একাত্তর ছিল এ বঙ্গের বাঙালির পরিচয়গৌরবের সেরা পরীক্ষা
Bangladesh Liberation War

আর এক অন্য মুক্তি

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর কলকাতার প্রতিক্রিয়া কী হয়েছিল, নানাবিধ তার বর্ণনা, নানা স্মৃতি, নানা আখ্যান। সে এক চূড়ান্ত সামাজিক অস্থিরতার দিন।

Advertisement

সেমন্তী ঘোষ

শেষ আপডেট: ২৫ মার্চ ২০২৩ ০৫:১৪
Share:

সহগমন: মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে কলকাতার রাস্তায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ও অন্য সাহিত্যিক-শিল্পীরা মিছিলে হাঁটছেন। ফাইল চিত্র।

একাত্তরের পঁচিশে মার্চ যা শুরু হয়েছিল, ইয়াহিয়া খানের সেই ‘অপারেশন সার্চলাইট’কে কি জেনোসাইড বলা যেতে পারে? এখন পিছনে তাকিয়ে আমরা সবাই বুঝতে পারি, এই প্রশ্নের কোনও দ্বিতীয় উত্তর হয় না। কিন্তু উনিশশো একাত্তরের মার্চ-শেষে পশ্চিমবঙ্গে বসে পুরো ছবিটা বোঝা তত সহজ ছিল না নিশ্চয়ই। তবু এই বঙ্গও উতলা হয়ে পড়েছিল ২৬ তারিখ থেকেই। ২৮ তারিখ আনন্দবাজার পত্রিকা-র এই সম্পাদকীয় পাতাতেই প্রকাশিত হয়েছিল নিখিল সরকারের একটি অনবদ্য লেখা, যাতে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের যুদ্ধকে বলেছিলেন ‘নবীন সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে নবীন জাতীয়তার মরণপণ লড়াই’, আর বলেছিলেন, ‘পূর্ব বাংলা যেন দ্বিতীয় বার এই জাতিকে পাতকী না করে।’ ‘এই জাতি’ বলতে তিনি বুঝিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গীয় ‘জাতি’কেই। এই একটি লেখাই বুঝিয়ে দিতে পারে, কী চোখে দেখছিল সে দিন বাংলার পশ্চিম— তার বিপন্ন পূর্ব দিগন্তকে। হতে পারে সেই ‘পুব’ খাতায়-কলমে ভিন দেশ, ইতিহাসে তার সঙ্গে ‘পশ্চিম’-এর ভাগাভাগির মহাকলঙ্ক। কিন্তু অন্তরে টান আছে কি না, কেমন সেই টান— তারই পরীক্ষা ঘটতে শুরু করেছিল একাত্তরে, পঁচিশে মার্চের সেই কালান্তক রাতের খবর এসে পৌঁছনো মাত্র।

Advertisement

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর কলকাতার প্রতিক্রিয়া কী হয়েছিল, নানাবিধ তার বর্ণনা, নানা স্মৃতি, নানা আখ্যান। সে এক চূড়ান্ত সামাজিক অস্থিরতার দিন। কেবল ভাবাবেগ নয়, যেন শিকড় ধরে কেউ টান দিয়েছে, এমনই ছিল ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ-পরবর্তী কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গের হাওয়াবাতাস। কত শ্রেণির কত রকম মানুষের কাছে সেই তীব্র মনোবেদনা পৌঁছেছিল, তার ইতিহাস হয়তো এখনও ঠিকমতো চর্চিত হয়নি।

কিছু কিছু স্মৃতিকথা তবু মনে ছবি এঁকে যায়। যেমন, সুভাষ মুখোপাধ্যায় অন্নদাশঙ্কর রায়কে এরই মধ্যে এক দিন তলব পাঠান, জরুরি ভিত্তিতে “ময়দানে চলে আসুন।” ময়দানে এক বিরাট জনসভা হতে চলেছে। তাতে যোগ দিতেই হবে। হঠাৎ জনসভা? খবর এসেছে ঢাকায় শেখ মুজিবকে হত্যার ষড়যন্ত্র হচ্ছে, যে করে হোক প্রতিবাদ করতেই হবে, সেই খবর ও পারে শাসকদের কানে পৌঁছে দিতে হবে, মানুষের মনে ভরসা জোগাতে হবে— এখনই, তাড়াতাড়ি। অন্নদাশঙ্কর তড়িঘড়ি ময়দানে পৌঁছে দেখেন, প্রচণ্ড ভিড়, মানুষের চাপে এগোনো যায় না, কারও মুখ দেখা যায় না। মঞ্চে তখন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বক্তৃতা করছেন।

Advertisement

এতই আন্দোলিত হয়েছিলেন অন্নদাশঙ্কর যে, বাড়ি ফিরেই ময়দানের অভিজ্ঞতা মনে করে কবিতা লিখে ফেললেন: যতকাল রবে পদ্মা যমুনা/ গৌরী মেঘনা বহমান/ তত কাল রবে কীর্তি তোমার,/ শেখ মুজিবুর রহমান।/ দিকে দিকে আজ রক্তগঙ্গা/ অশ্রু গঙ্গা বহমান/ তবু হবে জয়/ নাহি নাহি ভয়/ জয় মুজিবুর রহমান। কবিতা হিসেবে হয়তো খুব উচ্চস্তরের নয়, তাও এর মধ্যে সে দিনের আবেগকম্পিত পশ্চিমবঙ্গের হৃদয়ের ছবিটি মোক্ষম ধরা পড়েছিল ত্বরিত-রচিত লাইনে লাইনে— যেন নিজের ফেলে আসা পরমাত্মীয়ের জন্য উদ্বিগ্ন-আশঙ্কিত সে-হৃদয়। কেবল শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী নন, সাধারণ মধ্যবিত্ত, এমনকি দরিদ্র মানুষের মধ্যেও সেই হৃদয় চলকে উঠছিল। শুধু তো অধ্যাপক মামুদ আর উচ্চপদের আমলা অশোক সেনরা নন, ও পারের আশ্রয়-নেওয়া অসংখ্য মানুষের পাশে এসে তখন দাঁড়াচ্ছেন এ পারের অসংখ্য মানুষ। কেউ চা-বাদাম খাওয়াচ্ছেন বিনে পয়সায়, কেউ অর্থসাহায্য পাঠাবেন বলে পরিচিত বিপন্ন মানুষের তালিকা করছেন, কেউ শরণার্থীদের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান দেওয়ার জন্য দৌড়াদৌড়ি করছেন, কেউ রাজনৈতিক পরিকল্পনা কী হওয়া উচিত, সে বিষয়ে দিবারাত্রি উদ্বেগাক্রান্ত হয়ে আছেন। সংবাদপত্রের অফিসে উত্তেজিত আলোচনা থামছে না, খবরের পর খবর একই বিষয়ে। বড় কাগজগুলিতে পূর্ব পাকিস্তান ছাড়া খবর নেই। আকাশবাণী নেতৃত্বের ভূমিকায় নেমে পড়েছে, তার বাণীর উপর নির্ভর করছেন সীমান্তবাসীরাও। আর আছেন গৌরকিশোর ঘোষের মতো ব্যাঘ্রবিক্রম দু’-এক জন, যাঁরা নিজের দায়িত্বে আনকোরা তরুণ শরণার্থীদের পৌঁছে দিচ্ছেন সীমান্তবর্তী ক্যাম্পে, মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ আলাপ করিয়ে তাঁদের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করছেন।

১৯৪৭ সালের দেশভাগ যে কতটাই উপরিতলের ভাগ ছিল, অন্তরটানে দুই বাংলা যে কতটা যুক্ত ছিল, শুধু ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ নয়, মুক্তিযুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গের প্রতিক্রিয়াও তার সাক্ষ্য। অর্ধশতাধিক বছর পরে ফিরে তাকিয়ে মনে হয়, ১৯৭১ সালের গুরুত্ব স্বাভাবিক ভাবে কেবল পূর্ববঙ্গের দিক থেকেই দেখা হয়েছে, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গেও যে তার একটা বিরাট ঐতিহাসিক গুরুত্ব ছিল, তা যেন এখনও ততটা বোঝা হয়নি।

সেই গুরুত্ব খতিয়ে দেখতে গিয়ে যদি দাবি করা হয়, বঙ্গীয় হিন্দু ও মুসলমান সমাজ এত বেশি কাছাকাছি তার আগে বা পরে কখনওই আসেনি, খুব ভুল হবে কি? বিশ শতকে ইতিহাসে এমন আর একটিও মুহূর্ত পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না, যখন দুই বাংলার হিন্দু-মুসলমান সম্মিলিত জনসমাজ একই আবেগে থরোথরো, একই প্রতিজ্ঞায় উদ্ভাসিত। বঙ্গভঙ্গ-স্বদেশি যুগের কথা মনে করতে পারেন কেউ। ইতিহাস-পাঠক তাঁকে তখন মনে করিয়ে দিতে পারেন, আকারে ও প্রকারে দুই সময়ের আন্দোলিত জনসমাজের কোনও তুলনাই হয় না। একে তো স্বদেশি আন্দোলনের ব্যাপ্তি ছিল কম, তার উপরে বাঙালি মুসলমান তাতে কতখানি অংশ নিয়েছিলেন, বিতর্কের বিষয়। পরবর্তী রাজনৈতিক আন্দোলনগুলিতেও একত্র রাজনৈতিক কার্যক্রমের প্রসার অতখানি ছিল না। উনিশশো ত্রিশের দশক থেকে দুই সমাজ দূরবর্তী হতে শুরু করে। একাত্তরের দিনগুলি তাই বাংলার ইতিহাসে এক দুর্লভ মাহাত্ম্যে পূর্ণ। আর সব পরিচয় তুচ্ছ হয়ে গেল সে দিন, ‘বাঙালি’ পরিচয়ের সামনে। রোগাপাতলা বাঙালি মুসলমান-হিন্দু ছেলেরা হাতে হাতে অস্ত্র তুলে নিল ও পারে। আর এ পারে বসে সাংবাদিক-সাহিত্যিকের জোরালো কলম গর্জে উঠল: “রেখেছ বাঙালী করে, মানুষ করোনি?— ভুল, ভুল, একেবারে ভুল। সাত কোটি বাঙালীরে জননী মানুষও করেছেন, রবীন্দ্রনাথের ভুলটা ধরা পড়েছে এত দিনে, ওঁরা ধরিয়ে দিলেন, আমরা কৃতজ্ঞ।” (সন্তোষকুমার ঘোষ, আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৩ এপ্রিল ১৯৭১)

কেউ যদি দাবি করেন, পশ্চিমবঙ্গের অন্তরটি মথিত হওয়ার কারণ প্রধানত পুব থেকে আসা উদ্বাস্তু হিন্দুর ঢল, কিংবা পুব বাংলা থেকে অনতি-অতীতে নিজেরা চলে আসার ফল— আমি কিন্তু বলব, তাঁরা সবটা ছবি দেখতে পাচ্ছেন না। সন্দেহ নেই যে, তত দিনে যত মানুষ পশ্চিমবঙ্গে শরণ নিয়েছেন, তাতে বিষয়টি এক সম্মেলক হাহাকারের রূপ নিয়েছিল। ১৯৭১ সালে ভারতে আশ্রয় নেওয়া এক কোটি শরণার্থীর মধ্যে ৭৬ লক্ষই পশ্চিমবঙ্গে, কলকাতায় ২০ লক্ষ (যেখানে কলকাতার তখনকার জনসংখ্যাই ৭৫ লক্ষের কাছাকাছি)। সন্দেহ নেই, পশ্চিমবঙ্গের বহু মানুষের পরিবার-সূত্রে পূর্ব-যোগ ছিল। কিন্তু না, কেবল সেটুকুই নয়। উদ্বাস্তুরা সকলেই তো হিন্দু ছিলেন না, বহু মুসলমানও ছিলেন। তা ছাড়া, যাঁদের সরাসরি উদ্বাস্তু-যোগ নেই, তাঁদেরও কি সহনশক্তির কঠিন পরীক্ষা চলছিল না সে দিন? পাকিস্তানি সেনার আক্রমণ ও নির্যাতনের খবর এসে পৌঁছনোয় ক্রোধের বান ডেকেছিল যাঁদের, তাঁরা সকলেই কি পুব থেকে আসা মানুষ? শেখ মুজিব ও তাঁর মুক্তিযোদ্ধাদের হেনস্থার খবর এসে ঢেউ তুলেছিল যাঁদের মনে, তাঁরা অনেকেই কখনও চব্বিশ পরগনা কিংবা নদিয়ার পুবে যাননি। এ সবের মধ্যে কেবল হিন্দু ভাবাবেগ ছিল না। ভাল করে দেখলে বোঝা যাবে, একাত্তর ছিল বাঙালি টানের সেরা পরীক্ষা, বাঙালির পরিচয়গৌরবের তুঙ্গমুহূর্ত। না, পশ্চিমবঙ্গ আর হারেনি সেই পরীক্ষায়, ‘পাতকী’ হয়নি।

‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ যুদ্ধ সে দিন বাঙালিকে আনখশির উত্তাল করেছিল— মুক্তিযুদ্ধ আরও এক বৃহৎ মুক্তি ঘটিয়েছিল বাংলার যুক্তসমাজে। সম্প্রদায় ভাগের অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত, কিংবা ভ্রাতৃঘাতের পাপের মোচনও দেখতে পারেন কেউ— সেই মুক্তির মধ্যে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement