ভয়ঙ্করই, তবু চেষ্টা, একটু সকলের সঙ্গে জড়িয়ে থাকার।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement