সংস্কারবধ: মুক্ত চিন্তার রাজনীতির সন্ধান করছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও তাঁর গুণগ্রাহী স্বামী বিবেকানন্দ ফাইল ছবি।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত মোটেই রামচন্দ্রের অনুরাগী ছিলেন না। দু’শো বছর আগে তিনি যখন জন্মেছিলেন তখন এ বঙ্গে ভাঙা-গড়ার জটিল সময়। হিন্দুধর্ম ও পরিবারের সামন্ততান্ত্রিক রুদ্ধশ্বাস আধিপত্যের বাইরে গেলেন স্বাধীনচেতা মদুসূদন, তার পর ফিরেও এলেন, তবে ধর্মে নয়, বাংলা ভাষার আত্মপরিসরে। সেই বাংলা ভাষায় নতুন বন্ধে রচনা করলেন ভিন্নতর রামকথা। তাঁর রামকথায় বিষ্ণু-অবতার রাম নন, বড় হয়ে উঠলেন ইন্দ্রজিৎ। আম বাঙালি সেই ইস্কুলবেলা থেকে মধুসূদনের মেঘনাদবধ কাব্য-এর অংশবিশেষ পড়ে, কিন্তু মধুসূদনের রামকথার ‘রাজনৈতিক’ তাৎপর্য খুব একটা তলিয়ে ভাবে না। ভাবলে মধুসূদনের এই রামকথা একেলে জঙ্গি হিন্দুত্ববাদীদের বিরুদ্ধে বাঙালির শাণিত অস্ত্র হয়ে উঠতে পারত। রক্ষণশীল হিন্দুত্ববাদীরা পিতৃতন্ত্রকে কায়েম রাখার জন্য রামচন্দ্রকে ব্যবহার করেন, রামচন্দ্রকেন্দ্রিক সেই বয়ানে রামরথের ঘর্ঘর শব্দ। রাম ‘অপর’পক্ষীয়দের পদানত করবেন আর তাঁর নামে কায়েম হবে সার্বিক রামরাজত্ব— এই হিন্দুত্ববাদীদের স্বপ্ন। হিন্দুত্ববাদীদের এই রামরাজ্যে সীতা নিতান্তই রামানুগতা। মেয়েরা পুরুষজন্য। মধুসূদন সচেতন ভাবেই তাঁর রামকথায় এই দুই ভাবের বিরোধী। তখন হালের হিন্দুত্ববাদীরা ছিলেন না, তবে তাঁদের পূর্বজরা বহাল তবিয়তে ছিলেন।
মধুসূদন-রচিত রামকথা দু’ভাবে এই হিন্দুত্ববাদীদের বয়ানের বিরোধিতা করছে। এক দিকে লঙ্কার সমৃদ্ধি ও বৈভবের বিবরণ দিচ্ছেন মধুকবি, অন্য দিকে লঙ্কার রমণীদের স্বাধীন মনোভঙ্গির পরিচয় তুলে ধরছেন। কেন লঙ্কার এই বৈভব প্রদর্শন? রাবণের লঙ্কা কোনও অর্থেই রামের অযোধ্যার চাইতে দীন-হীন নয় তা বোঝাতে চাইছেন মধুকবি। মধুসূদন তাঁর ছাত্রদশায় একটি ইংরেজি নিবন্ধে (লেখাটির নাম ‘অ্যান এসে’) মন্তব্য করেছিলেন ভারতবর্ষে, বস্তুত পক্ষে প্রাচ্যের দেশগুলিতে, মহিলাদের কেবলমাত্র পুরুষের পাশবক্ষুধা পরিতৃপ্তির জন্য সৃষ্ট জীব বলে মনে করা হয়। যা বাস্তবে হয় ধ্রুপদী ও আধুনিক ট্র্যাজেডি শুধু তো সেটুকুকেই প্রকাশ করে না, যা হওয়া উচিত তাও বিবৃত করে। মধুসূদনের রামকথায় লঙ্কাপুরীর রমণীরা তাই বাস্তবের নিয়ম লঙ্ঘন করেন, ব্যতিক্রমী তাঁরা। নিজেদের মতামত সুস্পষ্ট ভাষায় প্রকাশ করেন নির্দ্বিধায়। এই মহাকাব্যের প্রথম সর্গেই যুদ্ধ-হত বীরবাহুর জননী চিত্রাঙ্গদা প্রকাশ্য রাজসভায় রাবণকে বলেন, ‘নিজ কর্ম-ফলে, মজালে রাক্ষসকুলে, মজিলা আপনি।’ পুরুষ রাবণের সীতাহরণ যে সমর্থনযোগ্য নয়, এই উচিতকথা যেমন রাবণপত্নী চিত্রাঙ্গদা বলতে ছাড়েন না, তেমনই ইন্দ্রজিতের মতো বীরস্বামীর গর্বে বলীয়ান প্রমীলাও মধুসূদনের কাব্যে নিজ ভুজবলের প্রতি গভীর ভাবে আস্থাশীল। প্রমীলার স্বাধিকারবোধ পাঠকের চোখ টানে। লঙ্কাপুরীর নারীদের আত্মমর্যাদাবোধ, ইন্দ্রজিতের বীরত্ব, বিভীষণের যুক্তিবাণ— প্রমাণ করে মধুসূদন কোনও অর্থেই লঙ্কাপুরীকে অযোধ্যার থেকে খাটো বলে মনে করতেন না। এখানে দু’-পক্ষের অবস্থান যেন সমান সমান। এ নরদেবতা আর রাক্ষসের লড়াই নয়, সভ্য (civilized) ও বুনোর (savage) লড়াই নয়, দুই উচ্চ-সভ্যতার সংঘাত।
উনিশ শতকে মধুসূদনের এই নতুন রামকথার ভাব ও ছন্দোবন্ধ অধিকাংশ বাঙালির কাছে অচেনা-অসহজ-অসফল বলে মনে হয়েছিল। মধুসূদনের কাব্যের প্যারডি তার প্রমাণ। জগবন্ধু ভদ্রের ছুছুন্দরীবধ কাব্য নামের প্যারডিটি সুপরিচিত। তরুণ রবীন্দ্রনাথও মধুসূদনের মেঘনাদবধ কাব্য-র তীব্র সমালোচক। মনে হয়েছিল তাঁর, “আজকাল যাঁহারা মহাকবি হইতে প্রতিজ্ঞা করিয়া মহাকাব্য লেখেন তাঁহারা... রাশি রাশি খটমট শব্দ সংগ্রহ করিয়া একটা যুদ্ধের আয়োজন করিতে পারিলেই মহাকাব্য লিখিতে প্রবৃত্ত হন। ...মেঘনাদবধের রাবণে অমরতা নাই, রামে অমরতা নাই, লক্ষ্মণে অমরতা নাই, এমন কি ইন্দ্রজিতেও অমরতা নাই। মেঘনাদবধ কাব্য-এর কোন পাত্র আমাদের সুখদুঃখের সহচর হইতে পারেন না, আমাদের কার্য্যের প্রবর্ত্তক নিবর্ত্তক হইতে পারেন না।”
তরুণ রবীন্দ্রনাথ মধুসূদনের কাব্যের অন্তর্গত রাজনীতি বুঝতে না পারলেও উনিশ শতকে এক জন হিন্দু সন্ন্যাসী অবশ্য মধুসূদনের সাহিত্যিক মহাকাব্যের রাজনৈতিক গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। এ কালের হিন্দুত্ববাদীরা এই সন্ন্যাসীর নানা ভাবনা ও কথার মধ্য থেকে নিজেদের পালে হাওয়া লাগানোর জন্য কয়েকটি কথা বেছে নেওয়ার চেষ্টা করেন। বাকি কথাগুলি ঢেকে রাখতে তাঁরা তৎপর। বিবেকানন্দ মধুসূদনের মেঘনাদবধ কাব্য-এর গুণগ্রাহী পাঠক এই চেনা কথাটি কম-বেশি অনেকেই উল্লেখ করেছেন। প্রমাণ হিসেবে তাঁরা শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তীর স্বামী শিষ্য সংবাদ নামের কথোপকথনের বইটির অংশ বিশেষ উদ্ধার করেন। মেঘনাদবধ কাব্য-এর ওজস্বী ভাষা, ইন্দ্রজিৎ ও রাবণের রাজসিকতা স্বামীজির প্রশংসার কারণ। বিবেকানন্দ মনে করেন “রজোগুণের ভেতর দিয়ে না গেলে উন্নত হবার জো আছে কি?” মধুসূদনের কাব্যে লঙ্কার সভ্যতায় তিনি সেই রজোগুণের প্রকাশ দেখেছিলেন। বিবেকানন্দ পাশ্চাত্য সভ্যতার বিবরণ দিতে গিয়ে বার বার লেখেন সেখানকার মেয়েদের কথা। কর্তৃত্বময়ী, কার্যকারিণী শক্তির অধিকারিণী সেই মেয়েদের সঙ্গে মধুসুদনের কাব্যের লঙ্কাপুরীর মেয়েদের কোথাও হয়তো মিল পেয়েছিলেন।
তবে কেবল এ জন্যই যে মধুসূদনের রামকথা বিবেকানন্দের ভাল লেগেছিল তা নয়, গভীরতর একটি কারণ ছিল। সে কথাটির কথা প্রায় কেউই নির্দেশ করেন না। এ কালের হিন্দুত্ববাদীদের রামকেন্দ্রিক ঔপনিবেশিকতা স্থাপনের কল্পস্বপ্নের কাঠামোগত বিরোধিতা বিবেকানন্দের কথাগুলির মধ্যে রয়েছে। বিবেকানন্দ তাঁর প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য রচনার শেষে পাশ্চাত্যের ঔপনিবেশিক শক্তির অন্যায়ের বিরোধিতা করার জন্য এক ভাবে রামায়ণের বিশ্লেষণ করেছিলেন। সেই বিশ্লেষণের মধ্যে উনিশ শতকের স্বভাবসিদ্ধ স্বাদেশিকতার বোধ প্রবল, আর্য-সভ্যতার প্রতি শ্রদ্ধা আছে কিন্তু সেই স্বাদেশিকতাবোধ ও আর্যশ্রদ্ধার সূত্রে তিনি রামকেন্দ্রিক উপনিবেশবাদ প্রচার করেননি। তাঁর জিজ্ঞাসা, “তুমি ইউরোপী, কোন্ দেশকে কবে ভাল করেছ? ...যেখানে দুর্ব্বল জাতি পেয়েছ, তাদের সমূলে উৎসাদন করেছ; তাদের জমীতে তোমরা বাস করছ, তারা একেবারে বিনষ্ট হয়ে গেছে।... তোমাদের অষ্ট্রেলিয়া, নিউজিলন্ড, পাসিফিক্ দ্বীপপুঞ্জ, তোমাদের আফ্রিকা?” এই উপনিবেশবাদী পাশ্চাত্যের সঙ্গে রামের পার্থক্য কোথায়? বিবেকানন্দ লেখেন “রামচন্দ্র আর্য্য রাজা, সুসভ্য, লড়ছেন কার সঙ্গে? লঙ্কার রাবণ রাজার সঙ্গে। সে রাবণ, রামায়ণ পড়ে দেখ, ছিলেন রামচন্দ্রের দেশের চেয়ে সভ্যতায় বড় বই কম নয়।” মধুসূদনের মতোই বিবেকানন্দও মনে করেন রাবণের সভ্যতা রামের সভ্যতার সমতুল। দুজনেরই মতে, রামায়ণ রামের বুনোবিজয়ের কাহিনি নয়। বিবেকানন্দ রামকথার বিদেশি বিশ্লেষকদের প্রশ্ন করেন, “হতে পারে দু এক জায়গায় আর্য্য আর বুনোদের যুদ্ধ হয়েছে... রাজারা মেরে ধরে চলে গেল। এ হতে পারে; কিন্তু এতেও বুনোদের জঙ্গল কেড়ে নিয়েছে, কোথায় পাচ্ছ?” মধুসূদনেও রামকথাতেও পাশ্চাত্যের ‘অসভ্য’ উপনিবেশকর্তার মতো শোকাহত লঙ্কাপুরীর উপর আক্রমণ করেননি রাম, সপ্তদিবানিশি বিষাদ যাপনের মর্যাদা লঙ্কা পেয়েছে। বিবেকানন্দের মধুসূদনপ্রিয়তা কবির পাশ্চাত্য উপনিবেশবাদীদের সঙ্গে রামকথার বেমিল প্রদর্শন সামর্থ্যের জন্য।
বাঙালির মধুসূদন বাঙালির বিবেকানন্দ রামকথার মধ্যে রামকেন্দ্রিক উপনিবেশবাদের ছবি দেখতে পাননি এ কথা বলার সময় এসেছে। এ কথাও মনে করিয়ে দেওয়া দরকার, রামের নামে সবার স্বাধিকার হরণ করার রাজনীতি আসলে বিবেকানন্দের ব্যাখ্যা অনুসারে রামের নৈতিকতাবোধের বিরোধী। উনিশ শতকের পাশ্চাত্য উপনিবেশবাদের অনুসরণেই ভারতে রামকেন্দ্রিক উপনিবেশবাদের কাঠামোটি নির্মাণ করা হচ্ছে। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই বিবেকানন্দের লেখার মধ্যে এমন কিছু উপসর্গ আছে যেগুলিকে প্রেক্ষিতহীন ভাবে ব্যবহার করে হালের হিন্দুত্ববাদীরা বিবেকানন্দকে ‘নিজেদের লোক’ বলে প্রমাণ করতে উঠে পড়ে লেগেছেন। তবে কায়স্থ সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ তাঁর জীবনের নানা ক্ষেত্রে সঙ্কীর্ণ হিন্দুত্ববাদীদের খাওয়া-পরা, আচার-বিচার সংক্রান্ত তঞ্চকতার বিরোধিতা করেছিলেন। তাদেরকে ‘স্বদেশী আহাম্মক’ বলতে দ্বিধা করেননি। রাম-উপনিবেশবাদীদের জন্য বিবেকানন্দের সেই শব্দবন্ধ প্রয়োগ করা কি বেদুরস্ত হবে!