বিচারপতি বদলালেই বিচার গতি হারাবে, এই ধারণা কি সঙ্গত
Justice Abhijit Gangopadhyay

হাকিম এবং হুকুম

মাননীয় বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রসঙ্গ সরিয়ে রেখে প্রথমে ভাবা যাক, সামগ্রিক পরিস্থিতি বিচারব্যবস্থা-নির্ভর হয়ে ওঠে কখন এবং কেন?

Advertisement

দেবাশিস ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৪ মে ২০২৩ ০৪:২৩
Share:

প্রতিবাদ: বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের সমর্থনে কংগ্রেসের মিছিল। ২৯ এপ্রিল, কলকাতা। ছবি: সুমন বল্লভ।

বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের কিছু নির্দেশ ঘিরে সমাজ এখন আলোড়িত। বিষয়টি কার্যত সামাজিক আন্দোলনের মাত্রা নিয়ে ফেলেছে। আদালতের বিভিন্ন রায় সমাজকে নাড়া দিয়েছে, এমন নজির কম নেই। কিন্তু নির্দিষ্ট এক জন বিচারপতির হাতে নির্দিষ্ট একটি বিষয় বিচারের ভার থাকা বা না-থাকার প্রশ্নে যা ঘটছে, তেমন উদাহরণ দ্বিতীয়টি আছে বলে মনে হয় না। আইন বিষয়ে নিজের সীমাহীন অজ্ঞতা কবুল করি। তবে যা নিয়ে সমাজ আন্দোলিত হয়, রাজনীতি রসদ পায় এবং বিচারব্যবস্থার বিবিধ প্রকরণ আলোচ্য হয়ে ওঠে, তা নিয়ে কথা বলার পরিসর অবশ্যই থাকে।

Advertisement

মাননীয় অভিজিৎবাবুর প্রসঙ্গ সরিয়ে রেখে প্রথমে ভাবা যাক, সামগ্রিক পরিস্থিতি বিচারব্যবস্থা-নির্ভর হয়ে ওঠে কখন এবং কেন? সম্ভবত সকলেই মানবেন যে, এর পিছনে নিয়ামক-প্রক্রিয়ার উপরে এক প্রকার আস্থাহীনতার মানসিকতা কাজ করে। অর্থাৎ, যার যে ভূমিকা পালন করার কথা, তা যথাযথ হচ্ছে না মনে করলে তখন আদালত হয়ে ওঠে ‘ক্ষুব্ধ’ বা ‘বঞ্চিত’দের ভরসার আশ্রয়।

ব্যক্তি, সমাজ, সরকার, রাজনৈতিক দল কেউ এই বৃত্তের বাইরে নয়। ব্যক্তি যদি মনে করে যে, কোনও ভাবেই ‘ন্যায্য’ প্রাপ্য পাওয়া যাচ্ছে না; রাজ্য যদি মনে করে যে, কেন্দ্র তাকে ‘বঞ্চনা’ করছে; কেন্দ্র যদি মনে করে যে, রাজ্য ‘নিয়ম বহির্ভূত ভাবে’ কাজ করছে; এক দল যদি বিশ্বাস করে যে, তারা অন্য দলের দ্বারা পীড়িত— এমন যাবতীয় ক্ষেত্রে সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে ‘সুবিচার’-এর আশায় শেষ পর্যন্ত নালিশ নিয়ে আদালতে যেতে পারে।

Advertisement

সেই প্রক্রিয়াতেই পশ্চিমবঙ্গে এখন আদালতের সামনে সবচেয়ে গুরুতর বিচার্য হল বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগ। শিক্ষা ক্ষেত্রে নিয়োগ-দুর্নীতির মামলা যার অন্যতম। মাননীয় বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় তারই ভার পান বেশ কিছু দিন আগে।

কোন মামলার কী নিষ্পত্তি হবে, সে সব আমাদের এক্তিয়ারের বিষয় নয়। তবে বলতেই হবে যে, আদালতমুখী হওয়ার ক্রমবর্ধমান প্রবণতা কোনও নির্বাচিত সরকারের পক্ষে স্বস্তির বার্তা দেয় না। কারণ, শাসক ও শাসনব্যবস্থার ‘স্বচ্ছতা’ এর ফলে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যায়। হচ্ছেও তা-ই। এক দিকে আদালতের দরজায় ভিড় বাড়ছে। অন্য দিকে, সাধারণ মানুষ টিভির পর্দায় যা দেখছেন, কাগজের পাতায় যা পড়ছেন, জনমনে তার প্রভাব পড়ছে অনিবার্য ভাবে। এক তুড়িতে সেগুলি মুছে ফেলা খুব সহজ নয়।

বস্তা বস্তা নোটের বান্ডিল উদ্ধার থেকে শুরু করে অবৈধ নিয়োগের বিবিধ কাগজপত্র এবং নানা দুর্নীতিতে অভিযুক্ত নেতা-মন্ত্রী ও দালালদের কোটি কোটি টাকার হদিস যে ভাবে সামনে আসছে, তার ভিত্তিতে লোকের মনে কিছু ধারণা তৈরি হতে বাধ্য। এই বাস্তবতাকে বিনা তর্কে মেনে নেওয়াই বুদ্ধির কাজ।

এ বার মানুষের ধারণা যদি এক জন বিচারপতির পর্যবেক্ষণ ও নির্দেশের সঙ্গে মোটামুটি সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, তখন সেই বিচারপতি সমাজের একাংশের চোখে রাতারাতি ‘ড্যানিয়েল’ হয়ে ওঠেন। লোক বলতে শুরু করেন, স্বয়ং ঈশ্বর যেন বিচারে বসেছেন! নিয়োগ-দুর্নীতির মামলায় মান্যবর বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় লোকচক্ষে সে ভাবে চিহ্নিত হয়ে গিয়েছেন। তাই তাঁর ঘর থেকে মামলা সরানোর ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ ঘিরে এত শোরগোল। না হলে, যত দূর জানি, বিচারপতিদের দায়িত্বে হামেশাই রদবদল হয়। আজ যিনি এই মামলা শুনছেন, কাল হয়তো অন্য বেঞ্চে বসে তিনি অন্য মামলা শুনবেন।

কিন্তু তাতে আগের মামলা ‘ধাক্কা’ খাবে, কিংবা বিচারপ্রার্থীদের ‘সুবিচার’ পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হবে, এই কলরব ওঠার কথা নয়। কথায় বলে, হাকিম নড়লেও হুকুম নড়ে না। সকল বিচারপতির কাছে সম ভাবে ‘ন্যায়’ মিলবে, এটাই তো প্রত্যাশিত। সেখানে এক জন বিচারপতিকে নিয়ে এমন আলোড়ন যেমন ব্যতিক্রমী, তেমনই তাৎপর্যপূর্ণ।

বিচারপতি হিসাবে মাননীয় অভিজিৎবাবুর কিছু পদক্ষেপকেও অন্য বিচারপতিদের সঙ্গে বোধ হয় মেলানো যায় না। সবাই দেখেছেন, আদালতের ভিতরে ও বাইরে তাঁর বিবিধ মন্তব্য, ঘোষণা, পর্যবেক্ষণ ইত্যাদি ক্রমাগত রাজনৈতিক মঞ্চের উপাদান হয়ে উঠেছে। সেই সব বক্তব্যকে নিশানায় রেখে দলগুলি কাদা-ছোড়াছুড়ি করছে। তাঁর নাম টানা হচ্ছে সেই তরজায়। এ জিনিস কতটা বাঞ্ছনীয়, শোভন, মর্যাদাকর, সেই অনধিকারচর্চার গণ্ডিতে পা না-রেখেও এগুলি দৃষ্টি এড়ায় না। বস্তুত এই বিচারপতি নিজেই বলেছেন, তিনি তাঁর পদক্ষেপ এবং কর্মধারা সম্পর্কে সচেতন, ওয়াকিবহাল।

পেশাদার সাংবাদিক হিসাবে অনেক বিচারপতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের সুযোগ ঘটেছে। কারও কারও সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কও তৈরি হয়েছে। কিন্তু দেখেছি, কোনও বিচারাধীন মামলাসংক্রান্ত প্রশ্ন করলেই বিচারপতি তা এড়িয়ে যাচ্ছেন। উত্তর কলকাতার বাসিন্দা এক প্রয়াত বিচারপতিকে মনে পড়ে। আদালত থেকে ফিরে কোঁচানো ধুতি, গিলে করা পাঞ্জাবি, হাতে রুপোর পানের ডিবে নিয়ে ফুরফুরে সুগন্ধি ছড়িয়ে তিনি প্রবীণ চিকিৎসকদের একটি সান্ধ্য আড্ডায় যেতেন। সেখানে বহু বার যোগ দেওয়ার সুযোগ হয়েছে। তাঁর এজলাসে কলকাতার কাছে এক জেলার মেয়েদের একটি স্কুলের জোরদার মামলা চলছিল তৎকালীন বাম সরকারের সঙ্গে। এক দিন তাঁকে জিজ্ঞাসা করে ফেললাম, “দাদা, মামলাটার কী হবে মনে হয়? কোনটা স্ট্রং সাইড?” বিচারপতি বললেন, “আমার সঙ্গে বাড়িতে চল। দু’জনে লুচি খাব।” তখন বলবেন তো? এ বার তাঁর সহাস্য জবাব, “কী করে বলব? তখন তো মুখে লুচি!” সেই মামলায় সরকারপক্ষ হেরেছিল।

কলকাতা হাই কোর্ট থেকে সুপ্রিম কোর্টে চলে যাওয়া এক প্রাক্তন বিচারপতিকে জানি, যিনি দায়িত্বে থাকাকালীন নিজের আত্মীয়-পরিজনের বাড়ির কোনও জনবহুল অনুষ্ঠানেও যেতেন না। আবার এমন বিচারপতিও দেখেছি, কর্মরত অবস্থায় যিনি অতি প্রভাবশালী কারও বাড়িতে নৈশাহার সারছেন। এখন তো দেশের শীর্ষ বিচারপতিকে অবসরের পরেই ক্ষমতাসীন দলের সমর্থনে সাংসদ হয়ে যেতেও দেখা গেল।

তবু বলব, এক জন আইনজীবী উপযুক্ত দক্ষতার জোরেই বিচারপতির মহান আসনে বসার জন্য বিবেচিত হন। তাঁদের আইনি জ্ঞান, যুক্তিবোধ, নির্মোহ বিশ্নেষণী ক্ষমতা, নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি সবই সেই পদে ‘যোগ্যতা’র নির্ণায়ক। ব্যক্তিভেদে আচার-আচরণে কিছু তফাত হতে পারে। কেউ কেউ মিতবাক, কেউ কেউ হয়তো তুলনায় বাঙ্ময়। এটাও ঘটনা যে, সকল বিচারপতির সকল নির্দেশ সকলের মনঃপূত হওয়ার কথা নয়। কিন্তু রাজনীতি যত বেশি করে আদালতের মুখাপেক্ষী হয়ে উঠছে, বিচারপতিদের রায়, তাঁদের মন্তব্য, ‘ভূমিকা’ প্রভৃতি বিষয় ততই বেশি করে মেঠো বিতর্কের কেন্দ্রে উঠে আসছে। এই ‘বিবর্তন’ সংবিধানের অন্যতম স্তম্ভের নিরপেক্ষতাকে অনভিপ্রেত প্রশ্নের মুখে ফেলে কি না, বিজ্ঞজনেরা বলতে পারবেন। কিন্তু বিচারব্যবস্থা আজ এই পরিসরে চলে এল কেন, সেটি অবশ্যই গুরুতর প্রশ্ন।

সবাই জানি, তৃণমূল নেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের করা মামলার জেরে কলকাতা হাই কোর্টের মাননীয় বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের এজলাস থেকে প্রাথমিকে নিয়োগ-দুর্নীতি সংক্রান্ত দু’টি মামলা সরিয়ে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। তার পরেই মাননীয় অভিজিৎবাবুর প্রতিক্রিয়া, “আজ তো আমার মৃত্যুদিন!” এই সংক্রান্ত বাকি মামলাও তাঁর হাত থেকে সরতে পারে বলে মনে করেছেন তিনি। মাননীয়ের আরও মন্তব্য, “এর পরে যিনি বিচারপতি আসবেন, তিনি তাঁর স্টাইলে কাজ করবেন। আমি যে কাজ ছ’মাসে করেছিলাম, সে কাজ করতে গিয়ে ষাট বছর লেগে গেলেও আমার কিছু বলার নেই।”

বিচারপতির উক্তি নিয়ে ব্যাখ্যার স্পর্ধা করি না। শুধু জানার আগ্রহ, নির্দিষ্ট এক জন বিচারপতিকে বদলের সঙ্গে বিচারপ্রক্রিয়াটি ঝুলে যাওয়ার ধারণা দানা বাঁধে কেন?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement