প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
অর্থশাস্ত্র, সন্দেহ নেই, একটি বিচিত্র বিষয়। এক দিকে তার শিকড় রয়েছে বিজ্ঞান ও তথ্য-পরিসংখ্যানের গভীরে— এঞ্জিনিয়ারিংয়ের মতো; অন্য দিকে তা সাধারণ বোধবুদ্ধি আর কাণ্ডজ্ঞানের বিষয়, যা যে কোনও বুদ্ধিমান লোকের পক্ষেই বোঝা সম্ভব। এই দ্বৈত চরিত্রের কারণেই বিপত্তি ঘটে নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে। যিনিই ক্ষমতায় থাকুন না কেন, যিনিই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুন না কেন, ভুলের অবকাশ থেকেই যায়। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের আমলেও নীতিনির্ধারণের কখনও কখনও ক্ষেত্রে ভুল হয়েছিল, ঠিক যেমন ঘটেছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আমলেও। কিন্তু, ফারাকও আছে। আজকের দুনিয়ায় একটি প্রবণতা তৈরি হয়েছে— যে কোনও সমালোচনা, বা শাসকদের স্বার্থের প্রতিকূল যে কোনও কথাকেই সম্পূর্ণ উড়িয়ে দেওয়া। এর ফলে নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে গুণগত অবনতি ঘটছে।
আর্থিক অসাম্যের কথাই ধরা যাক। গত অর্থবর্ষে ভারতের জাতীয় আয়ের বৃদ্ধির হার ছিল ৭.৬%। হারটি ভাল, তা নিয়ে সংশয় নেই। কিন্তু, শুধু সার্বিক ভাবে জাতীয় আয়ের বৃদ্ধির দিকে তাকালেই চলবে না। অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, সেই সার্বিক আয় দেশের মানুষের মধ্যে কী ভাবে বণ্টিত হয়েছে, তার খোঁজ নেওয়া। প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ ১৯৫০-এর দশকে ভারতের জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যবস্থার ক্ষেত্রে যে বিশ্বমানের কাজ করেছিলেন— শুধু বিশ্বমানেরই নয়, তাঁর কাজ ছিল গোটা দুনিয়ায় অগ্রণী— তার কল্যাণে ভারতের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান বোঝার জন্য যথেষ্ট ভাল মানের পরিসংখ্যান ভারতে রয়েছে।
যে মুহূর্তে কেউ সার্বিক আর্থিক বৃদ্ধির হারের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দেশের আর্থিক অসাম্যের ছবিটির দিকে তাকাবেন, সেই মুহূর্তে স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, ভারতের অবস্থা উদ্বেগজনক। আর্থিক অসাম্য এমন একটি স্তরে পৌঁছে গিয়েছে, যা কোনও মতেই গ্রহণযোগ্য নয়। ভারতে এখন খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির হার ৮.৫%, যা রীতিমতো চড়া। অতীতেও মূল্যস্ফীতি ঘটেছে, কিন্তু তার থেকে আজকের অবস্থাটি গরিব এবং মধ্যবিত্ত মানুষের পক্ষে কঠিনতর, কারণ অতীতে মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি আয়বৃদ্ধিও ঘটত, যাতে মূল্যস্ফীতির আঁচ কম পড়ত মানুষের গায়ে। এখন দেশের বেশির ভাগ মানুষের আয় বাড়ছে না— কারণ, যে আয়বৃদ্ধি ঘটছে, তা কার্যত ধনীতম শ্রেণির মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
ভারতে চিরকালই আর্থিক অসাম্য ছিল— ভাল রকমই ছিল— কিন্তু এখন সেই অসাম্য যে স্তরে পৌঁছেছে, তা গত ৭৫ বছরে দেখা যায়নি। অর্থনীতিবিদ তোমা পিকেটি ও তাঁর সহকর্মীরা ভারতের আর্থিক অসাম্য নিয়ে যে পরিসংখ্যান-ভিত্তিক বিশ্লেষণ করেছেন, তাতে দেখা যাচ্ছে, এখন আর্থিক অসাম্য যে স্তরে রয়েছে, তা শেষ দেখা গিয়েছিল ব্রিটিশ শাসনকালে, ১৯৩০-এর দশকে। ভারতে এখন যে গোত্রের সাঙাততন্ত্র চলছে, এত দিন তা দেখা যেত মূলত পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলিতে।
একই সঙ্গে মনে করিয়ে দেওয়া দরকার যে, ভারতে জাতীয় আয়ের বৃদ্ধি যে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছচ্ছে না, তার বিভিন্ন পরোক্ষ প্রমাণ মিলছে। তরুণ সম্প্রদায়ের মধ্যে এখন বেকারত্বের হার ১৮%। গত পাঁচ বছরে বেকারত্বের যে চড়া হার ভারত প্রত্যক্ষ করেছে, স্বাধীন ভারতে তা আগে কখনও দেখা যায়নি। এখানে স্পষ্ট করে বলে দেওয়া প্রয়োজন যে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের কিন্তু বেকার তরুণ হিসাবে গণ্য করা হয় না। বেকারত্বের হিসাব হয় শুধু তাঁদের নিয়ে, যাঁরা কাজ খুঁজছেন, কিন্তু পাচ্ছেন না। কৃষকদের অবস্থাতেও এই একই হতাশাব্যঞ্জক ছবি ফুটে ওঠে। ২০২২ সালে ভারতে কৃষকদের মধ্যে আত্মহত্যার সংখ্যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক স্তরে পৌঁছেছিল— দারিদ্র ও ঋণের বোঝায় চাপা পড়ে সে বছর ১১,২৯০ জন কৃষক আত্মঘাতী হয়েছিলেন।
দুর্ভাগ্যের কথা, এমন নেতিবাচক পরিসংখ্যান সামনে এলেই তাকে ধামাচাপা দিয়ে দেওয়া হয়। বলা হয়, এমন কথা জাতীয় স্বার্থবিরোধী, ‘অ্যান্টি ন্যাশনাল’। সাধারণ মানুষকে সমানেই বুঝিয়ে চলা হয় যে, যত ক্ষণ ভারতের জাতীয় আয় বেড়ে চলেছে, তত ক্ষণ সব ঠিক আছে, কোনও চিন্তা নেই।
আমি এমন দাবি করছি না যে, আর্থিক অসাম্যকে সমূলে উচ্ছেদ করতেই হবে। একটি অর্থব্যবস্থাকে কুশলী ভাবে পরিচালনা করার জন্য খানিকটা অসাম্যের প্রয়োজন, কারণ সেই অসাম্য ইনসেন্টিভ বা প্রণোদনা তৈরি করে। তার উপরে, অসাম্য কমানোর জন্য খুব বেশি চাপাচাপি করা হলে পুঁজি দেশ ছেড়ে পালাতে পারে। কিন্তু, এই কথাগুলি মাথায় রাখার পরও বলতেই হচ্ছে যে, এখন পরিস্থিতি যে রকম, তাতে অনেক কিছু করা সম্ভব এবং প্রয়োজন।
মহাত্মা গান্ধী গোটা দুনিয়াকে তাঁর অন্ত্যোদয়ের মন্ত্র শিখিয়েছিলেন— “সবচেয়ে গরিব, সবচেয়ে দুর্বল যে মানুষটির কথা মনে করতে পারো, তার মুখটি মনে করো; নিজেকে প্রশ্ন করো, যে কাজটি করার কথা ভাবছ, তাতে কি এই মানুষটির কোনও উপকার হবে?” গান্ধীজির এই কথাটি পরবর্তী কালে বহু মানুষের অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছে। জন রলস-এর মতো অগ্রগণ্য দার্শনিক ন্যায্যতার সূত্র নির্ধারণে যে নৈতিক মাপকাঠির কথা বলেছেন, তার সঙ্গে গান্ধীর এই সূত্রটির মিল রয়েছে। দুর্ভাগ্য, ভারতে তরুণদের সামনে থেকে যখন কর্মসংস্থানের সুযোগ মুছে যাচ্ছে, যখন কৃষকরা আরও বিপন্ন হচ্ছেন, তখন ভারতীয়দের একটি নতুন মন্ত্র শেখানো হচ্ছে: “নিজের আর্থিক অবস্থা নিয়ে যখন বিষণ্ণ বোধ করবেন, যখন নিতান্ত সংসার চালানোর সংস্থানটুকুও করতে পারবেন কি না তা নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হবেন, তখন যে ধনীতম মানুষটির কথা মনে করতে পারেন, তাঁর মুখটি মনে করুন, এবং খুশি থাকুন।”
ক্রমবর্ধমান আর্থিক অসাম্যের পাশাপাশি ভারতে সামাজিক ও ধর্মীয় অসহিষ্ণুতাও বেড়ে চলেছে। কিন্তু, যাবতীয় সমস্যা সত্ত্বেও আশাবাদী হওয়ার কারণ রয়েছে। সেই আশার উৎস সাধারণ মানুষ। সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব ডেভলপিং সোসাইটিজ়-এর (সিএসডিএস) একটি সাম্প্রতিক সমীক্ষার ফলাফলে দেখা যাচ্ছে যে, ৮০% হিন্দু মনে করেন, ভারত সবার দেশ, শুধুমাত্র হিন্দুদের নয়।
ভারতে গণতন্ত্র, বাক্স্বাধীনতা এবং বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের অতি উজ্জ্বল ঐতিহ্য রয়েছে। যে শহরে আমার বড় হয়ে ওঠা, সেই কলকাতা তার একটি উদাহরণ। দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ কিছু বিজ্ঞানী এবং লেখককে এই শহর আশ্রয় দিয়েছে, তাঁদের মননের পুষ্টি জুগিয়েছে। এই শহর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাসস্থান, নজরুল ইসলামেরও। এই শহরেই থেকেছেন মহান হিন্দু সন্ন্যাসীরা; আবার মাদার টেরিজ়া তাঁর ঠিকানা হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন এই কলকাতাকেই।
যে তিন বছর আমি কেন্দ্রীয় সরকারের উপদেষ্টা হিসাবে কাজ করেছিলাম, তখন আমি আমার সহকর্মীদের মধ্যে বৈচিত্র দেখে অবাক হতাম, সেই বৈচিত্রকে সম্মান করতাম। তাঁরা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসেছিলেন— তাঁদের পটভূমিকা পৃথক, বৌদ্ধিক জগৎ ও ক্ষমতা পৃথক, সাংস্কৃতিক প্রতিভা পৃথক। আমি মজা করে বলতাম, আমাদের বাঙালিও প্রয়োজন, আর পঞ্জাবিও প্রয়োজন। ঘটনা হল, দু’জনকেই পাওয়ার সৌভাগ্য আমাদের হয়েছিল— অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মধ্যে আমরা সেই পঞ্জাবিকে পেয়েছিলাম, আর প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের মধ্যে পেয়েছিলাম সেই বাঙালিকে।